পাঁচফোড়ন আর চক্রবৎ : পৌলোমী সেনগুপ্তের কবিতা
প্রসঙ্গ
ও প্রতিন্যাসের মধ্যেও কবিতার অন্তর্নিহিত গতিটি ভাষা নিরপেক্ষ বা ভাষা থেকে
বিছিন্ন কিছু নয়,এই গতি হলো যে-কল্পমূর্তির মধ্য দিয়ে কবি ভাববস্তুর প্রকাশ
ঘটিয়েছেন তার সচল রূপটি। পৌলোমী সেনগুপ্ত'র কাব্যগ্ৰন্হ "মুঠোর মাপ উপচে
যেন পড়ে" বইটির কবিতা বিভাজনগুলি কবির পূর্ব প্রকাশিত পাঁচটি কাব্যগ্ৰন্হের
মিলিত কম্পোজিশনের চিত্রময় গতিময়তা।লক্ষ্য করার বিষয় কবিতা গুলির খন্ড খন্ড
উপাদান ও গঠন রূপের মধ্য দিয়ে ক্রমপরিণত ও অখন্ড মাধুরী প্রতীত করে তোলে। পৌলোমী সেনগুপ্ত "অমৃত মন্হন", "মেট্রোয় বৃষ্টি",
"উল্কি","আমরা আজ রূমাল চোর", "পেন্সিল খুকি"এই
ক্রম সমন্বয়ে সাজালেও আমার ১৯৯৭ এ প্রকাশিত "পেনসিল খুকি" কাব্যগ্রন্থটিতে
চোখ আটকে যায়।ফ্যাক্ট, ফিকশন,ফ্রি মার্কেট-জার্নালিজম্ এবং সর্বোপরি ইন্টারনেটের
দ্যুতিময় উপস্থিতি অর্থাৎ একটা অচেনা পরিবর্তনের পরিবেশ এই সমস্ত কিছুর
অখন্ডায়নের মনতাজে আমরা শুনেছি---
" আমাদের কোনও পাশের বাড়ি নেই। / এ ব্লক,বি ব্লক,সি ব্লক /
তারপর খানিকটা গাঢ় আস্তাকুঁড় / বাতাসে এলিয়ে আছে।
এইসব পার হয়ে / আমাদের ট্যারাচোখ বাড়ি, / আবলুশ দরজায় তিব্বতি ঘন্টা ঝোলানো।
ছলে এসো ,সিঁড়িটার শেষ দেখে যাও / স্নানঘরে আধভেজা শাড়ি আর বালতির জল / ঝুঁকে পড়ো চোখ খোলা রেখে
দেখবে নষ্ট হয় অন্যের বাড়ি
তুমি আর বালতিটা গড়িয়ে পড়ছ।" ( পথনির্দেশ )
এইসব পার হয়ে / আমাদের ট্যারাচোখ বাড়ি, / আবলুশ দরজায় তিব্বতি ঘন্টা ঝোলানো।
ছলে এসো ,সিঁড়িটার শেষ দেখে যাও / স্নানঘরে আধভেজা শাড়ি আর বালতির জল / ঝুঁকে পড়ো চোখ খোলা রেখে
দেখবে নষ্ট হয় অন্যের বাড়ি
তুমি আর বালতিটা গড়িয়ে পড়ছ।" ( পথনির্দেশ )
স্মৃতিকাতর এই আবেদন, আম্রেড়ন
কিছু শব্দের সন্নিধি আমাদের অবাক করে নিয়ে যায় ট্যারাচোখ বাড়ির দিকে।কবি বলে দেন,
" আমি জানতাম ওই ঘরে গেলে কলকাতা কোনারক হয়।" কিংবা যখন দেখি " সূর্যরথের
চাকা ঘুরে যায় বাতানুকুল কামড়ায় আর আয়নায় উড়তে থাকে চমৎকার এক সোনালি পায়রা"( বিউটি
পার্লারে)। তখন নগর সভ্যতার সংলগ্ন ও সমান্তরাল বক্রোক্তিবাদের কাছে কাব্যবোধের দৃঢ়তা
ও স্বচ্ছতার নির্ভরতার পটুত্বে কবি জানিয়ে দিচ্ছেন " ছন্দপতন শব্দটার মধ্যেও
/ একটা অদ্ভুত ছন্দ আছে। একটা নয় / প্রায় একঝাঁক..." ( ছন্দ
)।এই দৈনন্দিন জীবনের ছন্দ পতনের ভিতর যেমন অভিকর্ষজ ত্বরণের আপেল প্রতিভাত, তেমনি
সেই আপেলের যৌন উন্মিলনে অজস্র কামড়ের ক্ষত আছে। পৌলোমীর
কবিতার এই স্বতঃসিদ্ধ স্পন্দন ভাষার অন্তর্বর্তী রক্তক্ষরণের ধ্বনিময়তায় পাঠকের মনোযোগকে
নির্দেশ করবে স্বাভাবিক!
"প্রতীক্ষা
এক দীর্ঘজন্মা নারী" সুতরাং চিরপ্রতীক্ষমান মানবসভ্যতা " প্রতীক্ষা এক
প্রাপ্তিরূপিণী নারী" র অনুষঙ্গে জলরেখাবলয়া পৃথিবীর দিকে নিদারুণ অপচয়ে
তাকিয়ে থাকে! হয়তো এ জন্যই শরৎকালের হাওয়ায় " একটি টিকটিকি লাফ দিয়ে
চড়ে বসল চাঁদের উপর। / চাঁদের ওই কালো দাগটা / দাগ বা কলঙ্কের ছায়া / যাই হোক /
মোটেই খরগোশ নয়, চাঁদের মা বুড়িও নয় / ওটা / আমি স্পষ্ট দেখলাম..."
কল্পনার অবাক করা প্রকরণকে ব্যবহার করে কবি শব্দের মুখোশ ঝরিয়ে দিয়ে বার করে
আনতে চায় দৈনন্দিন চরিত্র, যেমন করে পাতা ঝরে,বাকল ঝরে গাছের,খোলশ ঝরে পড়ে
সাপের, সেরকম করে সব স্খলন বিচ্যুতি ও ভ্রষ্টতার উর্দ্ধে অপরিত্যক্ত সত্তাকে
পাঠকের মুঠোর মাপ উপচে পড়ার অভিযাত্রায়
চিরপ্রতীক্ষমাণ হবেন নিশ্চয়ই কবি।
মুঠোর মাপ উপচে পড়ে , পৌলোমী সেনগুপ্ত,
সিগনেট প্রেস, ৪০০ টাকা
No comments:
Post a Comment