খুকুমণির বোতাম ও হুক সম্পর্কিত যাবতীয় ইন্দ্রজাল
১
বোতামের যে অসীম ক্ষমতা, অস্বীকার করে লাভ নেই। একবার খুললেই, যেন দক্ষিণের জানলা –
চাঁদ ওঠে, ফুল ফোটে... কদম
তলায় যাই না যাই,
বসন্ত জেগে ওঠে। খুকুমণির কর গোনা স্বভাব, সে প্রতিমাসেই গোনে। আমার অত হিসেব-নিকেশ আসে না, আমি দিবস গোনার দায়িত্ব বিরলে খুকুমণির হাতে ছেড়ে দিয়েছি। খুকুমণির ওপর আমার পরিপূর্ণ আস্থা আছে, তার সঙ্গে আমার পাটীগণিতের সম্পর্ক, আজকের নয়... প্রথম যখন খুকুমণির বোতামে আঙুল রাখি, সম্ভবত সেগুলি টিপ-বোতাম ছিল, যতদূর মনে পড়ে ফ্রক এবং ত্বকের মধ্যে কোনো মেঘলা আকাশ ছিল না। পরবর্তীকালে
অবশ্য আবিষ্কার করেছি দুটি মেঘ একত্র ধরে
রাখতে হলে হুক লাগানো জরুরী এবং মেঘ-সংলগ্ন হুকের ক্ষমতা বোতামের থেকে বেশি। কারণ, প্রথমতঃ খুকুমণির সব জামায় বোতাম নেই, সেই বোতামহীন জামাগুলি খুকুমণি মাথা গলিয়ে পরে নেয়, সুতরাং বোতামকে প্রাধান্য দেবার প্রশ্নই ওঠে না, দ্বিতীয়তঃ
হুক লাগিয়ে রাখলে সহজে আকাশ থেকে চাঁদ নামে না এবং মেঘের ওপর জ্যোৎস্না পড়ে এক
অদ্ভুত স্নিগ্ধতা তৈরি হয়,
খুলে দিলে... মাঝেমধ্যে খুকুমণি নিজেই খুলে দেয়, ধরাচাঁদ জলের ওপর ঝুঁকে পড়ে। তখন আর ফুলেরা কী করে? রাতচষা পাখি হয়ে সমুদ্রের দিকে উড়ে যায়।
অথচ খুকুমণি আমাকে ভালবাসে না, সে তার স্বামীকেই ভালবাসে, অন্তত আমার তাই মনে হয়। আমি একজন জালি ইন্দ্রজালিক, আমাকে ভালবাসা এতটাই অপ্রাসঙ্গিক, সে কথা সে কোনদিনই বিবেচনা করে দেখেনি। অবশ্য প্রথম দিকে
খুকুমণি যখন সমুদ্রযাত্রায় যেত, আমাকে সঙ্গে নিয়ে
যেত। আমরা বেশি দূর যাইনি যদিও, সুন্দরবন অঞ্চলেই
দু-জনে মিলে কয়েকটি সবুজ ঘাসের ব-দ্বীপ খুঁজে বার করেছিলাম, যেখানে কোনদিন মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি, এমনকি বাঘেরও না। আসলে তখন খুকুমণির মাথায় আবিষ্কারের ভূত
চেপেছিল,
সে’সব অনেককাল আগের কথা, ছেলেবেলায় সবারি অমন একটু আধটু অনুসন্ধিৎসা থাকে, তার জন্য খুকুমণিকে দোষ দিই না।
কিন্তু সেই সব বেহিসাবি নৌকোবিহার আমাকে বরবাদ করে দিল, হল কী, তারপর থেকে অন্য
কোনো চাঁদের নিচে সমুদ্রযাত্রার কথা ভাবলেই আমার ভয় হত, মনে হত জলে আলো নয়, ভাঙা কাঁচের টুকরো ছড়িয়ে আছে, আঁজলা করে তুলতে
গেলে হাত কেটে রক্ত পড়বে। চেষ্টা যে করিনি এমন নয়, কিন্তু আমার অপারগতা দেখে চাঁদেরা আমায় দুয়ো দিয়েছে, আমি অপমানে মাথা নিচু করে বসে থেকেছি। দু-একবার মনে হয়েছে
এই শিথিলতা নিতান্তই শারীরিক, খুকুমণি এর জন্য
কোনোভাবেই দায়ী নয়। সন্দেহ নিরসনের জন্য খুকুমণির কাছে ফিরে গেছি, খুকুমণির স্বামী তখন অফিসে, আশ্চর্য হয়ে দেখেছি খুকুমণি যেমন আমার করোটীর মধ্যে বিঁধে আছে, আমিও তেমনই অনায়াসে তার মধ্যে বিঁধে যেতে পারি। ঠোঁটের ওপর
জিভ বুলিয়ে আত্মতুষ্টির লালা চেটে নেবার আগেই খুকুমণি বলেছিল, “আর এস না, লক্ষ্মীটি, ও যদি জানতে পারে...”
