হাইওয়ে ও একটি
কালো ঘোড়া
আমাদের জাতীয় সড়ক
গুলি আমাদের মানে আমাদের অবস্থান থেকে একটু উঁচুতেই হয়। কারণ অনেক হতে পারে- যেমন
আমাদের ছোঁয়া বাঁচাতে চায় বলে অথবা বন্যায় আমরা ভেসে গেলে যাতে আমাদের আশ্রয়দাতা
হতে পারে। তবে অনেকদিন হল বন্যা ঠিকঠাক আসেনা। বৃষ্টিরা অনিশ্চিত এখানে। তাই
ঘাতকেরা ঘুরে বেড়ায় হাইওয়ে জুড়ে অন্ধকার হলেই। এরকম ভাবতে ভাবতেই সময় সিং হেঁটে যাচ্ছিল এক
অন্ধকার হাইওয়ে ধরে আর ঠিক তখনই এক ঘাতকদলের সামনে পড়ল সে। তবে হাইওয়ে
তো অন্ধকার হতে পারে না। সেতো সময়ের এগিয়ে যাবার সবচেয়ে উঁচু পথ, কোনও পদের হতে
পারবার একমাত্র মাধ্যম। তার সুউচ্চ অবস্থান, তার এগিয়ে যাবার সর্পিল তীব্রতাই তো
সময় সিংদের স্বপ্ন দেখায়। তাদের স্যাঁতস্যাঁতে বেড়ে ওঠা সেই সড়ককে আঁকড়ে ধরেই তো
রোদের সন্ধান করেছিলো। সেই জাতীয় সড়কেই কিনা গুপ্তঘাতক ! ঘাতকদের চেহারাগুলো
কিন্তু চেনা চেনা লাগছে অথচ চিনতে পারছে না সে। সময় সামনে গিয়ে চিনে নেবার আগেই ঘুম ভেঙে গেল ! একি সে
খোলা আকাশের নিচে শুয়ে আছে কেন? মাথাটা এত ভারী মনে হচ্ছে কেন? সে কোনমতে উঠে
দাঁড়াল।পাশ দিয়েই একটি রাস্তা চলে গেছে মনে হয়। সে রাস্তার ধারে কি করে পৌঁছল? মনে
করার চেষ্টা করতেই দূর থেকে একটা তীব্র আলো এসে পড়ল মুখে। মনে পড়েছে! মনোজ ! মনোজ
কোথায়? পুলিশ ! পুলিশ ! পুলিশ এনকাউন্টার করেছে মনোজকে! সে নিজে তো ছুটে পালিয়ে
এসেছে খেতের পর খেত পেরিয়ে। ভাবতে ভাবতেই আলোটা একেবারে সামনে এসে গেল। একটি জিপ
থেকে নেমে এল তিনটি লোক ! তাদের একজনের হাতে ছুঁড়ি আরেকজনের হাতে পিস্তল আরেকজনের
হাতে দড়ি। এবার কিন্তু তিনজনকেই চিনতে পারল সময়-ওরা সুমিত, অম্বর আর দীপক ! সময়
তাদের প্রতিরোধ করার বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেনি, সময়ের কাছে ঘাতকদের প্রতিরোধ করার
মত কোনও অস্ত্রই ছিলনা। তাই সে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে পালিয়েছিল তাদের হাত থেকে। সে
আবার হাইওয়ে ধরে উল্টোদিকে দৌড়তে লাগলো। ঘাতকের দলও তার পিছু পিছু। সময় সিং ছুটছে
তো ছুটছেই, ছুটছে তো ছুটছেই। একসময় সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে প্রায়। তখনই সে ঠিক করে
যে আর হাইওয়ে ধরে দৌড়নো যাবে না। সে হাইওয়ে থেকে অনেকটা নিচে ও অনেকটা দূরে একটা
গ্রামের দিকে নেমে যায় ঘাতকের দল থেকে বাঁচতে। ঘাতকের দলও সেদিকে নেমে যায়।
তীব্র ক্লান্তির
মধ্যেও সময় সিং অনুভব করল যে হাইওয়েতে যেমন কঠিন অন্ধকার কালো পিচের মত জমাট বেঁধে
ছিল এই গ্রামটিতে কিন্তু সেরকম নয়। এখানে এই ভররাতেও কেমন ভোরের মত আলো মেখে আছে
যেন। তবে কি পূর্ণিমারাত। আকাশের দিকে তাকায় সময়। নাতো চাঁদ তো নেই আকাশে তবে কালো
ছায়ার মত গাছের মাথাগুলো দাঁড়িয়ে আছে। গ্রামটিতে যতনা ঘরবাড়ি তারথেকে অনেক অনেক
বেশি শুধু গাছপালাই দেখা যাচ্ছে ঠিক নিজের গ্রামের মতই। এখানেই আমি আশ্রয় পেতে
পারি, এখানে লুকিয়ে যেতে পারলেই ঘাতকের দল আর খুঁজে পাবে না – এটা বিশ্বাস করতেই
মনে বল পেল সময় সিং। ভাবতে ভাবতেই সে ভাঙাচোরা বেড়া ডিঙিয়ে একটি ঘরের ভিতরে ঢুকে
গেল। সেখানে একজন শীর্ণকায় প্রবীণ বসে রুটি চিবাচ্ছিলো। পাশেই বসে একজন প্রবীণা
সম্ভবত তারা স্বামী-স্ত্রীই হবে, হাতায় তুলে কোন রান্না করা সব্জি ঢেলে দিচ্ছিল।
সময়কে দেখে তারা মনে হল তেমন ঘাবড়ে গেল না। শুধু লোকটি জিজ্ঞেস করল কে তুই?
