খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

8.7.18

ধারাবাহিক- সর্বজিৎ সরকার








                        এসো মন্থরতা, এসো অন্তরতর সুরে

আরো একটু ধীরে চলো বরং। মন্থরতা আসুক, সচেতনে। সমুদ্রনাভি থেকে উঠে আসা, প্রলয়ের আগের, স্তব্ধতার মত।
ভুলে যাও বরং তারা তোমায় বলেছিলো আরো দ্রুত চলতে। গতি বাড়াতে। আরো অনেক বেশি গতি বাড়াতে। গতি বাড়াও, গতি বাড়াও। এত বাড়াও  যেখানে নিজের ঘূর্ণন নিজেই তুমি টের পাবেনা। এতটা বেশি যেখানে তোমার চারপাশ আর তুমি নিজেও তোমার চোখের সামনে থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। যেখানে তুমি নিজেই তোমার ঝাপসা হয়ে আসা ছবি। একটা ধূসর পাণ্ডুলিপি যেন। সময় ছুঁয়ে দিয়ে গেছে তোমায়। হলুদ আর ছোপছোপ খয়েরী পাতা। তাতে কয়েকটা আঁচড়ের দাগ। হারিয়ে যাওয়া অক্ষরপথ। চির নৈঃশব্দের দেশ।
অথচ, তুমি এসব কিছুই করলে না। শুনলে না তাদের কথা। গতি আরও না বাড়িয়ে, মন্থর করে তুললে নিজের গমন। নিজের চলা। অন্তর পথ।
এখন, এখানে একটি জলের ফোঁটা জলের বুকে পড়ে। সেই জলবিন্দুর পতন ধ্বনি ক্রমাগত এই আঁধার বাতাসে অনুরণিত হওয়ার আগেই দ্বিতীয় তৃতীয় চতুর্থ এবং এভাবেই পরপর জলের বিন্দু নীচে পড়তে থাকে। একটির থেকে অন্যটির পতনের দূরত্ব, তাদের মধ্যবর্তী সময়সম্পর্ক যেন মাপা। নির্দিষ্ট।
আর যেহেতু চারপাশ সম্পূর্ণ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে, তাই এই দৃশ্যে সেই পতনধ্বনি একটানা, কিছুটা বা একঘেয়ে এক সুর তোলে।
পায়ের নীচে জল, কাদা, জায়গায় জায়গায় ভাঙ্গাচোরা গর্ত। চারপাশটা একবার তাকিয়ে দেখলে। আলো অন্ধকারের ভিতর মনে হল কয়েকটা খিলান যেন দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ওপারে কী আছে দেখা যাচ্ছেনা স্পষ্ট। অসচ্ছ কুয়াশার মোড়ক যেন ঢেকে আছে তাদের। আর তোমাকেও। মাঝে মাঝে কোথা থেকে ধোঁয়া উঠে এসে বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে ফের। জল পড়ার শব্দ। একটা ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি। একটানা, একঘেয়ে, একটা ছন্দ। নিমেষে তোমার মনে হল, এও একটা সুর। একটা তাল। কিন্তু কী ভাবে যেন বেঁধে ফেলেছে তোমায়! প্রবল এক নিগড়। যেন হাত পা বাঁধা। পড়ে আছো এক জায়াগায়। চাইলেও বেরোতে পারছো না সেখান থেকে।
 “সিনেমায় মিউজিক আমার কাছে তখনই গ্রহণযোগ্য যখন সেটা একটা গানের ধুয়ার মত আসে। ঠিক কবিতায় যেমন। কবিতায় একই বাক্যের দুবার ব্যবহার, একটা ধুয়া তোলে, আর আমাদের ফিরিয়ে আনে সেই উৎসের কাছে যেখান থেকে এই কবিতাটি জন্ম নিয়েছিল। সুরের এই পুনরাবৃত্তি আমাদের ওই মুহূর্তের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। আবার একইসাথে সেই মুহূর্তটিকে আজ, এখন, এই মুহূর্তের অংশ করে তোলে। আর এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে ওই সুরটি সেই মুহূর্তকে আর একবার নতুন করে সৃষ্টি করে”। (স্কাল্পটিং ইন টাইম/তারকোভস্কি)