আমি খুকুমণির কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম, তাকে ছেড়ে থাকা আমার পক্ষে অসম্ভব, সে আমার কাছে শ্বাস নেওয়া, জল খাওয়া,
ঘুমোন এবং প্রাত্যহিক অন্যান্য তুলনামূলক ভাবে মর্যাদাহীন
কাজকর্ম করার মতই দরকারি। খুকুমণিকে বুঝিয়ে লাভ নেই, কারণ,
কথাটা বলেই সে ডালে সম্বরা দিতে চলে গিয়েছিল, মৌরি ভাজার গন্ধ পাচ্ছিলাম, খুকুমণি সেদিন বিউলির ডাল আর ঝিঙে-পোস্ত রাঁধছিল। খুকুমণি বলেছিল, খেয়ে বেরোতে, কিন্তু আমি লোভ সামলে নিয়েছিলাম। আসলে আমার তখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল অবস্থা, কী করব, কোথায় যাব বুঝছি না। মনে হয়েছিল কেউ যদি কিছু করতে পারে... সে
ওস্তাদ, খুকুমণির বাড়ি থেকে বেরিয়ে সটান ওস্তাদের ডেরায় গিয়ে উঠেছিলাম।
২
শেষবার যখন ওস্তাদকে দেখেছিলাম, তখনই তার হাত কাঁপে... জোয়ান বিবি, এদিকে ম্যাজিক-বাক্সর তালায় চাবি লাগাতে পারে না। অন্যদিকে অবশ্য
একবার বললেই আস্তিনের ভেতর থেকে জ্যান্ত গোখ্রো বের করে এনে দেখায়। ওস্তাদের
ম্যাজিক-বাক্স একটা আশ্চর্য খাজানা, সেগুন কাঠ দিয়ে তৈরি আখাম্বা সিন্দুক, শুইয়ে রাখা আলমারীই বলা যায়, কী নেই তার মধ্যে? আলাদা আলাদা খোপে সাপ, ব্যাঙ,
কবুতর, আমার ধারণা
হয়েছিল ওস্তাদ দু একটা হুরী পরীও জ্বিনও ওর মধ্যে ভরে রেখেছে। ওস্তাদের সঙ্গে আলাপ
হয়েছিল বছর পাঁচেক আগে প্রয়াগের মেলায়, তখন আমি টো টো কোম্পানি, পড়াশোনার মায়া কাটিয়ে, বছর দুয়েক বেচুবাবুর কাজ করে
জুতোর সুকতলা ক্ষইয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে হাঁটতে হলে নদীর ধারেই হাঁটব। ওস্তাদ হাত
সাফাইয়ের কারসাজি দেখাচ্ছিল, লোকজন ভিড় করে
দেখছিল ওস্তাদের হাত থেকে খসখসে কারেন্সি নোট কেমন ডানা ঝাপটে পায়রা হয়ে উড়ে
যাচ্ছে।
আমিনা বিবিকে তখনও আমি চিনি না, আন্দাজ করেছিলাম, চড়তি জওয়ানি দেখিয়ে দেখিয়ে যে মেয়েটা জনতা জনার্দনের কাছ থেকে ছিল্লার সংগ্রহ
করছে তার সঙ্গে ওস্তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে, কারণ সে থালার থেকে নোট উঠিয়ে রাবার
ব্যান্ড আটকে তার কাঁচ বসানো চোলির আড়ালে গুঁজে রাখছিল। আমি সেই চটকসুন্দরীর পাশে
উবু হয়ে বসে ফিসফিস করে বলেছিলাম, “ও খুড়ি, তোমার শোওহরের ফাটা পাতলুনের মধ্যে যে পাখি দেখা যাচ্ছে গো।” আমিনা বিবি প্রথমে লজ্জা পেয়েছিল, তারপর দেখে সত্যিই... একটা গোলা পায়রা ঢোলা পাজামার মধ্যে
ছটফটাচ্ছে। লোকজন দেখে ফেললে কেলেঙ্কারির একশেষ হবে, আমিনা তাড়াতাড়ি ওস্তাদের হাত ধরে টান দিয়েছিল। ওস্তাদ রেগে কাঁই, দিলি তো খেলাটা ভণ্ডুল করে... আমার দিকে সন্দেহের চোখে
তাকিয়েছিল,
আমিনা তাকে বুঝিয়ে পারে না।
পরে অবশ্য ওস্তাদ নিজের ভুল মেনে নেয় এবং আমাকেই পাখি
সামলানোর দায়িত্ব দেয়,
সে এমন কিছু ভারী কাজ নয়, পায়রাগুলো নিজেরাই ম্যাজিক বাক্সয় ফিরে আসত। তখনই দেখেছিলাম ওস্তাদ ইচ্ছে
করলেই শরীর বদলাতে পারে। প্রথমে নিজের চোখকে ভরসা করতে পারিনি, আমিনা বিবি বায়না ধরেছিল মালপো খাবে, এদিকে ওস্তাদের গেঁজে খালি, সকালে খেলা দেখিয়ে যা জুটেছিল দেশী দারু খেয়ে উড়িয়ে দিয়েছে, আমাকে ম্যাজিক-বাক্সর ডালার ওপর বসিয়ে রেখে ওস্তাদ মেকশিফট
পেচ্ছাপখানায় ট্যাঙ্কি খালি করতে ঢুকল। বসে আছি তো বসেই আছি, আমিনারও পাত্তা নেই, মালপোর শোকে সে মাগী কোথায় মরতে গেছে কে জানে! পিঠে কেউ একজন মাংসল ভারী হাত
রাখল,
ঘুরে দেখি এক সা-জোয়ান মাড়োয়ারি, সাদা চোস্ত, আংরাখা,
পাগ্গাড়, হেসে বলল, “ক্যা বাবু, পহচানা নেহি?” আমি বোকার মত মাথা নেড়ে ‘না’
বলেছিলাম। পরে
জেনেছিলাম ওস্তাদ সেই দাবাং টাইপের মাড়োয়ারিটার শরীর ঘন্টা খানেকের জন্যে ধার
নিয়েছিল,
সাজপোষাক, নাগড়াই, মায় রোকড়ার বটুয়া সুদ্ধু।
৩
ওস্তাদের আদি ঘর ছিল মজফ্ফরনগরে, আমিনাকে ভাগিয়ে নিয়ে এসে বাসা নিয়েছিল ক্যানিং-এর কাছে একটা
গঞ্জ মতন জায়গায়। খুকুমণির বাড়ি থেকে বেরিয়ে, বাস ধরে ক্যানিং,
সেখান থেকে ভ্যান-রিক্সায় ওস্তাদের ডেরায় পৌঁছোতে পৌঁছোতে
বেলা ঘুরে গিয়েছিল। গিয়ে দেখেছিলাম গত পাঁচ বছরে ওস্তাদ বেজায় বুড়ো হয়ে গেছে, পায়ের ওপর উলটে পড়েছিলাম, একটা কিছু উপায় কর ওস্তাদ...। আমাকে বাঁ পায়ের কড়ে আঙুল দিয়ে ঠেলে সরিয়ে, আধখানা চোখ খুলে, সর্দি-বসা ঘড়ঘড়ে গলায় ওস্তাদ জিজ্ঞেস করেছিল, “কী চাই?”
