খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

গ্রন্থ আলোচনা- বেবী সাউ





        ‘ময়ূর বনের কার্তিক’ -  বাংলার আত্মার কাছে ফেরার কবিতা


কবি অভিজিৎ দত্তের কাব্যগ্রন্থ "ময়ূর বনের কার্তিক" মায়াবী এক কবিতার  বই। অবশ্য মায়াবী বললে খুব কম কিছু বলা হয়। কারণ মায়া অনেকসময়েই এক অসত্য আবহের মধ্যে আমাদের ঠেলে দেয়। আমরা যদি ভালো করে লক্ষ্য করি তাঁর কবিতা, তবে হয়ত পেতে পারি ম্যাজিক রিয়ালিজমের পৃথিবী। এই ম্যাজিক রিয়ালিজম তো লাতিন আমেরিকার মতো না। এ হলো দেশজ। দেশজ আধুনিকতার যে জায়গায় আমাদের ভাষার সৃষ্টিগুলি একসময়ে সৃজনশীল হয়ে নিজেদের প্রতিফলিত করত, ইউরোপীয় আধুনিকতা আসার পর থেকে তা, তার লোকাস পরিবর্তন করে। স্বাভাবিক ভাবেই, ইউরোপীয় আধুনিকতার পথকেই আমাদের সাহিত্যে ধরা হয় আধুনিকতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে। কিন্তু এই ধারণা যে সত্য নয়, তা এখন প্রমাণিত। দেশজ আধুনিকতার যে রাস্তা আমাদের জীবনে, যাপনে ছিল, সেই পথ ধরে হেঁটে গেলে যে কত বিভোর দৃশ্য ও অসামান্য দর্শন আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, তা বলাই বাহুল্য। এ নিয়ে এক স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে, কীভাবে দেশজ আধুনিকতার রাস্তা ছেড়ে ইউরোপীয় আধুনিকতার পথকেই আমরা আধুনিকতার মূল রাস্তা হিসেবে ধরে নিলাম। তা হয়তো এখানেই কখনো আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। কিন্তু এই ভাবনা যে মাথায় এলো, তার কারণ দেশজ আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য হল, তাকে কিছুই চাপা দিয়ে রাখতে পারে না, বা তার অভিযাত্রাকে কিছুই সরিয়ে দিতে পারে না তার রাস্তা থেকে।
যেমন এই বিশ্বায়নের যুগেও পরিবর্তন হয় না বাংলার মাঠ, ঘাট, গাছ, পাখি, প্রকৃতি, পরিবর্তন হয় না বাংলার পুরাণ, শিকড়, কাহিনি,  রঙ, রীতি, প্রথা, তেমন আমাদের আবহমান অবচেতনার স্তরে স্তরে প্রবাহিত হতে থাকে অখণ্ড চেতনার এক ধারা। তাই কবির কবিতায় চলে আসে বিভিন্ন পুরাণের কথা ও কাহিনি। আমাদের লোকগাথাগুলির মধ্যে, বিভিন্ন কাব্যের মধ্যে, রীতিপ্রথা পালনের মধ্যে, গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে যে সব লুকিয়ে থাকা কাকচরিত্র গুনগুন করে ওঠে, তা বয়ে চলেছে ঠিক কত বছর ধরে আমরা কেউ জানি না। অথচ, সেই সব স্বর, সুর, চিত্র, দর্শন মিলিয়েই আমাদের মন। তাই বড় চেনা লাগে। অভিজিৎ দত্তের কবিতা তাই আমাদের শিকড় ধরে টান দেয়। সন্ধেবেলায় পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, এই সব তো বড় চেনা। কিন্তু ভালো করে চিনতে পারছি না কেন। অথচ প্রাণের গভীরে কী যেন ঘাই মারছে। এই যে জগতের পরিসর অভিজিৎ দত্তের তাঁর ময়ুর বনের কার্তিক গ্রন্থে রচনা করেছেন, তা যেন সুদূরব্যাপী এক ইশারার মতো আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদেরও আছে ফেলে আসা এক সময়, আর সেই সময় আমাদের সমসময়ের পাশেই বীরাজ করছে। 
ময়ূরবনের কার্তিক গ্রন্থটিকে বরং বলা যায় এক ধরনের অনুবর্তন। বাংলার যে আত্মার কাছে একসময়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন বিভূতিভূষণ, কমলকুমার, ঋত্বিক ঘটক, সেভাবেই কবি ফিরে যান এক একটি আর্কিটাইপের কাছে। সেই আর্কিটাইপের মধ্যে অনেক কুসংস্কারও যে নেই, তাও নয়। কিন্তু সংস্কারের মতো কুসংস্কারও আমাদের কবিতার এক অংশ, আমাদের যাপনের এক চরিত্র। বাস্তবে যে পথের পাঁচালী সুলভ গ্রামের প্রশান্ত বাস্তবতার চিত্র তিনি এঁকে চলেন, সেখান থেকেই যেন বা প্রবল এক জাম্প কাটে তিনি আমাদের নিয়ে যান কল্পনার জগতে। তিনি তাঁর কবিতায় মিথকে নিজের মতো করে নির্মাণ করেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় সূর্য ও হনুমানের সেই জল খাওয়ার বৃত্তান্ত। সেই মিথকে তিনি এক অদ্ভুত কাব্যিক উচ্চতায় পুনঃনির্মাণ করেন নিজস্ব দক্ষতায়। বলা যায়, সাহিত্যিক ভাষায় এক মিথিকাল প্যারালালিজম ঘটে। মিথকে ব্যবহার করে মিথের পালটা এক মিথের বাস্তবতার কাছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার এই কাব্যিক ডিসকোর্স বাংলা কবিতায় খুব একটা আছে বলে মনে পড়ে না। বলতে পারি বিষ্ণু দে, সুধীর দত্ত, অশোক দত্ত এবং নির্মল হালদারের কথা। 
তাই, নিজের কথাকেই সামান্য পরিবর্তন করে বলতে পারি, মায়াবী ঠিক না, বলা যায় কুহকী বাস্তবতার কথা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এক ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন, যাকে আপনারা ম্যাজিক রিয়ালিজম বলে লাফালাফি করছেন, তা আসলে আমার ছোটবেলা থেকে শোনা বিভিন্ন উপকথা। আমরা সেই উপকথাতে, সেই সব গল্পের মধ্যে বাঁচি। অভিজিৎ দত্তের এই কাব্যগ্রন্থ যেন বা সেই  ভাবনাকেই আবার মান্যতা দিল। আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল আবহমান কাল ধরে শোনা আমাদের সেই সব বাস্তবতার পুনুর্নির্মাণে। 
বেড়াল সাদা আলো,---
বেড়াল নয়,আমি ওই আলো পুষেছি...
 

