খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

12.7.18

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে




"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। কিন্তু আমাদের রাজকীয় দণ্ডধারী পুরুষটি ভাষার ঠিক কোন্‌ সীমানায় ঘাটি বাঁধিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন তাহা আমি স্পষ্টরূপে জানি না, এবং আমি ঠিক কোন্‌খানে পদার্পণ করিলে শাসনকর্তার লগুড় আসিয়া আমাকে ভূমিশায়ী করিবে তাহা কর্তার নিকটও অস্পষ্ট; কারণ, কর্তার নিকট আমার ভাষা অস্পষ্ট, আমিও নিরতিশয় অস্পষ্ট, সুতরাং স্বভাবতই তাঁহার শাসনদণ্ড আনুমানিক আশঙ্কাবেগে অন্ধভাবে পরিচালিত হইয়া দণ্ডবিধির ন্যায়সীমা উল্লঙ্ঘনপূর্বক আকস্মিক উল্কাপাতের ন্যায় অযথাস্থানে দুর্বল জীবের অন্তরিন্দ্রিয়কে অসময়ে সচকিত করিয়া তুলিতে পারে। এমন স্থলে সর্বতোভাবে মূক হইয়া থাকাই সুবুদ্ধির কাজ, এবং আমাদের এই দুর্ভাগ্য দেশে অনেকেই কর্তব্যক্ষেত্র হইতে যথেষ্ট দূরে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া সেই নিরাপদ সদ্‌বুদ্ধি অবলম্বন করিবেন তাহারও দুই-একটা লক্ষণ এখন হইতে দেখা যাইতেছে। আমাদের দেশের বিক্রমশালী বাগ্‌‌মী, যাঁহারা বিলাতি সিংহনাদে শ্বেতদ্বৈপায়নগণের চিত্তেও সহসা বিভ্রম উৎপাদন করিতে পারেন, তাঁহাদের অনেকে বিবর আশ্রয় করিয়া বাগ্‌রোধ অভ্যাস করিতে বসিবেন-দেশের এমন একটা দুঃসময় আসন্ন। সে সময়ে দুর্ভাগ্য দেশের নির্বাক্‌ বেদনা নিবেদন করিতে রাজদ্বারে অগ্রসর হইবে এমন দুঃসাহসিক দেশবন্ধু দুর্লভ হইয়া পড়িবে। যদিচ শাস্ত্রে আছে ‘রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধব’, তথাপি শ্মশান যখন রাজদ্বারের এত অত্যন্ত নিকটবর্তী হইয়াছে তখন ভীত বন্ধুদিগকে কথঞ্চিৎ মার্জনা করিতে হইবে।
অবশ্য, রাজা বিমুখ হইলে আমরা ভয় পাইব না আমাদের এমন স্বভাবই নহে, কিন্তু রাজা যে কেন আমাদের প্রতি এতটা ভয় প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিয়াছেন সেই প্রশ্নই আমাদিগকে অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন করিয়া তুলিয়াছে।...
সত্য যদি তাহাই হইবে তবে, হে রাজন্‌, আমাদিগকে আরো কেন অজ্ঞেয় করিয়া তুলিতেছ। যদি রজ্জুতে সর্পভ্রম ঘটিয়া থাকে তবে তাড়াতাড়ি ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া ভয়কে আরো পরিব্যাপ্ত করিয়া তুলিতেছ কেন। যে একমাত্র উপায়ে আমরা আত্মপ্রকাশ করিতে পারি, তোমাদের নিকট আপনাকে পরিচিত করিতে পারি, তাহা রোধ করিয়া ফল কী।
সিপাহিবিদ্রোহের পূর্বে হাতে হাতে যে রুটি বিলি হইয়াছিল তাহাতে একটি অক্ষরও লেখা ছিল না–সেই নির্বাক্‌ নিরক্ষর সংবাদপত্রই কি যথার্থ ভয়ংকর নহে। সর্পের গতি গোপন এবং দংশন নিঃশব্দ, সেইজন্যই কি তাহা নিদারুণ নহে। সংবাদপত্র যতই অধিক এবং যতই অবাধ হইবে, স্বাভাবিক নিয়ম-অনুসারে দেশ ততই আত্মগোপন করিতে পারিবে না। যদি কখনো কখনো ঘনান্ধকার অমাবস্যারাত্রে আমাদের অবলা ভারতভূমি দুরাশার দুঃসাহসে উন্মাদিনী হইয়া বিপ্লবাভিসারে