তো তুমি মন্থর করে তুলেছো তোমার চলা। আর ধীরে হাঁটছো বলেই চারপাশের সবকিছু, সব জড় ও অজড় বস্তুপুঞ্জ, সব বায়ু ও আলোককণিকা, সব অন্ধকার আর তাদের রহস্য, তাদের সকলের না বলা কথা নিয়ে জড়ো হচ্ছে তোমার পাশে। সেই সব অব্যক্ত কথার মধ্যে যেন অস্ফুট সব সুর এই প্রথম ভেসে উঠছে তোমার শ্রবণে। সেই সুর তোমার কিছু অচেনা। কিছু আধোচেনা। এত মিহিন, এত অস্পষ্ট সেই সুর, যে প্রায় কিছুই শুনতে পাওনা তুমি প্রথমে। যেন বহু বহুদূর থেকে ভেসে আসছে। জল পড়ার এই একঘেয়ে ধ্বনির সাথে মিশে, খুব ধীরে ধীরে, প্রবেশ করছে। ছড়িয়ে পড়ছে তার শিরায়, শিকড়ে।
স্টকার এর সেই দৃশ্যটির কথা মনে পড়ছে তোমার? সেই যেখানে স্টকার আর তার দুই সঙ্গী, লেখক আর প্রফেসর, ট্রলিতে বসে পরিত্যক্ত রেল লাইনের ওপর দিয়ে সেই রহস্যময় ‘জোন’-এর দিকে এগোচ্ছেন। দুপাশে ভাঙাচোরা রেল ইয়ার্ড সরে সরে যাচ্ছে। চারপাশে পুরনো মেশিনের স্তুপ। জং ধরা, ক্ষয়ে যাওয়া। পুরো পর্দা জুড়ে শুধু এই তিনজনের মুখ। এক একবার এক একজনের প্রতিক্রিয়া ধরা পড়ছে। প্রত্যেকের মুখে এক অজানা আশঙ্কা। ভয়। উৎকন্ঠা।

লেখক তাকিয়ে আছেন পিছনের দিকে। প্রফেসর একবার সামনে দেখছেন, একবার পিছনে। স্টকার, উৎকন্ঠিত, কিন্তু সরাসরি তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। যেন সম্মোহিত। ওই অজানা জোন তাকে কোনও জাদুবলে যেন তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। লোকে বলে সেখানে পৌঁছোলে সব আকাঙ্খা সফল হয়। লোকে এও বলে যে সেখান থেকে কেউ ফিরে আসেনা। বিপ্ননতার এই স্বভূমি তাকে টানছে। তাকে আর তার দুই সঙ্গীকে। তাদের প্রত্যকের আসার কারণ আলাদা। ভিন্ন তাদের চাওয়া। তবু তারা সকলেই নিজেদের সব কিছুকে বাজী রেখেছে শুধু এই বিপজ্জনক জোনে যাবে বলে।
ক্যামেরা এদের মুখের ভাব এক নিবিষ্ঠে অনুসরণ করতে থাকে।
লেখক হয়ত ভাবছেন তার ফেলে আসা জীবন, তার অতীত, তার সামাজিক অস্তিত্বের কথা। প্রফেসর হয়ত ওই ফেলে আসা পৃথিবী আর অনাগত দেশের মাঝে দ্বিধাগ্রস্থ।
স্টকার হয়ত তার বিপর্যস্ত সংসার আর পরিবারের কথা কিছুই মনে করতে পারছে না। সে শুধু সামনের দিকে চেয়ে থাকে।
তাদের মুখের পাশ দিয়ে আমরা দেখি দুপাশের পরিত্যক্ত রেল ইয়ার্ড শুধু সরে সরে যায়।
প্রত্যেকের মুখের ওপর ক্যামেরা ক্লোজ করে থাকে বলে, মনে হয় যেন মুখগুলি স্থির হয়ে আছে। আর পিছনের দৃশ্যপট গতিশীল। যেন চলছে। যেন সময়। সাথে চলে, পিছনে সরে যায়। কে কাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে, কে কাকে ছেড়ে যাচ্ছে বোঝা যায়না। সময় আমাদের? না কি, আমরা সময়কে? আর এই পুরো ভ্রমণপথে একটাই রঙ লেগে থাকে। সে রঙ জীর্ণতার। ক্ষয়ের। নষ্ট হয়ে মরচে ধরে যাওয়া লোহার রঙ। সে রঙ সিপিয়া।
এক পরিচিত ভুবন ছেড়ে অন্য এক অচেনা বিপজ্জনক ভুবনে চলে যাওয়া। এক সময় কে অতিক্রম করে অন্য এক সময়ে পাড়ি দেওয়া। এক চেনা জীবন কে ফেলে রেখে অন্য এক কুহকী জীবনের টানে এগিয়ে চলা। কোনটা বাস্তব। কোনটাই বা বিভ্রম। কোনটা সত্যি। আর কোনটাই বা মিথ্যা, আমরা কেউ জানিনা। আমাদের কিছু নেই, শুধু এই যাত্রাটুকু আছে। শুধু এই চলাটুকুই যা সত্য। বিপন্ন, পতনশীল, জুয়াড়ির সত্য।
আর ঠিক এখনই, দু পকেটে দুই হাত রেখে, এক মাথা এলোমেলো চুল ঝাঁকিয়ে, তারকোভস্কি বলেন,
‘হ্যাঁ, এ কথা সত্যি যে জুডাস তাঁকে বিক্রী করে দিয়েছিলেন।
কিন্তু কে কিনেছিলো তাঁকে?
জনগণ। হ্যাঁ, জনগণ। কিন্তু জনগণ তো সরল, বোধহীন। ভুল করে, হ্যাঁ ভুল করে, কিন্তু না জেনে, না বুঝেই।
আর যারা এই বেচাকেনায় মদত দিয়েছিলো, সেইসব স্ক্রাইব, সেই ফারিসীস যারা, তারা কিন্তু শিক্ষিত, জ্ঞানী, প্রবঞ্চক। তারা জানতো কি ভাবে লোককে ঠকিয়ে কি ভাবে ক্ষমতা করায়ত্ত করতে হয়।
তাহলে...
তাহলে এটা তো সব সময়েই সম্ভব যে, কেউ না কেউ, শিক্ষিত, বিদ্বান, জ্ঞানী, ক্ষমতাবান কেউ, আমাদের যে কোনও সময়ে বেচে দিতেই পারে।
তাহলে আমরা যারা বুঝি না, সময়ে সময়ে ভুল করি, সরল মনে বিশ্বাস করি, বিপথে যাই, কী করবো?
নিজেদের ক্রুশ আমরা নিজেরাই বহন করবো। সব হারিয়ে। সব ছেড়ে। দিশাহারা না হয়ে। নীরবে। শুধু এ কথা বলার জন্য যে, অন্তত এই শক্তিটুকু যেন না হারায়’।

