খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ-কৌশিক গুড়িয়া




তিন বান্দর, সহজ লসাগু ও গসাগু   [] 




খারাপ কিছু দেখ না []

বর্ষায় লকলকে হয়ে উঠেছে পাটের চারা। যেন পুলকিত-যামিনী শস্য-শ্যামলম হয়ে উঠেছে। আমরাও  উদযাপন করছি হরিয়ালি। কাঙ্খিত সবুজ বিপ্লব। চম্পাহাটির এমনই এক ক্ষেতের পাশে দরমার বাড়ি ছিল কিশোরী যমুনা খাতুনের। বাড়িটি অবশ্য এখনও আছে। যমুনার মা একরত্তি মেয়েকে রেখে ভোরের ঝি-লোকালে বাঘাযতীনে আসেন। ন’বাড়ি ঠিকে কাজ সেরে আড়াইটার ট্রেনে বাড়ি ফেরেন। যমুনার আব্বু
মেয়ের-শৈশব বাড়িতে ফেলে সেই যে কেরালায় চলে গেল, আর তার দেখা নেই! ফলে অতি সাধারণ একটি দিনে যমুনার মা বাড়ি ফিরে দেখলেন দরজা আলতো ভেজানো । চোদ্দ বছরের কিশোরী চৌকির আলুথালু-চাদরে মুখ গুঁজে নিথর-শুয়ে আছে। শরীরটাকে উল্টে নিয়ে মা দেখলেন ইলাস্টিক দেওয়া কমদামী প্যান্ট ছেঁড়া, ফ্রকে রক্তের দাগ। মা জানতেন পাড়ার প্রাইভেট মাষ্টার তার মেয়েকে খুব দেখভাল করে। বই কিনে দেয়, সাইকেলের  হ্যান্ডেলে বসিয়ে ইস্কুলে পৌঁছে দেয়। ঘটনার দিন থেকে সেই মাস্টারকে আর খুঁজে পাওয়া যায় নি... ।
কাজ থেকে ফিরে যমুনার মায়ের মাথায় রক্ত উঠে গেছিল। সেটাই তো স্বাভাবিক। সে পাগলের মতো অস্থির হয়ে উঠেছিল। পাড়ার লোকজন ডেকে এনে , ফেন্ট হয়ে পড়ে গেছিল ন্যাতা দেওয়া বাড়ির  চৌকাঠে। জ্ঞান ফিরলে দৌড়ে গেছিল থানার দিকে। মাঝপথে একটি বুলেট এসে তার সামনে ব্রেক কষে   দাঁড়ায়। বলে, যা হবার তো হয়েই গেছে রে। এসব নিয়ে থানা-পুলিশ করতে যাস না। দেখতে পাচ্ছিস তো দিনকাল ভাল নয়..., আমরা টাকা পয়সার ব্যাবস্থা করে দেব। তাকে পাঁচকান করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল।, অদৃশ্য কোন পাথর এসে চেপে বসেছিল তার গলায়।
যমুনার মা এখন কাজে যায় না, পাশের বাজারে একটা ঝুপড়ি দোকান চালায়। ছেলে-ছোকরা তার দোকানে চা খায়, বিড়ি খায়... আর মুক্ত-কণ্ঠে তাদের মোবাইলে বেজে ওঠে বেলেল্লা-সংগীত ! এভাবেই সমাজ বদলায়। এভাবেই জাত-ধর্ম-ভয়-ত্রাণ   সম্মিলিত ভাবে  বোরোলিন হয়ে ওঠে। তীব্র কাটাছেঁড়ার দাগগুলোকেও যেন গায়ে আঁচড়  কাটতে দেয় না।
যেমন এই তো সেদিন, বিখ্যাত মেট্রো-পলে গাড়ির কাচ ফুটো করে ছুটে আসা গুলি
তালগোল পাকিয়ে দিল সুজিত আনসারির শরীর। কেউ কেউ বুঝল, কেউ কেউ জানল কখন কীভাবে গলায় তালাচাবি পড়ে যায় অনায়াসেই। সুজিত কি পত্রকার ছিলেন ?
প্রেসকে কত নম্বর স্তম্ভ বলা হয় যেন ?  ট্রেনের হকার পাঁচ টাকায় এই সব ক্যুইজের বই বিক্রি করেন। তাতে সব লেখা থাকে। শুধু লেখা থাকে না, একজনের কণ্ঠকে  করুণা করা হল ; আরও একজন বীর দু’হাতে চেপে ধরল গণতন্ত্রের
শ্বাসনালী... !
কিন্তু আম আদমি কী করবেন এইবার ? ঘটনাগুলি  কাঁচা চোখে দেখবেন, নাকি
গান্ধিজির পয়লা নম্বর বান্দর হয়েই থেকে যাবেন ? দর্শন থেকেই মস্তিষ্ক বিবেচকের জাগৃতি পায়। তাহলে কী হবে এইবার ? সমাজ কি চম্পাহাটির সেই বিকৃতমনা গ্রামীণ মাষ্টার কে খুঁজে বের করবে , নাকি মেট্রো-পলে দেহ ফুঁড়ে
দেওয়া বুলেটের অগ্নিকর্তাকে প্রাণদণ্ড দিয়ে গোপনেই ভেঙে ফেলবে কলমের নিব ?
আচ্ছা, সমাজ ও সময় কি ব্রেনলিয়া খায়নি শৈশবে ?


খারাপ কথা শুনতে নেই []

সেবার শীত ছিল দীর্ঘতর। প্রকৃতিবিদরা জানেন শীতঘুম দীর্ঘ হলে সরীসৃপদের স্নায়ু অস্থির হয়ে পড়ে। থলিতে  বিপুল বিষ জমেছিল সে বার। ফলতঃ গ্রীষ্মের শুরুতেই মা মনসার সহচররা সংখ্যায় গুরু হয়ে উঠছিল। ভাঙা ইটের ডাঁই,
পরিত্যক্ত কাঠের আড়ত, খড়ের গাদার কাছে ঘেঁষার জো ছিল না। বিষধরের নতুন প্রজন্ম কিলবিল করছিলো সুফলা বাংলায় ! তাদের বেঁকানো ফ্যাঙ যেন নিশপিশ করছিল।
তাই ধর্ম-মতি এক প্রতিবেশী পরিবার আমাদের দু’কামরা  পায়রার খোপটির পাশেই অষ্টপ্রহর শুরু   করেছিলেন। ধর্ম-নিদান , মনসার পাঁচালি, ধুনো ও পোড়া প্রদীপের ধোঁয়ায়  চোখ জ্বালা করছিল অনেকের। সে বছর আমার দু’ক্লাস ছোটো টুবলুর উচ্চ-মাধ্যমিক । দু’দিন পর আর থাকতে না পেরে যজ্ঞ-মণ্ডপে তেড়ে গেছিলেন টুবলুর বাবা। আরও কয়েকজন প্রতিবেশীর অনুরোধে মাইকের শব্দ কিছুটা কমলেও যজ্ঞ থামেনি। ঠিক তার পরের দিন সকালবেলায় টুবলুদের  ফ্লাটের দোরগোড়ায় এক বালতি গু ঢেলে গেছিল  কেউ ! যজ্ঞের হাতযশেই সাপের উপদ্রব কমেছিল কিনা তার গবেষণা হয়নি, তবে একটি বার্তা সেদিন পরিষ্কার হয়ে গেছিল
পাড়ায়। পরিষ্কার হয়ে গেছিল , সমাজের সব কিছু শুনে ফেললে বিপদ আছে। বরং না
শোনার ভান করে থাকাই ভাল। তবে কি অষ্টপ্রহর নাম-কীর্তনের কদর্য শব্দে কানে তুলো দেওয়ার প্রয়োজন ছিল ? যেমনটা গ্রাম্য জালসায় কান-সওয়া হয়ে যায় জনগনের... !
সমগ্র ঘটনাটির গায়ে একটি পয়েন্ট টু বি নোটেড লেগে আছে । বিষয়টি হল , সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের এক সদস্য অপর এক সদস্যকে হেনস্থা করলেন। তার মানে জাত ও ধর্ম এখানে বিবেচ্য নয়। বিবেচ্য কেবল কনিষ্ঠ স্বার্থ । সমাজ যাকে তিলে তিলে ঔরষ দিয়েছে !