যাত্রা করে তবে সিংহদ্বারের কুক্কুর না ডাকিতেও পারে, রাজার প্রহরী না জাগিতেও পারে, পুররক্ষক কোতোয়াল তাহাকে না চিনিতেও পারে, কিন্তু তাহার নিজেরই সর্বাঙ্গের কঙ্কণকিঙ্কিণীনূপুরকেয়ূর, তাহার বিচিত্র ভাষার বিচিত্র সংবাদপত্রগুলি কিছু-না-কিছু বাজিয়া উঠিবেই, নিষেধ মানিবে না। প্রহরী যদি নিজহস্তে সেই মুখর ভূষণগুলির ধ্বনি রোধ করিয়া দেন তবে তাঁহার নিদ্রার সুযোগ হইতে পারে, কিন্তু পাহারার কী সুবিধা হইবে জানি না।
কিন্তু পাহারা দিবার ভার যে জাগ্রত লোকটির হাতে পাহারা দিবার প্রণালীও তিনি স্থির করিবেন; সে সম্বন্ধে বিজ্ঞভাবে পরামর্শ দেওয়া আমার পক্ষে নিরতিশয় ধৃষ্টতা এবং সম্ভবত তাহা নিরাপদও নহে। অতএব মাতৃভাষায় আমার এই দুর্বল উদ্যমের মধ্যে সে দুশ্চেষ্টা নাই। তবে আমার এই ক্ষীণ ক্ষুদ্র ব্যর্থ অথচ বিপৎসংকুল বাচালতা কেন। সে কেবল প্রবলের ভয় দুর্বলের পক্ষে কী ভয়ংকর তাহা স্মরণ করিয়া।...
রহস্যই অনিশ্চিত ভয়ের প্রধান আশ্রয়স্থান, এবং প্রবল ব্যক্তির অনিশ্চিত ভয় দুর্বল ব্যক্তির নিশ্চিত মৃত্যু। রুদ্ধবাক সংবাদপত্রের মাঝখানে রহস্যান্ধকারে আচ্ছন্ন হইয়া থাকা আমাদের পক্ষে বড়োই ভয়ংকর অবস্থা। তাহাতে করিয়া আমাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপ রাজপুরুষদের চক্ষে সংশয়ান্ধকারে অত্যন্ত কৃষ্ণবর্ণ দেখাইবে। দুরপনেয় অবিশ্বাসে রাজদণ্ড উত্তরোত্তর খরধার হইয়া উঠিবে এবং প্রজার হৃদয় বিষাদে ভারাক্রান্ত ও নির্বাক নৈরাশ্যে বিষতিক্ত হইতে থাকিবে। আমরা ইংরাজের একান্ত অধীন প্রজা, কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম তাঁহার দাসত্ব করে না। আঘাত করিলে আমরা বেদনা পাইব; ইংরাজ হাজার চক্ষু রক্তবর্ণ করিলেও এ নিয়মটাকে দেশান্তরিত করিতে পারিবেন না। তাঁহারা রাগ করিয়া আঘাতের মাত্রা বাড়াইতে পারেন, কিন্তু বেদনার মাত্রাও সঙ্গে সঙ্গে বাড়িয়া উঠিবে। কারণ, সে বিধির নিয়ম; পিনাল-কোডে তাহার কোনো নিষেধ নাই। অন্তর্দাহ বাক্যে প্রকাশ না হইলে অন্তরে সঞ্চিত হইতে থাকে। সেইরূপ অস্বাস্থ্যকর অস্বাভাবিক অবস্থায় রাজাপ্রজার সম্বন্ধ যে কিরূপ বিকৃত হইবে তাহা কল্পনা করিয়া আমরা ভীত হইতেছি।
কিন্তু এই অনির্দিষ্ট সংশয়ের অবস্থা সর্বাপেক্ষা প্রধান অমঙ্গল নহে। আমাদের পক্ষে ইহা অপেক্ষা গুরুতর অশুভ আছে।
মানবচরিত্রের উপরে পরাধীনতার অবনতিকর ফল আছেই, তাহা আমরা ইংরাজের নিকট হইতেই শিখিয়াছি। অসত্যাচরণ কপটতা অধীন জাতির আত্মরক্ষার অস্ত্রস্বরূপ হইয়া তাহার আত্মসম্মানকে, তাহার মনুষ্যত্বকে নিশ্চিতরূপে নষ্ট করিয়া ফেলে। স্বাধীনতাপূজক ইংরাজ আপন প্রজাদিগের অধীন দশা হইতে সেই হীনতার কলঙ্ক যথাসম্ভব অপনয়ন করিয়া আমাদিগকে মনুষ্যত্বের শিক্ষা দিতে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। আমরা বিজিত তাঁহারা বিজেতা, আমরা দুর্বল তাঁহারা সবল, ইহা তাঁহারা পদে পদে স্মরণ করাইয়া রাখেন নাই। এতদূর পর্যন্তও ভুলিতে দিয়াছিলেন যে আমরা মনে করিয়াছিলাম, ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা আমাদের মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক অধিকার।