খিদেয় আমার পেট চুঁই চুঁই করছিল, আমি কেঁদে পড়েছিলাম, “আমায় কোনোভাবে খুকুমণির স্বামী বানিয়ে দাও গো কত্তা, আমি জানি তুমি পারো... আমি সারাজীবন তোমার পোষা কুকুর হয়ে
থাকব”, এরা কুকুরকে খেতে দেয় তো?
নেহাত আমিনা ফিরল বলে... ওস্তাদ এমন ভাব দেখাচ্ছিল যেন
চিনতেই পারছে না। কলমি শাকের আঁটি নামিয়ে রাখতে রাখতে আমিনা জানিয়েছিল, ওস্তাদ আজকাল কোথাও বেরোয়-টেরোয় না, সারাদিন ঘরের মধ্যে একটা হাতল ভাঙা কাঠের চেয়ারে ঝিম মেরে
বসে থাকে আর নিজের মনেই কীসব বকবক করে। এমনকি আমিনাকেও মাঝে মধ্যে না চেনার ভান
করে... ভানই করে সেই ব্যাপারে আমিনা নিশ্চিত।
ওস্তাদ হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আইয়ে জনাব, ফরমাইয়ে আপ্কে
খিদ্মতমে ক্যা পেশ করুঁ?
হাথ কী সাফাই, নজর কা খেল...”
আমিনা বলেছিল, “এই আবার নৌটঙ্কি শুরু হল...”
ওস্তাদ আমিনার ওপর চিল্লিয়ে উঠেছিল, “কলাকারীর কী বুঝিস? গুস্তাখ আওরত, সারে চিড়িয়াকো ভাগা ডালা! অব ম্যায় খেল ক্যায়সে দিখায়ুঁ?”
আমিনা চোখ লাল করে বলেছিল, “পাখিগুলো না খেতে পেয়ে খাঁচার মধ্যে মরছিল, বেশ করেছি উড়িয়ে দিয়েছি। রেখে কী হবে? তুমি আর কী কস্রত দেখাবে? অওকাত নেই এক
ফুটিকড়ির,
খালি বড় বড় কথা!”
ওস্তাদ রাগে ফুঁসছিল, সে পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিল, আমিনার মুখ দিয়ে
আর একটা লব্জ বার হলে তার মুখ ভেঙে দেবে। আমিনা ওস্তাদকে পাত্তা না দিয়ে আমার দিকে
তাকিয়ে বলেছিল,
দাদা তুমি মুখ-হাত ধোও, আমি তোমার জন্যে একটু চা-জলখাবারের যোগাড় দেখি। ওস্তাদের মুখের পেশী মুহূর্তে নরম হয়ে এসেছিল, খোঁচা খোঁচা দাড়ি ওঠা ভাঙা গাল চুলকোতে চুলকোতে বলেছিল, “ও বৌ, আমাকেও একটু দিস।”
৪
প্রথম ছ’মাস ওস্তাদ আমার
দিকে তাকিয়েও দেখেনি,
যেন আমি তুচ্ছ কীট পতঙ্গ, থাকা না থাকা সমান। নখ দিয়ে পিষে মারারও যোগ্য নই। মাঝরাত্তিরে বুড়ো
তক্তাপোষের ওপর বসে, কাঁধের নিচে মাথা ঝুলিয়ে হাঁপাত আর খক খক করে কাশত। সারাদিনের
পরিশ্রমের পর আমিনা ঘরের মেঝেতে মাদুর পেতে ঘুমে কাদা হয়ে পড়ে থাকত, উঠত না। আমি আমিনার পায়ের ডিমির ডৌল ডিঙিয়ে, ওস্তাদের বুকে তেল মালিশ করে দিতাম। কাশির দমক থামলে ওস্তাদ শিরা ওঠা হাত তুলে বলত, সুক্রিয়া, জনাব!