পয়েন্ট-কাউন্টারপয়েন্ট। মুখোমুখি দুটি দৃষ্টিবিন্দু। দুটি বিপরীত সুর। এক অনিবার্য্য দ্বন্দ্ব আর সংঘাত। এক ডুয়েল যেন। এক চূড়ান্ত মুহূর্ত যা একে অন্যের প্রতিস্পর্ধী। 
আর একবার ফিরে আসি স্টকার এর ওই দৃশ্যে? তারকোভস্কি তাঁর সব ছবিতেই প্রায় এই কনট্রাপুনটাল দৃশ্য ও সুরকে ফিরিয়ে আনেন। যেন একটি দৃশ্য অন্য একটি দৃশ্যের সামনে দাঁড়াচ্ছে। মুখোমুখি হচ্ছে। তারপর একটি অন্যটির মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। অথবা দ্বিতীয়টির মধ্যে দিয়ে প্রতিসরিত হচ্ছে প্রথমটি।
এই যে দুটি ভিন্ন সুরের মুখোমুখি হওয়া, এবং তারপর একে অন্যের মধ্যে মিশে যাওয়া, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ভাষায় একে বলি, fugue। এই শতকের শিল্প সাহিত্য এবং আরও একটু বড় করে ভাবলে, আমাদের জীবন, আরও বেশি করে এই fugue কে অবলম্বন করবে নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য। জোনের দিকে যাওয়ার ওই দৃশ্যে, খেয়াল করো, একটা চাকার ধ্বনি ক্রমাগত শুনতে পাবে। যে ট্রলি চেপে স্টকার আর তার সঙ্গীরা যাচ্ছে, এটা সেই চাকার একঘেয়ে শব্দ। একটানা। একঘেয়ে। আর তারপর, খুব ধীরে, শান্ত এক ধ্বনি শোনা যায়। একটা বাঁশি বেজে উঠছে। কোথা থেকে, কোন দিগন্ত থেকে সে আসছে, স্পষ্ট বোঝা যায়না। আর তার সাথে কোনও তারযন্ত্র। বাজছে...বেজে চলেছে...এক আর্ত, করুণ, বিরহী অথচ এক মায়াবী সুরে। আস্তে আস্তে সেই বাঁশির ধ্বনি বাড়তে থাকে। সুর ক্রমশ স্পষ্ট হয়। চাকার যান্ত্রিক ধ্বনিকে সেই বাঁশির সুর একসময় সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলে। আমার মনে পড়ে তারকোভস্কি’র সেই কথাটা,
‘এই পৃথিবীর অন্তর্গত যে ধ্বনি, তারা নিজেরাই এত সুন্দর, যে আমরা যদি শুধু তাদেরকেই শুনতে শিখি, তাহলেই জানতে পারবো যে, এই পৃথিবী, এই জীবন, সবকিছুই, আসলে একই সুরে কথা বলে’।

হাইওয়ে তো দ্রুত চলে যাওয়া গাড়ি। চাকার কর্কশ আওয়াজ। হর্নের আর্তনাদ। সাইরেন দিতে দিতে একটা ভয়ার্ত আম্বুলেন্সের ছুটে যাওয়া। এসব পেরিয়ে, ঘাসের আদরমাখা শেষ বিকেলের রোদ্দুরে পা ফেলে ফেলে, ধীরে এসো বরং। এসো মন্থরতায়। এসো ঝরা পাতার পথে। সেখানে একটি বিষন্ন জেটির পাশে শান্ত ঢেউ তোলা জল। সেই জলে সূর্যাস্তের আকাশ তার ঠোঁট ছুঁয়ে আছে। তাদের পাশে কয়েকটি ক্লান্ত স্পীডবোট। অলৌকিক জলযান সব। ঘাটে বাঁধা। আর তখন,শোনো, কিভাবে সব কর্কশ আওয়াজ মুছে দিয়ে, গোধূলীর ওই ওষ্ঠছোঁয়া ঢেউ ঝাঁপিয়ে পরছে তাদের গায়ে, আর সুর তুলছে, ছলাৎ ছল...ছলাৎ ছল...ছলাৎ ছল...

(ক্রমশ)








2 comments:

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...