আজ সহসা জাগ্রত হইয়া দেখিতেছি, দুর্বলের কোনো অধিকারই নাই। আমরা যাহা মনুষ্যমাত্রেরই প্রাপ্য মনে করিয়াছিলাম তাহা দুর্বলের প্রতি প্রবলের স্বেচ্ছাধীন অনুগ্রহ মাত্র। আমি আজ যে এই সভাস্থলে দাঁড়াইয়া একটিমাত্র শব্দোচ্চারণ করিতেছি তাহাতে আমার মনুষ্যোচিত গর্বানুভব করিবার কোনো কারণ নাই। দোষ করিবার ও বিচার হইবার পূর্বেই যে আমি কারাগারের মধ্যে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত দেখিতেছি না তাহাতেও আমার কোনো গৌরব নাই।
ইহা এক হিসাবে সত্য। কিন্তু এই সত্য সর্বদা অনুভব করা রাজা প্রজা কাহারো পক্ষে হিতকর নহে। মনুষ্য অবস্থার পার্থক্যের মাঝখানে হৃদয়ের সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া, অসমানতার মধ্যেও নিজের মনুষ্যত্ব রক্ষার চেষ্টা করে।
শাসিত ও শাসনকর্তার মধ্যবর্তী শাসনশৃঙ্খলাটাতে সর্বদা ঝংকার না দিয়া, সেটাকে আত্মীয়সম্বন্ধবন্ধনরূপে ঢাকিয়া রাখিলে অধীন জাতির ভার লাঘব হয়।...
এই শাসনকার্যের উপর যখন প্রধানত আমাদের সুখদুঃখ আমাদের শুভ-অশুভ নির্ভর করিতেছে,তখন তাহার সহিত আমাদের কোনো মন্তব্য কোনো বক্তব্য কোনো কর্তব্যবন্ধনের যোগ না থাকিলে আমাদের দীনতা আমাদের হীনতার আর অবধি থাকে না। বিশেষত আমরা ইংরাজি বিদ্যালয়ে শিক্ষা পাইয়াছি, ইংরাজি সাহিত্য হইতে ইংরাজ কর্মবীরগণের দৃষ্টান্ত আমাদের অন্তঃকরণের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সর্বপ্রকার ব্যাপারেই নিজের শুভসাধনে আমাদের নিজের স্বাধীন অধিকার থাকার যে পরম গৌরব তাহা আমরা অনুভব করিয়াছি। আজ যদি অকস্মাৎ আমরা সেই ভাবপ্রকাশের স্বাধীনতা হইতে বঞ্চিত হই, রাজকার্যচালনার সহিত আমাদের সমালোচনার ক্ষুদ্র সম্বন্ধটুকুও এক আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়, এবং হয় আমরা নিশ্চেষ্ট উদাসীনতার মধ্যে নিমগ্ন হইয়া থাকি নয় কপটতা ও মিথ্যা বাক্যের দ্বারা প্রবলতার রাজপদতলে আপন মনুষ্যত্বকে সম্পূর্ণ বলিদান করি, তবে পরাধীনতার সমস্ত হীনতার সঙ্গে উচ্চশিক্ষাপ্রাপ্ত আকাঙ্ক্ষার বাক্যহীন ব্যর্থ বেদনা মিশ্রিত হইয়া আমাদের দুর্দশা পরাকাষ্ঠাপ্রাপ্ত হইবে; যে সম্বন্ধের মধ্যে আদানপ্রদানের একটি সংকীর্ণ পথ খোলা ছিল, ভয় আসিয়া সে পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইবে; রাজার প্রতি প্রজার সে ভয় গৌরবের নহে, এবং প্রজার প্রতি রাজার সে ভয় ততোধিক শোচনীয়।
এই মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতাবরণ উত্তোলন করিয়া লইলে আমাদের পরাধীনতার সমস্ত কঠিন কঙ্কাল এক মূহূর্তে বাহির হইয়া পড়িবে। আজকালকার কোনো কোনো জবর্‌দস্ত ইংরাজ লেখক বলেন, যাহা সত্য তাহা অনাবৃত হইয়া থাকাই ভালো। কিন্তু, আমরা জিজ্ঞাসা করি, ইংরাজ-শাসনে এই কঠিন শুষ্ক পরাধীনতার কঙ্কালই কি একমাত্র সত্য, ইহার উপরে জীবনের লাবণ্যের যে আবরণ, স্বাধীন গতিভঙ্গির যে বিচিত্র লীলা, মনোহর শ্রী অর্পণ করিয়াছিল তাহাই কি মিথ্যা, তাহাই কি মায়া"!





রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কণ্ঠরোধ, (সিডিশন-বিল পাস হইবার পূর্বদিনে টাউনহলে পঠিত)


সম্পাদকীয় দপ্তর- বেবী সাউ মণিশংকর বিশ্বাস সন্দীপন চক্রবর্তী
                            হিন্দোল ভট্টাচার্য শমীক ঘোষ


যোগাযোগ  ও লেখা পাঠানোর ঠিকানা - abahaman.magazine@gmail.com



লেখা পাঠাবেন অভ্রতে। মেল বডিতে পেস্ট করে অথবা ওয়ার্ড ফাইলে। কবিতা কমপক্ষে পাঁচটি পাঠাবেন। আমন্ত্রিত লেখাও অনুমোদনযোগ্য। প্রেরিত লেখা প্রকাশ পাবে কিনা, তা আমরাই মেল করে জানিয়ে দেব। অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে দুই মাস। অনুবাদ পাঠালে মূল কবিতাও পাঠাতে হবে। কোনও লেখার কোনও শব্দসীমা নেই। 

ফিরে পড়া কবিতা- সুব্রত চক্রবর্তী



যেতে চাই

বৃষ্টির ভেতর ঐ জবাগাছ, আমি তার ক্ষমা ও সারল্যে
যেতে চাই- এই ঘর, ভূতে-পাওয়া সারাদিন,বিছানা ও কাঠের টেবিল,
নষ্ট মোম,আধখোলা কলমের নিস্তব্ধতা ছেড়ে
চলে যাবো।বৃষ্টির ভেতরে ঐ জবাগাছ আমাকে ডেকেছে
সুখী ফুলে, পাতার আনন্দে। ম্লান এই ঘর, এই যে জীবন,
থেঁতো দিন,ভূতগ্রস্ত শব্দগুলি,চাদর ও নিঃসঙ্গ টেবিল,
ক্ষয়া মোম, ঠান্ডা , মৃত খরখরে কাগজ ...
সব ছেড়ে, বৃষ্টির ভেতরে ঐ জবাগাছ, আমি তার সহজ সরল
ব্যর্থতায় চলে যেতে চাই ।

সামান্য মানুষের গল্প

সকলে ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরে- একজন কখনো ফেরে না।
অনন্ত প্রবাস তার নদীতীরে, সমাধিভূমির ভাঙা মর্মর ছায়ায় ...
অনন্ত প্রবাস তার অবিশ্বাসে, দুঃখে-সুখে , যুদ্ধহীন জয়ে-পরাজয়ে ...
সকলে ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরে- একজন কখনো ফেরে না ।

আজন্ম-বিদেশী ঐ মানুষের পুরোনো রুমালে
কোনো করস্পর্শ নেই,স্মৃতি নেই,নেই কোনো রঙিন অক্ষর ।

মানুষ ছুটির শেষে ঘরে ফেরে নিয়ে কত মজার পুতুল,
ভ্রমণকাহিনী,ফোটো,মোহময় গন্ধে ভরা উলের মাফলার 

একজন সামান্য লোক ঘরে থাকে,একা-একা , নিজের ম ন;
অনন্ত প্রবাস তার এই ঘর 
এই ঘরে ঝর্নাশব্দ ভেসে আসে , ছায়া দেয় দীর্ঘ শাল,ওঁরাও যুবতী
গান গায় খিন্নস্বরে।এই ঘরে সে কি বন্দী! পর্যটক নয়!