পরের দিন সকালে আমায় বেমালুম ভুলে যেত, আমিনাকে ডেকে বলত,
এই শয়তানটা এখানে কী করছে রে? ওকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে
বল। আমি তবু চোখ কান বন্ধ করে ওস্তাদের ডেরায় পড়ে ছিলাম।
দিনের বেলা একটা টেম্পোরারি কাজ নিয়েছিলাম। গড়খালি থেকে যে
লঞ্চগুলো সুন্দরবন যায় তাতে গাইড লাগে গাছপালা, পাখ-পাখালি,
কুমির-কামঠ চেনানোর জন্যে।
সরকারী গাইড মনোরঞ্জন আইচ দুপুরবেলা তিন চার ঘন্টার জন্যে
আমাকে লঞ্চে ফিট করে তার রাখেলের কাছে মাছভাত খেতে যেত, খেয়ে দেয়ে একটু গড়িয়ে ফিরতে ফিরতে আমার তিন চারটে ট্রিপ হয়ে
যেত,
আইচকে দিয়ে-থুয়ে ট্রিপ-প্রতি একশ, আমিনা দুটো বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়েছিল, তিনটে মানুষের ঘর-খরচা চলে যাচ্ছিল।
সন্ধেবেলা ফিরে ওস্তাদকে ভজাতাম, ওস্তাদ দেওয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসত, যেন টিকটিকিটাও আমার থেকে বেশি সুদর্শন। আমি ইনিয়ে বিনিয়ে
বলতাম,
খুকুমণিকে আমি কত ভালবাসি, কতদিন তার ফুটফুটে জ্যোৎস্না দেখি না, জ্যোৎস্না না দেখে দেখে আমার চোখের নিচে কালি পড়ছে, এরকম চললে আমি আর বেশি দিন বাঁচব না... রাত বাড়লে রান্নাঘর
থেকে ভাত ফোটার গন্ধ আসত,
ওস্তাদ উৎসুক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকত, আমার কথা কানে নিতে না। আমি তবু লেগে থাকতাম।
৫
একদিন ওস্তাদ আমার দিকে ফিরে বসল। ভুরু কুঁচকে অনেকক্ষণ
আমার দিকে তাকিয়ে থাকল,
তারপর বলল, “কাছে আয়”, অথচ আমি কাছেই
বসে ছিলাম। মেঝেয় পেছন ঘষে ওস্তাদের তক্তাপোশের দিকে আর একটু এগিয়ে বসলাম। ওস্তাদ
একবার ঘাড় ফিরিয়ে দেখে নিল আশেপাশে আমিনা আছে কিনা, তারপর ফিসফিস করে বলল,
“তোকে তোর খুকুমণির খসম বানিয়ে দিতে পারি... কিন্তু একটা
শর্তে... ”
আমার চোখে জল এসে গেল, বললাম,
“বল ওস্তাদ, কী করতে হবে? তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য আমি বেহেস্তের পারিজাত এনে দিতে
পারি।”
ওস্তাদ বলল, “দূর গাধা,
বেহেস্তে পারিজাত পাওয়া যায় না, সে তোদের নন্দনকাননে ফোটে, ও’সব নয়, তোর শরীরটা আমার
চাই।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “আমার শরীর?
তুমি আমার শরীর নিয়ে কী করবে?”
ওস্তাদ লাজুক লাজুক মুখ করে বলল, “তুই যখন তোর খুকুমণির সঙ্গে নৌকো বাইবি, আমি আমিনার সঙ্গে পঞ্ছি ওড়াব।”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “পাখি তো ওড়াবে,
কিন্তু খুকুমণি ছাড়া যে আমার পাখি ওড়ে না।”
ওস্তাদ বলল, “সে তোকে ভাবতে হবে না,
তখন তোর শরীর আমার হিফাজতে থাকবে, পাখি ওড়ানোর জিম্মেদারি আমার ওপর ছেড়ে দে। তুই খালি বল আমায়
শরীরটা দিতে রাজি আছিস কিনা?”
আমি ঘাড় গোঁজ করে বললাম, “সে তো তুমি ইচ্ছে করলেই যে কারো শরীর দখল নিতে পার।”
ওস্তাদ বিমর্ষ হল, “সে দিন কি আর আছে রে?
বয়স বাড়লে মন দুর্বল হয়ে যায়, তুই নিজের থেকে ছেড়ে না দিলে আমি তোর শরীর নিতে পারব না। তবে হ্যাঁ, তুই
জোয়ান-মদ্দ,
মন্ত্রসিদ্ধি হলে তুই তা করতে পারবি, যার শরীরে ইচ্ছা করবি তার শরীরেই সেঁধিয়ে যেতে পারবি। ভেবে
দেখ...”
আমার শরীরের ওপর ওস্তাদের লুব্ধতার কারণ অনুমান করা কঠিন নয়, তেষ্টায় বুড়োর ছাতি
ফাটছে,
সামনে কাকচোখ দিঘি, অথচ জল খাবার সাধন নেই। এদিকে আমিনাকে আমি খুড়ি ডাকি, সে আমায় ডাকে দাদা, আমার শরীর পেলে ওস্তাদ আমিনাকে ছিঁড়ে খাবে। আমিনা তো জানবে না, আমার শরীরে ওস্তাদ ঢুকে বসে আছে, তার কাছে আমার মুখ
দেখাবার জো থাকবে না। কিন্তু ওস্তাদের কথা মেনে নেওয়া ছাড়া আমার সত্যিই কি কোনো
উপায় আছে?
খুকুমণিহীন বেঁচে থাকার কথা ভাবলেই আমার মেরুদণ্ড বেয়ে সাপ
নামে,
হাত পা হিম হয়ে আসে। ওস্তাদ বার জিজ্ঞেস করল, “কীরে মঞ্জুর?”