এই হল অভিজিৎ দত্তের কবিতার মূল আলো। কারণ তিনি আলোর সাধনা করেন, তা একপ্রকার সেই বেড়ালের প্রতীককেই পালটে দেয়। এই প্রসঙ্গে তেমন উল্লেখ করা যায় নিসর্গ কবিতাটির কথাও। বা, বলা যায়,মাতৃকাবর্ণের ব্যবহারে কাকীর উল্লেখ। পুরাণকে ব্যবহার করেও তিনি যেন পুরাণকে নতুন নতুন করে সংজ্ঞা দিচ্ছেন এখানে । এই প্রসঙ্গে একটি কবিতার কিছু অংশ তুলে দিলে মনে হয় আমার বক্তব্যকে আরও নিবিড় ভাবে উপস্থাপনা করতে পারব।

"সম্রাট অশোক নাকি ময়ূরের মাংস খেতেন!
অশোক নন, আসলে অশোকের উদরে লুকিয়ে থেকে এই মাংস খেতেন স্বয়ং অগ্নিদেব ,
হৃদপিন্ডে-ফুসফুসে বসে ক্ষুদ্রান্ত বৃহদন্তের হাঁড়ি থেকে।
 
ধর্মশোক হতে তাকে বরাবরের জন্য ছাড়তে হয়েছিল ময়ূর খাওয়া, কিন্তু অগ্নিদেব ভোলেননি অশোককে।
অশোকফুলে বিরহের বাতাবরণের সঙ্গে
 
মিশে থাকে প্রজ্বলিত অকুপিত অগ্নি।"

এর পাশাপাশি অবশ্যই বলতে হবে তাঁর শব্দচয়ন ও শব্দব্যবহারের কথা। তিনি যেমন অকুণ্ঠভাবে পুরাণের ব্যবহার করেছেন, যেমন ব্যবহার করেছেন সংস্কৃত শব্দ, সম শব্দ, তেমন ব্যবহার করেছেন প্রচলিত শব্দ, কথ্য ভাষাও। একই সঙ্গে, আধুনিক ও চিরকালীন এক ভাষাপ্রবাহের জন্ম দিয়েছেন তিনি এই কাব্যে। ভাষা, উপমা, অলংকারের যে কোনও দেশকাল নেই, তা তাঁর কবিতার মধ্যে বারবার ফুটে ওঠে। বলা যেতে পারে ময়ূরবনের কার্তিক বাংলা ভাষায় এক স্বতন্ত্র ধারার কবিতার আবহমানতাকে আবার আমাদের কাছে হাজির করে। 
কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রচ্ছদ সমান আকর্ষণীয়। 

গ্রন্থ- ময়ূর বনের কার্তিক
অভিজিৎ দত্ত
সিগনেট প্রেস
মূল্য-১০০টাকা




1 comment:

  1. সুন্দর আলোচনা।তবে আর একটা দুটি কবিতাংশ উল্লেখ থাকলে ভাল হত।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...