হাঁস ও বালক

উড়ে যায় হাঁস; তার চিরমায়াময়তার দিকে
নির্নিমেষ চেয়ে থেকে বালকের দুটি চোখ হয়ে যায় হাঁস !
ভাসমান পালকের নেমে আসা ,
নীলিমায় ভেসে যাওয়া তার -
বিকেলের শান্ত রোদে এইসব দেখেছে বালক ।

চঞ্চল হাঁসের দিকে চেয়ে থেকে ওর বড় অভিমান হয় 
জলের চলাৎ শব্দ বুক ভেঙে উঠে আসে;
জাহাজের ভাসন্ত কেবিনে
বালক ঘুমিয়ে থাকে-
আচ্ছন্ন পালকগুলি সারারাত স্বপ্নে স্বপ্নে ঝরে !

উড়ন্ত হাঁসের দিকে চেয়ে থেকে বালকের শোক হয়;
      যা-কিছু নির্জন,
      যা-কিছু অতীত,ঝাপসা,
পাহাড়তলীর ছায়া,চিত্রিত পাথর 
নিঃশব্দ জলের টানে ভেসে যায় সবকিছু;
     গোধূলিবেলায় শুধু ঘন হয়
     ব্রতচারী হাঁসের আকাশ ।।

প্রেম

শিবানীর প্রেম এসে ছুঁয়েছিলো শিবানীর মাকে
একদিন । শিবানীর মা কি জানে এই কথা, শিবানী কি জানে!
উজ্জ্বল শাড়ির পাড়ে লেগে আছে অভ্রকণা- শিবানীর মা
একা-একা হেঁটে যান  নিচু চোখে; আর দূরে, ধবল শামপানে

শিবানী ভ্রমণ করে। দীর্ঘ,খর ,চেরা জিভে চেটে খায়
                                                       কুয়াশার জল ...
এই তার ভালবাসা,এই তার তৃষ্ণা নিবারণ ।
শিবানীর মা কি জানে অতশত!... চিবুকের নিচে,
শিথিল খোঁপায় তার কুয়াশা নিবিড় হয়,
                                 উজ্জ্বল শাড়ির পাড়ে ঝোলে অভ্রকণা।

শিকড়ে ছেয়েছে দেহ

বয়স বেড়েছে নাকি! লতা-গুল্ম ছেয়েছে শরীর ।
রক্তের ফেনায় পাই টের
শিকড়ের নড়াচড়া,শিকড়ের আড়াআড়ি টান ...
অতল ঘূর্ণির দিকে ছুটে যায় রক্তস্রোত,করজোড়ে যায় ।

খসে ত্বক, উড়ে যায় সাবলীল; বাতাসের নুনে
ধাতুর মূর্তিতে জং ধরে আজ। ধাতুর নিষ্পাপ
শিশুটি ভেঙেছে ঐ! ওকে ডাকো, টেনে নাও বুকে-
আহারে, তোমার দিকে নুলো হাত তুলে ধরে ও যে !

শিকড়ে ছেয়েছে দেহ-ফাটে হাড়, নুয়েছে কাঁকাল ...
বয়স হয়েছে নাকি!বহমান রক্তে পাই টের
লতা-গুল্মের করতালি,লতা-গুল্মে আড়াআড়ি টান ...
শীতল ঘূর্ণির দিকে ভেসে যায় উজ্জ্বলতা,সফলতা যায় ।।


বালিকা

-১-

বৃষ্টির ভেতরে ঐ ধবল পোষাক পরে বালিকার ছুটে যাওয়া
আমাকে এমন
নিঃসঙ্গ করেছে। ...চেয়ে দেখি তুমুল বৃষ্টিতে
স্তব্ধ বাড়ি,জবাগাছ,ঘুমন্ত কবর ...

অনন্ত বৃষ্টিতে ভেজে দিগবলয়, লাল পথ,প্রসারিত হাত;
একটি মহিষ ভেজে,সমাধিফলক ভেজে। ...আর ঐ বৃষ্টির ভেতরে
চকিত পাখির মতো- দূর থেকে আরো দূরে-
উড়ে যায় শৈশবের ধবল পোষাক ।

-২-

বালিকা তার দুঃখে আছে,বালিকা তার সুখে
মধ্যরাতে বালিকা তার নিদ্রাহারা বুকে
মুখ রেখেছে;ঘুমে তখন চোখ জড়িয়ে আসে ...
একটি-দুটি পাখি ওড়ে বুকের আশেপাশে ।
কেউ কি জানে ঐ মানুষের বুকে দারুণ খরা-
বালিকা তাই অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়ে ঝরে !