আমি ঘাড় নেড়ে বললাম, “হ্যাঁ।”
৬
পরের দিন সকালে আমিনা বেরিয়ে যেতে ওস্তাদ আমায় শরীর থেকে মন
আলাদা করার গুহ্য শাস্ত্র শেখাতে বসল, দুজনে খালি গায়ে লুঙ্গি পরে আসন-পিঁড়ি হয়ে মুখোমুখি মাটিতে বসলাম, ওস্তাদ ম্যাজিক-বাক্সর ডালা খুলে কীসব শেকড়-বাকড় বার করে
কোমরের কষিতে গুঁজে রাখতে দিল, বলল, শোন বেটা, ‘মন্ত্র’ শব্দটার মধ্যে ‘মন’
ঘাপ্টি মেরে বসে আছে, আসল কাজ হল মনঃসংযোগ। শুধু তো নিজের শরীর নয়, অন্য একজনের মনকে তার শরীরচ্যুত করা নিহায়ত সহজ কাজ নয়।
তালিম শুরু হয়ে গেল, ওস্তাদ আমায় যত্ন করে হাতে ধরে দেহ বদলের তরকিব শেখাতে লাগল। অসম্ভব
পরিশ্রমসাধ্য প্রক্রিয়া,
সময়-সাপেক্ষও বটে,
দক্ষতার এক একটা স্তর পার করতে বছর ঘুরে যায়। আমিনা
সন্ধেবেলা ফিরে আমাদের দিকে সন্দেহভরে
তাকায়,
জিজ্ঞেস করে, কী গুজগুজ ফুসফুস চলছে দুজনের মধ্যে, আমরা চুপ করে থাকি। ওস্তাদের যত বয়স বাড়ে ততই আমার নিরাবরণ অঙ্গের দিকে তাকিয়ে
তার চোখ চকচক করে। বছর তিনেক পরে ওস্তাদ
বলল,
“ব্যস্, অব তু তৈয়ার
হ্যায়।”
আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, ওস্তাদ যেন মন পড়তে পারল, বলল, “এক কাম কর্, ম্যায় মেরা শরীর ছোড়কে বাজুমে বয়েঠ্তা হুঁ, তু উসমে ঘুষ যা।”
আমি চোখ বুজে নিঃশব্দে মন্ত্র আওড়াতেই একটা অদ্ভুত অবসাদ
আমায় গ্রাস করল। কোনোমতে ভারী চোখের পাতা খুলে সামনে চেয়ে দেখি... আমি! আয়নায়
নিজের মুখ দেখার মত... আমিই আমার দিকে
তাকিয়ে মিচকে মিচকে হাসছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না, স্বপ্ন দেখছি না তো? নিজেকে চিমটি কাটতে গিয়ে দেখলাম হাতের চামড়া ঝুলে গেছে, আমি ওস্তাদের মর্চে ধরা খাঁচাকলে ঢুকে পড়েছি। ওস্তাদের আর
ত্বর সয়নি,
আমার শরীরটা খালি পেয়েই কব্জা করেছে। কোনো ব্যাপার নয়, এখনই আমি লাথ মেরে ওস্তাদকে আমার শরীর থেকে বার করে দিতে পারি, কিন্তু পৃথিবীতে কৃতজ্ঞতাবোধ বলেও একটা বস্তু আছে, তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী,
বস্, কেমন লাগছে?”
ওস্তাদ স্বর্গীয় হাসি হেসে বলল, “তবিয়ৎ বিলকুল খুশ হো গয়া”, তারপর মিনতি করল,
“ওর থোড়া দের্ রহনে দে... দে না!”
আমি বললাম, “থাকো আরো
কিছুক্ষণ,
আপত্তি নেই, কিন্তু আমিনা ফিরে আসার আগে ছেড়ে বেরিয়ে না এলে কিন্তু ঘেঁটি ধরে বার করে দেব।
তোমায় বিশ্বাস নেই,
মওকা পেলে তুমি আমার সামনেই আমিনার সঙ্গে পাখি ওড়াতে শুরু
করে দেবে।”
ওস্তাদ নিরতিশয় দুঃখিত হল, কিন্তু মুখে কিছু বলল না।
৭
দিন দুই পরে একটা চমৎকার রৌদ্রকরোজ্জ্বল সকালবেলায় আমি
ধোপদুরস্ত পোশাক-আশাক পরে খুকুমণির স্বামীর অফিস পৌঁছোলাম, আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে রেখেছিলাম। সৌভাগ্যবশত, খুকুমণির স্বামী একটা সওদাগরী অফিসের ব্যস্ত ম্যানেজার, আলাদা কেবিন। লাগোয়া কামরায় ছম্মকছল্লু লেডি সেক্রেটারি, নিজের পরিচয় দিতেই ভেতরে ডাক পড়ল। লোকটি ভারী অমায়িক, কী কারণে তার
সঙ্গে দেখা করতে এসেছি জিজ্ঞাসা করতেই আমি চোখ বুজলাম, আমার ঠোঁট নড়ছে দেখে সে ভাবল আমি অসুস্থ হয়ে পড়েছি, টেবিলে ঢাকা দিয়ে রাখা জলের গ্লাস এগিয়ে দিচ্ছিল, মাঝরাস্তায় তার হাত থেমে গেল, আমি তার দেহের দখল নিলাম। সে ভালমানুষের পো বিশেষ আপত্তি করল না, পাশের চেয়ারে চুপচাপ সরে বসল। আমি আমার নিঃস্পন্দ শরীরটাকে টেনে এনে টেবিলের নিচে
গুঁজে রাখলাম,
বাইরে এসে দরজা লক করে খুকুমণির স্বামীর সেক্রেটারিকে বললাম, ডার্লিং আমি একটু বাইরে যাচ্ছি, ফিরতে দেরি হলে তুমি চলে যেও। সেক্রেটারি আমার পিছনে আমার শরীরটাকে খুঁজছে দেখে আমি কেত
মেরে বললাম,
“আর ইউ লুকিং ফ’ দ্যাট জেন্টলম্যান? হি লেফট ফিউ
মিনিটস ব্যাক,
ডিডন্ট ইউ সি?”
