খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ- ঈশানী বসাক

ক্রোড়পত্র



আমাদের বনলতারা




আজ থেকে সত্তর বছর পূর্বে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল। উত্তর কলকাতার খড়খড়ির আড়ালে বাঙালীবাবুরা শুনতে পেতেন , " ফ্যান দাও বাবা ফ্যান দাও"। তবে দুর্ভিক্ষ বেশ মনের মতো করে সাজিয়েছিল সরকার। ট্রাক বোঝাই চাল খোলা মাঠে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে ফেলে রাখত। ভরা বর্ষায় চাল পচে গেল। টু নেশন থিওরির উত্তেজনা মানুষের কপালের শিরায় দপ দপ করছে। বাংলা সাহিত্যে তার প্রভূত প্রভাব পড়েছিল। প্রতিষ্ঠান এসে গেছিল লেখালেখির জগতে। সোজা কথা , যা দেখছি তাই বলার মতামত আর যা দেখছি তাকে অনন্য পদ্যময় ভাষায় সাজানোর বিরূদ্ধ মতামত প্রদান প্রসঙ্গে একটা কোল্ড ওয়ার চালু হয়েছিল। সবে দেড় হাজার বছরের বাংলা সাহিত্যে যা এখনো পেরোতে পারেনি টিন এজ সেখানে সেই আহ্লাদি শিশুকে বাজারের ফুসলানো কম্পোজিশনে না টানাই ভালো। সবুজ পাথরের গাছপালারা এর থেকে মাথা নুয়ে বাজে ঝলসে যাওয়ার প্রার্থনা করছিল। সাহিত্য আর সমুদ্র তারা সীমাহীন। আমাদের ক্ষুদ্র জগত সেখানে এসে দেখে নেয় লাল কাঁকড়া , ঝাউগাছ, বালির অন্ধকার আর ফুজিরঙের হোলিখেলায় সাজানো সমুদ্রপারের সূর্যের দিনরাত্রি। আপামর পাঠককে তাই কফিশপ , হাত ধরা , রোদ , মেঘ আর বৃষ্টির এক দৃষ্টি ভঙ্গিমায় নিবদ্ধ না করে একটা অন্য দৃষ্টিভঙ্গি দেওয়া উচিত।
আমাদের কবিতাগুলো তো সেসব মায়েদের কথা বলে না যারা সরষের বালিশে শিশুকে শুইয়ে মাথা গোল করেন। সেই চুরি করে খাওয়া খেজুর রস বেলা করে খাওয়ার ফলের কথা কেউ বলে না। নাক টিকালো করার জন্য সর্ষের তেলের মালিশ কিংবা লালকমল আর নীলকমলের রাক্ষসদের হারানোর গল্পের কথা। তবুও কেউ কেউ বলেন পাহাড়ি হাওয়া যা শিস খুঁজে আনে। সমাবর্তনে পাওয়া মিষ্টির বাক্সের বাড়িঘর ভেঙ্গে ফেলেন যিনি। ভাবেন এমন একটা ছাদের সিঁড়ি হবে যা দেখে শিশুরা ভাববে এ হলো আকাশের দরজা। তিনি মণীন্দ্র গুপ্ত , সবার আড়ালে থেকে বলে ওঠেন ," আমার নিজের বাড়ি কেমন হবে সে কথা ভাববার সময় আজ পেরিয়ে গেছে।" মাত্রা ছন্দের কনশাসনেস আনতে গিয়ে কবিতাকে এ কে সাতচল্লিশে হত্যা করার ঘোর বিরোধী ছিলেন তিনি। টিকোলো নাক আর ধানের শিষ মিলেমিশে খোলা মাঠে আরুণির মতো দাঁড়িয়ে আছে গুরুর অপেক্ষায়। তুচ্ছকে এড়িয়ে সাহিত্য হয় না, ভেক স্বীকৃতির পদক লাভ হয় তা চোখের সামনে তুলে ধরেছিলেন তিনি। বলেছিলেন মানুষের জীবনে যেমন গার্হস্থ্য আর সন্ন্যাস দুয়ের গুরুত্ব আছে একটা লেখার জীবনেও ব্রহ্মচর্যের প্রয়োজন আছে। অনায়াসে বলেছিলেন অক্ষয় মালবেরির দ্বিতীয় পর্বে -" শরীর কি বস্তু সেই যৌবনে টের পেয়েছিলাম , আর এখন বার্ধক্যে টের পাই , নদীকে মাঝিরা যেমন টের পায় জোয়ার আর ভাঁটায়।" এমন একটা কথা জানিয়ে দেয় এ সমস্ত স্বীকৃতি থেকে দূরে যাও। রামকৃষ্ণ বলতেন সাধনা মনের স্তরের ওপর নির্ভর করে। সাধনার দরকার হয় প্রথমে , পরে সেটা স্বভাবে উত্তীর্ণ হবে। ভেঙ্গে যাওয়া নববিবাহিত সম্পর্কের কন্ট্রাসেপটিভ পিল আর গোলাপী ফোসকা যমজ হয়ে গেলে উনি অসহায় সেই ছেলেটির গলায় বলছেন ," অসহায় স্বামী শুধু দু চোখের কুয়ো থেকে জল তুলে প্রাণপণে নেভাতে চায় নীল সেই বিষাক্ত আগুন।" অথচ এই দুটি পায়রাই হাত ধরে ভেবেছিল ," ভালবাসা অনপেক্ষ এবং দুর্মর / কখনো ভাবেনি তারা / অভিজ্ঞতা মানে জন্মান্তর।" ঠিক তখনই মরণের ওপারে তুহু মম শ্যাম ভাবনায় আমাদের ভাস্কর চক্রবর্তী বলে ফেললেন," যারা মরে যায়, তারা ঘরের নীচে , এক অনেক নীচের ঘরে চলে যায়।" বিদেশী বহু ভ্রমণার্থী সবার আড়ালে কত দেওয়ালে হাইকু লিখেছেন। কখনো তাদের সংরক্ষণ বা পেটেন্ট নেননি। অন্তরালে এভাবেই এক গুহ্য ধনভান্ডার গড়ে উঠেছে।তারা সর্বসমক্ষে আসেনি। কোনো এক নবীন কবি ভাস্করকে প্রশ্ন করেছিলেন ," কবিতা এত ছোট হচ্ছে কেন ?" ভাস্কর বলেছিলেন ," হয়তো বোবা হয়ে যাচ্ছি।" কবিতা চাই চাই করে যে সমস্ত দাবি দেখেছিলাম বইমেলা প্রাঙ্গণে তাদের কাছে প্রশ্ন কবিতা তো আনন্দ উত্তেজনা নয়, হুল্লোড় নয়।তাহলে এভাবে তো পাঁচালী লেখা যায়, ছড়া লেখা যায় যা ডক ফাইলে অভ্রতে টাইপ করে পাঠানো যায় তড়িঘড়ি সাইটে। কবিতা তো পড়ে থাকে মনে যাকে ভোলা যায় না। তা বাড়িয়ে দেয় সমস্ত শরীরের রক্তচলাচল। তাকে কি বাধা যায়। এ তো আর বিশ্বকাপ নয়, আর্জেন্টিনা, জার্মানির ধোঁয়া ওঠা কাপ আর লাফালাফি নয়। এ তো নীরব নেশা যা জল না মেশানো একটা হুইস্কির মতো। আমাদের সাবকনশাসের জেগে ওঠা। কোন কবি যে কখন জেগে ওঠেন , সবার মধ্যে থেকেও একলা থাকেন। নিংড়ে নেন তুচ্ছ অপরাজিতার মধু তবু কখনো শূন্য দেওয়ালের গায়ে উত্তরীয় সাজাতে ছোটেননা। একা হতে হতে তারা আলো থেকে সরে দেখে নেন রান্নাঘরে চায়ের পাতার ফুটে ওঠা লালচে রঙ, ইলিশের রুপোলি চাহিদা অথবা ভৈরবীর মাতৃসম স্নেহ। এরকম কয়েকটা লেখার কথা মনে পড়ছে যারা প্রথা ভেঙে, শুধু মন লিখেছে। তাদের কয়েকজনের কথা বলি তবে। শ্রীক্ষেত্রের দারুব্রম্ভ তৈরি হবে বলে যে নিমগাছ কে কাটা হচ্ছে সে অসহায় ভাবে জিজ্ঞাসা করে -" বাবা , যেদিন কোনো গাছ থাকবে না আর, সেদিন কি শুধু ঈশ্বর ই পৃথিবীতে থাকবেন?" লিখেছেন অভিষেক চক্রবর্তী। বাঁকুদার কথা বলেছেন কবি। বাঁকুদা বলছেন , মন ভালো রাখতে হয় শিব বানানোর সময়, না হলেই বাবা রোগা হয়ে যাবেন, দাম পাবো না ঠিকঠাক।" সেই তিনিই আবার আক্ষেপ করছেন " কী কপাল বল, পেট চালাতে শালা রোজ নিজেই বাবাকে বানাই আবার বাজারে বেচে দি।" নিস্পৃহ স্বীকৃতি আর জনারণ্য কে চ্যালেঞ্জ করে কবি বলছেন , "কেন যে এত মনখারাপ হয়! বেশি মনখারাপ পেলে বরং কলকাতা আসুক একদিন ফাঁকা স্টেশনে।" এই শান্ত নিস্তরঙ্গ স্রোত যার কথা মণীন্দ্র বাবু বলেছেন সে স্রোত পাই আমরা আরো এক কবির কবিতায়। যিনি ভৈরবীতে মাতৃরূপ দেখেছেন ," সে তখন আমায় মায়ের মতো বসিয়ে নুন ছাড়া ওর আর রাঙাআলু চমকে সেদ্ধ ভাত খেতে দিল।" এই সম্মানটুকুই অনেক বড় পাওয়া যখন গীতা ঘটকের গান পুনর্বার শুনতে চেয়ে কবি এভারেস্ট জয়ের আনন্দ বলছেন ," আর আমি পাহাড়ের চুড়োয় ওঠার পর আরোহী যেমন সারা জীবনের ক্লান্তি আর নানারঙের আনন্দ এক ই সঙ্গে গায়ে