শিশুটি জানে না

উজ্জ্বল শিশুটি, একা, কাগজের নৌকাখানি ভাসিয়েছে জলে;
শুধু এই দৃশ্য দেখে জবুথবু কঠিন বয়স
জলের কল্লোল শব্দে ভরে যায়। সাবলীল জলের রেখায়
কেঁপে ওঠে সব কিছু-নীরবতা,সুখ-দুঃখ,দূরদূরান্তর ...

কাগজের নৌকাখানি অন্ধকারে ডুবে যায়,শিশুটি এখন
ঘুমিয়ে রয়েছে ঐ... ঘুমন্ত বুকের কাছে
                                      মুখ এনে,সহসা শুনেছি
মাল্লার বিরহগান, দাঁড়ের সজল শব্দ-জ্বলন্ত গলুই
ভেসে যাচ্ছে রক্তস্রোত ...
রক্তের কল্লোল শব্দে জেগে আছে মধ্যরাত,শিশুটি জানে না ।।

বালক জানে না

আকাশ যে নীল নয়- পাখি জানে,ঘুড়ি কিছু জানে
দু  হাতে লাটাই ধরে যে বালক সারাবেলা মাঠে-মাঠে ঘোরে
যে জানে আকাশ নীল,তার দুটি দীর্ঘ চোখে ভেসে থাকে ম্লান-জলকণা ।

জলের ভিতরে ঐ,আমাদের বালক-বয়স ...
ঘুরন্ত লাটাই হাতে,একা-একা,সারাবেলা আকাশের দিকে
চেয়ে থাকে।আকাশ যে নীল নয়,ঘুড়ি জানে,পাখি জানে-বালক জানে না ।




তিনি

মাটির অনেক নিচে,আমার স্নানের জন্য
                 ঠান্ডা জল মজুত রয়েছে-
      তিনি রেখেছেন ।
     তিনি সর্বশক্তিমান ,
                 তাঁর শান্ত চোখের ইঙ্গিতে
ব্জ্র ও বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি নামে রাঢের খরায় ।

মাঝরাতে ফেরিঘাটে শোনা যায় মন্দ্র কন্ঠস্বর;
                চলে আয়,
                        চলে আয় ওরে-
জোছনায় রূপোলী জলে গাল রেখে শুয়ে আছে
               তাঁর দীর্ঘ ছায়া ।

কারুকার্যময় দুটি চোখ থেকে জল পড়ে;
              কতদিন সঙ্গিহীন আছি।
চলে আয়,চলে আয় ওরে-
অনন্ত জলের নিচে, ঘর বেঁধে নিঃসঙ্গ দুজনে,
              সুখে থাকা যাবে।

তিনি সর্বশক্তিমান-এতো অনুনয় তাই,
              তাঁকেই মানায় ।

রাজতন্ত্র

উড়িয়ে-পুড়িয়ে দিয়ে সব কিছু এখানে এলাম
সধবা নারীর পাশে-রক্তাক্ত বালুকারাশি ঝরে
উন্মুক্ত দু হাত থেকে-গিরিখাদে শাদা কুজঝটিকা
থেমে আছে... থেমে আছে পরাজয়,অবহেলা।ঔদাস্যজটিল
কোন খেলা এইখানে।লাফায় অস্থির জল পাথরে পাথরে ...

এখানে এলাম ফিরে,নষ্ট করে দিয়ে সব সাফল্য প্রয়াস;
সন্ধ্যার বাতাসে ওড়ে নাবিকের ছেঁড়া টুপি! নারী,
তোমার সীমান্ত দেখে মনে পড়ে রাজতন্ত্র । মনে পড়ে,অক্ষরসংগতি
আমাদের ছিল যেন-যেন ছিল ভূতাবেশ,সহনশীলতা ...

শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ কোন খেলা ! ভাঙে জল পাথরে পাথরে ...                          