ছম্মকছল্লু শ্রাগ করে বলল, “ইয়েহ,
মে বি... ওয়েন্ট টু ওয়াশরুম।”
যাক বাবা বাঁচালি।
৮
খুকুমণি দরজা খুলে আমায় দেখে, মানে তার স্বামীর শরীরটাকে দেখে ভয়ানক উদ্বিগ্ন হল, অসময়ে ফেরার কারণ জানতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, কপালে হাত ঠেকিয়ে দেখল জ্বর এসেছে কিনা। আমি তাকে কাছে টেনে
চুমু খেলাম,
সে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঠোঁট মুছে আমার দিকে অবাক হয়ে
তাকাল,
যেন আগে কোনোদিন তার স্বামী অফিস পালিয়ে তাকে আদর করতে
আসেনি। আমি তখনই লক্ষ্য করে দেখলাম খুকুমণি সেদিন যে জামাটা পরেছে তাতে বোতাম নেই, এমনকি ভেতরে হুকের শাসনও সম্ভবত। তার মানে খালি বাড়িতে
খুকুমণি খোলামেলা হয়ে ঘুরে বেড়ায়, অথবা স্বামীর
সঙ্গে তার সম্পর্কটাই নেহাত খোলামেলা হয়ে গেছে। বিয়েবাড়ির রাত-পোহানো বাসি খাবারের
মত, স্বাদের ধ্বক চলে গেছে। বোতাম ও হুকের তুলনামূলক জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রহস্যময়তা পেরিয়ে এসে খুকুমণি যে একদম
ভাল নেই, এই ঘটনাটা বুঝতে আমার তেমন দেরি হল না এবং তার প্রতি অসীম মমতায় আমার বুক
টনটন করে উঠল। শুধু তাই নয় বোতাম ও হুক সম্পর্কিত যাবতীয় পূর্বোল্লিখিত দর্শনও সেই
মুহূর্তে আমার কাছে দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে গেল।
খুকুমণির কোনও সংশয় হয়েছিল কিনা বলতে পারব না, কিন্তু বৈধতার অন্তরাল থাকায় সে আমাকে বিশেষ বাধা দিল না। আমরা পুরোন দিনের
মত নোঙর তুলে মোহনার দিকে নৌকো ছেড়ে দিলাম। সে অঞ্চলে ইতস্তত ম্যানগ্রোভ, অযত্নের শ্বাসমূল, কিছুক্ষণ আগেও যে কুসুম ছিল, আপাতত পাখি, উড়ে গিয়ে নৌকার গলুইয়ে বসল। তার নখ বিঁধে ভিজে কাঠ থেকে নুন ঝরে পড়ল। হাওয়ায় জলের কণা
ভাসছিল এবং নুনের শোষণগুণ অতিরিক্ত ভাল বলে নুনের জল হতে সময় লাগল না। পাখি জলে
ঠোঁট দিতেই
খুকুমণি কেঁপে উঠল, বারংবার ঢেউয়ের ধাক্কায় তার পুরোন সমুদ্রযাত্রার কথা মনে পড়ে গেল।
নৌকোয় চড়লে সে সাধারণত চোখ বন্ধ করে থাকে, একবার চোখ খুলে আমায় জিজ্ঞেস করল, “সত্যি করে বলো তো, নৌকা জল কেটে এগোচ্ছে, না জল পিছিয়ে
যাচ্ছে?” বলে হাসল, যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না, বা কোনো নাছোড় স্মৃতি তার সঙ্গে রঙ্গ করছে। সেদিন ঘাটে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল, নোকোবিহার যতই বিনোদনের হোক, ক্লান্তি আসে। খুকুমণির স্বামীর সঙ্গে যথাবিহিত শরীর
বদলাবদলি সেরে ক্যানিং ফিরে দেখেছিলাম ওস্তাদ হন্যে হয়ে বসে আছে, কখন আমি ফিরব, কখন সে আমার শরীরে ভর দিয়ে আমিনার সঙ্গে পাখি ওড়াবে, সেই রকমই কথা হয়েছিল তার সঙ্গে।
৯
যা বলছিলাম, তখন থেকেই খুকুমণি কর গুনে দেখা শুরু করেছিল, আমায় দেখিয়ে নয়, নিভৃতে,
বিরলে, আমি আড়াল থেকে
দেখতাম। কতবার সে কর গুনেছিল মনে নেই, কিন্তু যখনই তাকে কর গুনতে দেখেছি আমার মন খারাপ হয়ে গেছে, মনে হয়েছে আমি তাকে ঠকাচ্ছি। সে চাইছে পাখির ঠোঁট থেকে ঝরে
পড়া বীজ ফুটে চারা জন্মাক, যেমন ভাবে মাটি আর আকাশের যৌন মিলনে উদ্ভিদের প্রজনন হয়। অথচ আমি ত আকাশ
নই... ওস্তাদের ডেরায় অবশ্য সে’সব সমস্যা ছিল না, আমিনা আমায় ভালমন্দ খেতে পরতে দিচ্ছিল, ডিমের কুসুম, নতুন কাচা গামছা, আমার ওপর তার যত্ন-আত্তি দিন
দিন বাড়ছিল,
ওস্তাদ দেখে মিটিমিটি হাসত। আমিনার ওপরও আমার মায়া বাড়ছিল।
আহা বেচারা, দু-দিন বই তো নয়, ওস্তাদ কবে আছে কবে নেই, ভোগ করে নিক। অবশ্য নিজের শরীরটা যখন ফেরত পেতাম
তখন তার দশা দেখে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যেত, পর্দার আড়ালে কী নরক গুলজার চলছে তার
অল্প-স্বল্প হদিশ পেতাম। খুকুমণির স্বামীও আস্তে আস্তে তার অশরীরী দশা মেনে
নিচ্ছিল,