মেখে ধপ করে আছড়ে বসে মাটিতে - ঠিক তেমনি করে আছড়ে বসে সেই আশ্চর্য গান শুনতে লাগলাম।" সাহিত্য শহিদ সৈনিকদের মতো। যাদের চলে যাওয়ার পর প্রলোভন দেখায় সরকার ওদের পরিবারকে। তোমার কাছের মানুষটি দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে মারা গেছে। এই সত্য কথাটা কে বা বলতে পারে যে দুটো অন্নসংস্থান করার জন্য রাষ্ট্রের মান অভিমানের হাঁড়িকাঠে পা দিয়েছিল লোকটি। সেজন্য ই একা হতে হয়, গাছের মতো একা হতে হয়। ছোট বড় হওয়ার শিক্ষা নিয়ে সেজন্যই কবি শুভঙ্কর দাশ বলেছেন ,"মানুষের ছোট বড় হওয়া নিয়ে গাছের কাছে শিক্ষা আনতে গেল যারা তারা আর ফিরে আসেনি। অথবা এখন ও তাদের শিক্ষা শেষ হয়নি, নির্বাণ হয়নি তথাগতের।" চব্বিশ ঘন্টার দু পেয়ে স্বীকৃতিকাঙ্খিত মানুষ থেকে দূরে একটা ছোট্ট বারান্দার ধারে বসে কবি বলছেন ," ঘেন্না শক্তি কি ইচ্ছের চেয়েও খানিক বেশি।" এই অমানুষিক মানসিক পরিশ্রম থেকে ফাল্গুনী রায় বলেছিলেন -" লিখতে গেলে টের পাই পরিশ্রম হাড়ের ভেতর থেকে ..."। তোয়াক্কা না করে সিংহাসনে বসা শাসনকর্তার নির্ভয়ে আমাদের অনামী ফাল্গুনী বলেছেন -
" রাষ্ট্র কি সব কিছু দিতে পারে
লাস্ট বয়কে ফাস্ট বয় করে দিতে পারে সাম্যবাদ?
বাজে কবিকে ভাল কবি করে দিতে পারে সমাজতন্ত্র। " শুধু মাত্র দু লাইন উৎপলকুমার , সুধীন দত্ত , বিষ্ণু দে সবার প্রভাবে পড়ে অ্যাসেম্বলড কনসেপ্ট লিখে চারটে বাহ পেলে তা তোমাকে সামাজিক তৃপ্তি দেবে, আই এস এস এন পত্রিকার ছাপা অক্ষরে কিছু নম্বর দেবে যা লাগবে রিসার্চে কিন্তু মানসিক ভাবে তুমি ও জানো ওগুলো তোমার নয়। যাদের বাড়ি থেকে সরিয়েছো তাদের। তারা স্নেহভারে নীরব। পুরস্কারের দোকানে পাইকারি দরে সোনালী পদকে নাম ছাপাচ্ছে উদ্যোক্তা আর সেই পুরস্কার নিয়ে তুমি নামছো। যে দর্শক যারা তোমার এক লাইন কবিতা পড়েনি তারা আহা বাহ বলছে। পাঠক বই পড়তে গিয়ে দেখছে কে কতটা নামী। সত্যকারের লেখক খুঁজছে না। খুঁজছে অ্যাডভার্টাইজমেন্ট।এই কলরোলে হতাশ প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত বলছেন , " একটি কাকের শব্দে পুরো পৃথিবীর শান্তি ভেঙে যেতে পারে।" গভীর অরণ্যে ঢুকে যিনি বলছেন -" কিছু বা নিয়ম আমি মানতে পারিনা, কিছু বা নিয়ম দেয়ালে টাঙিয়ে রাখি প্রপিতামহের কথা ভেবে।"রাইটার মারিয়া রিলকে বলছেন আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা করতে ঠিক কে আমাদের লিখতে বাধ্য করছে। এইসব আধুনিক উত্তর আধুনিক বলে কোনো বিভাগীয় দপ্তর মানিনা। এ তো আর শ্রেণী সংগ্রাম নয়। আধুনিকতা হল এক দৃষ্টিভঙ্গি যা লক্ষ্য এক রেখে সময়ে সময়ে নির্মোহ বদল আনে। সে তো বয়সের মতো বদলায়, পাতায় যেমন অ্যানী ফ্র্যাঙ্কের পরিবর্তন দেখেছিলাম বয়ঃসন্ধির। কত কিছু করে ফেলার , শিখে ফেলার শৈশব থেকে একবার ঘুরে নিজেকে সময় দিক প্রজন্ম। নিঃসঙ্গতার অর্থ জেনে নিক। অকারণ সাজানো ভিড় যে পুজো মন্ডপের বাইরে সেখানে ঢোকার আগে বাস্তবতা ধরা পড়ে , "জন্ম হয়েছিল , এখনো বেঁচে আছি।"


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...