আমি নই

আমার ভিতরে কেউ স্বপ্ন দেখে। আমি নই,
                   আমারই মতন আর কেউ ।
আমি ওকে কোনো দিন তেমন চিনি না ...
একদিন ওকে যেন কেউ কেউ দেখেছিল নদীতীরে,একা ।
একদিন ওকে যেন কেউ কেউ দেখেছিল ভাঙা দুর্গে ,একা ।
নিশীথবেলায় ওকে কেউ কেউ দেখেছিল
                   কলকাতার পথ থেকে পথে
                         নিচুচোখে হেঁটে যেতে ...
ওর ঐ দুটি চোখ আমি যেন ফুলের রহস্যে
              ভেসে যেতে দেখেছি একদিন ।
       ভেসে যায়, ফিরে আসে ;
  ভেসে যায়, ফিরে আসে 
       ভেসে যায়-ফিরে ফিরে আসে
ঐ দুটি শাদা চোখ, আর তার চিরস্বপ্নে ভরে যায় সমস্ত জীবন ।


কবির মৃত্যু

অদ্ভুত শূণ্যতা এসে আমাদের ভারি জব্দ করে;
যেন সে শূন্যতা নয়, যেন তার টানা ও পোড়েনে
কবেকার অভিলাষ,পদচ্ছাপ,দন্ডিত কাপাস
স্তুপাকার হয়ে আছে। মাঝে-মাঝে গোপণ দর্পণে
জেগে ওঠে বনাঞ্চল,নদীতীর,খেয়াপারাপার ...

নিস্পৃহ কাচের স্পর্শে আমাদের খর্বুটে আঙুলে
বিপুল কামনা এসে জড়ো হয়।বিদায়কালীন
সঘন চোখের কথা মনে পড়ে।সহসা শূণ্যতা...
আগুনের অন্ধকারে চলে যান পিছুটানহীন,
তৃপ্তি ও অতৃপ্তিহীন,সঙ্গিহারা;শুধু পড়ে থাকে
উজ্জ্বল তিমির,ঢেউ,পদচিহ্ন,রক্তাক্ত মর্মর-
অদ্ভুত শূণ্যতা তাঁর আমাদের ভারি জব্দ করে,
যেন সে ভরাট কিছু, আছে যার টানা ও পোড়েন ।                                                             

বিবিজানের তাঁবেদারি

অতর্কিতে বাহান্নটা তাস
মেলে ধরলে প্রজাপতির রঙ;
নেশার ঝোঁকে ছুঁতে গেলাম যেই
জোড়াসাঁকোর ভুরুর ভাঁজে ওঁ ।

কোথায় তাস, কোথায় প্রজাপতি-
তুমিই একা হরতনের বিবি;
হো হো হাসির দমকে মহীয়সী-
ঝলসে ওঠে মম্মোহিনী নীবি।

গলায় রাখ সাপের মতো হাত,
দৃশ্যপটে ভানুমতীর খেল;
আলিঙ্গনে কোথায় টেনে নিলে
জলসাঘরে পাগল মাইফেল ।
বাহান্নটা ফুলের তোড়া যেন,
দু হাত জুড়ে বাহান্নটা তাস ;
তার আড়ালে তোমার মুখরেখা,
তার আড়ালে আমার সর্বনাশ ।

মধ্যবয়সের রাত্রি

রাত কত!চারিদিকে কম্পমান পাতার মর্মরে
গাছের গভীর দুঃখ সাড়া দেয়!...মৃত্যুহীন,জন্মান্তরহীন
                            একটি ধূসর মথ বসে থাকে নিঃসঙ্গ টেবিলে ।
স্বপ্নের নিষ্পন্ন শিশু ঘুমিয়ে রয়েছে পাশে;
                            ওর বুকে হাত রাখি,
                            টের পাই আরতি ও রক্ত চলাচল ...
আর দূরে,আলোকিত মাঠ থেকে মৃত শিশু ডাকে,তার
                            দুটি চোখে পাথরের টান ।

রাতের নির্সগ থেকে ঝরে যায় নষ্টবীজ,
                            ঝরে যায় শামকূট পাখির পালক ।
     স্বপ্ন থেকে,পরিত্রাণ থেকে
শৈশবের চিরবৃষ্টি,সারারাত ঝরে যায় ক্ষয়া-মোমে,
                            মলিন টেবিলে ।

নিষ্পন্দ মথের কাছে আড়াআড়ি দুটি হাত;
                            রাত কত!
     চারিদিকে পাতার মর্মরে
গাছের গভীর শান্তি সাড়া দেয়; দূরে
                            স্মৃতিফলকের কাছে উদাসীন শঙ্খ বাজে,


                                    উড়ে যায় ঠান্ডা,শাদা চাঁদ ।

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...