মেনে না নিয়ে তার কোনও উপায়ও ছিল না, তাকে দেখে আমার রীতিমত করুণা হত।
গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে গেলে কারো বিশেষ কোনও অনুযোগ থাকত
না, কত গল্পই তো এ’রকম নেতিয়ে নিরামিষ হয়ে যায়, লোকে মেনেও নেয়। খুব বেশি হলে, শেষদিকে
কচি করে একটা ট্যুইস্ট রাখা যেত, ধরা যাক কর গুনতে গুনতে খুকুমণির গর্ভসঞ্চার হল,
সেক্ষেত্রে অজাত সন্তানটির পিতৃত্বের দায় কার... আমার না খুকুমণির স্বামীর? পাঠককে
এই ধরণের একটা সংশয়ের মধ্যে ফেলে রেখে অনায়াসে নটে গাছটি মুড়িয়ে দেওয়া যেত। পাঠকও
গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসত, সত্যিই তো, কে মুড়োল? গরু না ছাগল, নাকি গরুর মুখোশ পরা ছাগল? কিন্তু
ইন্দ্রজাল বাস্তবে গল্পর থেকেও বেশি বিস্ময়কর। এটাই চরম সত্য। মাইরি বলছি, পাঠক চাক না চাক, গল্পটা একটা ভণিতা মাত্র, আসলে আমি ইন্দ্রজাল লিখতেই বসেছি।
আসলে তখনও জানতাম না, ওস্তাদের মার শেষ রাতে। দোষের মধ্যে একদিন
ওস্তাদকে বলেছিলাম, যখন আমি খুকুমণির স্বামীর শরীরটা নিই, তার জন্য সাময়িকভাবে অন্য একটা শরীরের বন্দোবস্ত করা যায় না? হাজার হোক সেও তো একটা মানুষ, মানুষের কি শরীর ছাড়া চলে? ওস্তাদ ছদ্ম
বিরক্তি দেখিয়ে হাত উল্টিয়ে বলেছিল, “হুট বলতে একটা আনকোরা শরীর পাব কোত্থেকে? চাস তো আমার কাঠামোটা দিতে পারি,” একটু থেমে যোগ করেছিল, “তুই যদি তোরটা তখন আমাকে ছেড়ে দিস...”, তখনও বুঝিনি
তার আসল ধান্ধা কী।
১০
আমি নিমরাজি হয়েছিলাম।
শেয়ালদায় ট্রেন থেকে নেমে খুকুমণির স্বামীকে খুঁজে পেতে
বিশেষ অসুবিধে হয়নি সে তখন কোলে মার্কেটে চাষীভাইদের কাছ থেকে সবজি কিনছিল। আমাদের
দেখে সে বিলক্ষণ খুশি হল এমন কথা হলপ করে বলা যায় না, কিন্তু আমি আর ওস্তাদ যখন
তাকে একধারে ডেকে নিলাম সে বিশেষ আপত্তি করল না। অনেক সময় পীড়নেও চস্কা লেগে যায়, মনে হয় খেলা, খেলাতে হার
জিত নিয়ে ভাবলে চলে না, অংশ গ্রহণ করাটাই আসল।
আমরা পরস্পরের হাত ধরে গোল হয়ে দাঁড়ালাম। অতঃপর নিরতিশয়
জটিল বৃত্তিয় শরীর-বদলের বৃত্তান্তটি (আমি
খুকুমণির স্বামী
ওস্তাদ
আমি) বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের
ইন্দ্রজালের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা রইল, এমনকি ইন্দ্রাদি দেবতারাও স্বর্গ থেকে পুষ্প বৃষ্টি করলেন। পথচলতি লোকজন অবাক
হয়ে ভাবল আকাশ থেকে গোলাপ টগরের পাপড়ি পড়ছে কী করে, ফুলের গুদোমে কি বিধার্মিক
দুষ্কৃতিরা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কিন্তু বিস্ফোরণ হলে তো শব্দ হবে, আলো ঝলাসাবে। শব্দ,
আলো কিছুই না পেয়ে তারা হতাশ হয়ে মেনে নিল ধর্মের সঙ্গে ফুলের বিন্দুমাত্র বিরোধ
নেই,
শুধু এই প্রমাণের জন্য সঠিক ইন্দ্রজালের প্রয়োজন।



ফেরার পথে একটা গাড়ি ভাড়া করা হল। খুকুমণির স্বামী লোকটা
নিপাট ভদ্রলোক,
তার বিশেষ পছন্দ অপছন্দ নেই, সে ফোকলা দাঁতে হাসল, দেখে শুনে মনে হল ওস্তাদের কানা-মামা শরীর পেয়েই সে
সন্তুষ্ট। আমায় নদীর ধারে
নামিয়ে দিয়ে গাড়ি ক্যানিং যাবে, পাখি ওড়াতে।
খুকুমণির স্বামীকে সুন্দরবনের একটা লঞ্চে বসিয়ে দিলেই হবে, সে ঘন্টা দুয়েক বাদাবন ঘুরে আসবে। আমি ফিরলে তাকে ছেড়ে
দেওয়া হবে।
খুকুমণির সঙ্গে স্নান সেরে বেরোতে বেলা হল, ফেরার সময় মনটা
কু গাইছিল, ওস্তাদ একটা নতুন শরীর পেয়ে কিছু অসৈরণ না করে বসে! ডেরায় ফিরে দেখি, ওস্তাদ আমার চাঁদবদনে লতপত হাসি মাখিয়ে কামরা আলো করে বসে আছে, তার নিজের অষ্টাবক্র
চেহারা এবং
সেই খন্ডহরের অন্দরে খুকুমণির স্বামী লা-পতা। আমি খাটের তলায় উঁকি দিতে গেলে ওস্তাদ পা নাচাতে নাচাতে বলল, “ওখানে নেই।”
১১
দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে দিয়ে তাকে চেপে ধরলাম, “বলো তাকে কোথায় গায়েব করলে?”