তারই ভেজা ঘামে প্রাণ দিতে হয় সৌরি বক্সীকে। রাশিয়ান পুরষ্কারকে বৃথা প্রমাণিত করে একটি বুলেট স্রেফ জিতে যায়। সৌরির কলম কি দুমড়ে যায় ? নাকি সেই কলম মেটামরফিক ভোজালির রূপ পায় ? চেপে বসে দীর্ঘ , ফর্সা , একটি স্বাধীনচেতা কণ্ঠের উপর। আসলে রাজনীতি-নিয়ামকরা যতোই ধর্ম-স্পর্শী হয়ে উঠুন না কেন, সেটা যে ‘চা তো ছুঁতো’ মাত্র হয়ে উঠেছে তা আর বাচ্চাকেও  বোঝানোর দরকার নেই। বরং এহেন সামাজিক শিক্ষাই আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাকে করে তুলবে কুয়ো এবং ব্যাঙের গল্পের সূক্ষ্ম-কুশীলব। আর আমরা, সম্মিলিত জনপুঞ্জ কানে সর্ষের তেল ঢালব, তুলো
গুঁজে শব্দ-নিরোধক করে তুলব প্রতিটি স্নায়ুকোশ।
এ বধিরতাও কি জেনেটিক নাকি ? সাম্যবাদের গুপ্ত কার্তুজের মতো ... ।


খারাপ কথা বলার নয়  []

মানুষ বড় ঘেঁটে আছে আজকাল। এই আবহ, এই আত্ম-শুশ্রূষা মাথায় নিয়ে চালসে-বয়েসের আগেই যদি ‘হল্লা...’ মাচাতে যাও তো বিপদ ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলবেই। সরদার আজমিও অকালে গত হয়েছিলেন।  আন্দোলন তাঁকে পথে নামিয়েছিল ঠিকই, মনের বিভা তাঁর মুখে কথা বসিয়েছিল যেমন। তাই তিনি গত হয়েছিলেন বলা ভুল। আসল কথাটা হল , সরদারজির আলোকবর্তিকার কাছে ম্লান হয়ে যাচ্ছিলেন যারা,  তারাই পথের কাঁটা সরিয়েছিলেন মাত্র। আচমকা লোহার রড তাকে নিঃশেষ করে দিয়েছিল। আক্ষরিক অর্থেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল তাঁর মুখ। মুখ বন্ধ
করতে ব্যবহৃত হয়েছিল মুখোশ ! আচ্ছা ‘মুখোশ’ কি বৃহন্নলার বংশধর, নাকি অবিবাহিত সেই মেজপিসি ?  -- যে শুধু দায় বহন করে। বাড়ির এঁটোকাঁটা গুছিয়েও মন পায় না কোনও সুখী বউঠানের ! হ্যা, সত্যিই তাই। মুখোশের যতোই বহুবর্ণবিভা থাকুক না কেন,ব্যাবহারকারী আসলে একক। বিবিধ ছল ও বল ব্যাবহারকারীর গুপ্ত আয়ুধ। আর প্রতিভার গলা টিপে ধরা তো নতুন কিছু নয়, আর এও নতুন কথা নয় যে প্রকৃত প্রতিভার লাশ গুম  করে পুঁতে ফেললেও একদিন না একদিন তার চারাগাছ জন্মাবেই... । বলুন তো কণ্ঠরোধ করে কি সাতটি তারার তিমিরকে আটকাতে
পেরেছিল কেউ ? তাই, শুধু মনে রাখতে হবে “কণ্ঠরোধ” একটি প্রথামাত্র। আর কে না জানে বলুন, মিনমিনে গলা তোয়ালে পেঁচিয়ে আটকানো গেলেও বজ্রকণ্ঠের কাছে সে তোয়ালে ভিজে ন্যাতা ছাড়া কিস্যু না।
তাই, সাতের দশক থেকে আজও যে ট্র্যাডিশন বহু সফল কবিতাকে সম্পাদকের পেপার-বিনে  ঠাঁই দিয়েছে, তাকে চলতে দাও। কেননা, কোনও না কোনও দিন উৎকৃষ্ট একটি শিল্প, কোনও না কোনও ভাবে তার স্বর খুঁজে পাবেই। ইতিহাস তার সাক্ষী, হৃদয় তার বিচারক। আসলে মানবতার কণ্ঠরোধ একটি তুচ্ছ  ক্রিয়া
মাত্র। অন্তর যাকে আশ্রয় দেয়, মন যাকে ফুরফুরে বাতাসে বেড়াতে নিয়ে যায় তার আবার ভয় কীসের ? ভয় তো ভীতুর বর্ম কেবল ...

সে সবই ছাড়ের যোগ্য। বরং কণ্ঠ ছাড়ো জোরে !



স্ট্যাটুটরি ওয়ার্নিং []  ব্যবহৃত স্থান-কাল-পাত্র সম্পূর্ণ কাল্পনিক 

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...