সে কিছুতেই স্বীকার করবে না, খালি বলে, “সুন্দরবনের লঞ্চে তুলে দিয়েছিলাম, ফেরেনি,
বাঘে টেনে নে গেছে হয়তো”, শেষে থানা পুলিশের ভয় দেখাতে ভাঙল, বলল,
“ভাবিস না, বান্দাকে
ম্যাজিক-বাক্সয় আটকে রেখেছি।”
আমি ঘরের কোণে রাখা ধাম্পাল বাক্সটার দিকে তাকালাম, ডালাটা কি অল্প নড়ছে? বললাম,
“করেছো কী? লোকটা তো দমবন্ধ
হয়ে মরে যাবে।”
ওস্তাদ আমায় আশ্বস্ত করল, “দূর বোকা,
কিচ্ছু হবে না, যখন চাই আবার ওকে চাঙ্গা করে দেব, তুই বিন্দাস মস্তি কর!”
আর মস্তি, জানাজানি হলে যে
কী কেলেঙ্কারি হবে ভেবেই অস্থির লাগছিল। ওস্তাদকে বললাম, আমার শরীর বাপিস
করো,
অন্যের শরীরে কাঁহাতক বাস করা যায়! বেশিক্ষণ খুকুমণির
স্বামীর শরীরে থাকলে ইদানীং সারা গায়ে লাল লাল, চাকা চাকা আমবাত বেরোচ্ছে।
ক্যালামাইন লাগিয়েও কমছে না। ওস্তাদ কথা বাড়াল না, ঝপ করে আমার শরীর ছেড়ে খুকুমণির স্বামীর শরীরে ঢুকে পড়ল। তারপর আয়নায় চুল-টুল
আঁচড়ে,
বগলে পাউডার ঢেলে, কানের গোড়ায় আতর লাগিয়ে, ঘর ছেড়ে বেরোবার
উপক্রম করছে দেখে বললাম,
“খুকুমণির বাড়ি যাচ্ছ নিশ্চয়ই? তাছাড়া আর কোথায় তার হাজব্যান্ডের শরীরটাকে রাখবে? তবে সাবধান, খুকুমণিকে যদি ছুঁয়েছো, হাত ভেঙ্গে দেব, মনে থাকে যেন।”
ওস্তাদ শয়তানির হাসি হেসে বলল, “কী যে বলিস, সে আমার বেটির মত...!”
১২
ওস্তাদ বেরিয়ে যেতেই আমিনা এল, বলা নেই, কওয়া নেই, জোর করে আমার কোলের ওপর বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরল। আমি বাধা
দিয়ে বলতে গেলাম,
“খুড়ি, তুমি জান না, একমাত্র খুকুমণিকে ছাড়া আমি...”, অবাধ্য ছেলেরা যেমন মাস্টারমশাইয়ের পেছনে বক দেখায় তেমনি
ভাবে আমার কথাকে ব্যঙ্গ করে আমার শরীর (অথবা সরীসৃপ) ফণা তুলে উঠে দাঁড়াল। আমি তার কুলোপানা চক্র দেখে অবাক হয়ে ভাবলাম হল
কী?
এতদিন পরে কি আমার
শাপ কাটল?
সাপ বা শাপ মুক্ত হলে মানুষ সাধারণত খুশিই হয়, কিন্তু আমি বিষণ্ণ হলাম, মনে মনে বললাম,
খুকুমণি আমায় ক্ষমা করে দাও, আমি আর তোমার যোগ্য রইলাম না।
আমিনা আমার চিবুক টেনে বলল, “ভাল করে তাকিয়ে দেখো,
আমি কিন্তু আমি না...”
আমি চোখ বিস্ফারিত করে, “তার মানে?
তুমি কে?”
আমিনা পাড়ভাঙা ঢেউয়ের মত খিলখিল করে হেসে উঠল।
Excellent... wonderful... so poetic...
ReplyDeleteহিন্দোল, কেবলমাত্র এই গল্পটির সঙ্গে মোলাকাত করিয়ে দিয়েছে বলেই আমি আবহমানের দরবারে সময় সুযোগ মত ফের উঁকি দেবার তালে রইলাম। সিদ্ধার্থবাবু, লা-জবাব।
ReplyDelete