‘আমি সময় সিং।
কিছু লোক আমায় মারতে চায়! কিন্তু আমি বাঁচতে চাই! আমাকে
বাঁচান!’
প্রবীণ লোকটি তার
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে রইল এক মুহূর্ত কিন্তু মুখে কিছু বলল না। মহিলাটি কি বুঝল
জানিনা তবে সে পাশের ঘরের দিকে ইশারা করে বলল- ওই ঘরে গিয়ে লুকিয়ে পড়।
সময় সিং কোনও
কিছু না ভেবেই পাশের ঘরে ঢুকে গেল।
বেশকিছুক্ষণ পরে
ঘাতকের দলটি সেই বাড়িটির কাছে চলে এল সময়কে খুঁজতে খুঁজতে। ঘরেও ঢুকে পড়ল। বৃদ্ধ ও
বৃদ্ধা দুজনকেই আলাদা আলাদা করে জিজ্ঞেস করল সময় সিং এর বর্ণনা দিয়ে যে তারা
দেখেছে কিনা। দু’জনার ‘না’য়ে বিশ্বাস না করে তারা পাশের ঘরটিতেও ছাপা মারল। ঘরটিতে
একটি চারপায়া ছাড়া আর কোনো আসবাব দেখতে পেলনা তারা। সেটার নিচে উঁকি মেরে দেখল, কিছু
পেল না। শুধু এক কোণে এক বসে থাকা ধ্যানমগ্ন মানুষ-প্রমাণ সাইজের একটি বুদ্ধ
মূর্তি রাখা আছে। সেদিকে তাকাতেই আলো-আঁধারে মিলে এল অদ্ভুত ছটা যেন চোখে জ্বালা
ধরিয়ে দিল ঘাতক দলটির। তাড়াতাড়ি অস্ত্র উঁচিয়ে বেরিয়ে গেল তারা ঘর থেকে। যাবার আগে
গৃহমালিকদের আরেকবার শাসিয়ে গেল।
এবার আমরা সেই
ঘাতকদের পিছু পিছু প্রায় বেশ কয়েক বছর পিছিয়ে যাই। আলো ফেলে দেখি সময়ের কৈশোর থেকে
ক্রমশ যুবক হয়ে ওঠার দিনগুলিতে। বাবার খেতি-জমিতে চাষের কাজের ফাঁকে ফাঁকে গ্রামের স্কুল
থেকে মেট্রিক পাশ করে ভালোভাবেই। ফার্স্ট ডিভিশন মার্ক পেয়েও হায়ার সেকেন্ডারিতে
ভর্তি না হয়ে, স্কুলের এক মাস্টারমশাইয়ের পরামর্শে সরকারী আই টি আই কলেজে ভর্তি হয়
ফিটার ট্রেড নিয়ে। থিয়োরি ও প্র্যাক্টিক্যাল ক্লাসে তার মনোযোগ দেখে বিভাগাধ্যক্ষের
স্নেহভাজন হয়ে ওঠে শীঘ্রই। কারিগরি শিক্ষায় যতটা পারা যায় পারদর্শী হয়ে চাকরির
উদ্দেশ্যে সময় সিংও মনপ্রাণ দিয়ে খাটতে থাকে। প্রথম বর্ষে রীতিমতো ট্রেড-টপার হয়।
ফাইনাল বর্ষেও সেই রেজাল্ট বজায় রাখতে আরও মন দিয়ে পড়াশোনা করতে থাকে।
প্র্যাক্টিক্যালেও যে তার ধারেকাছে কেউ নেই সেই আত্মবিশ্বাস দুবছরে সে অর্জন করে
নিয়েছে নিজের আগ্রহ দিয়ে। যেকোনো জব্ সে পারফেক্ট ডাইমেনশান ও পারফেক্ট কোয়ালিটি
মাফিক মুহূর্তেই বানিয়ে দিতে পারে। তারপরেও সে অন্যদের জব্ তৈরিতে সাহায্য করে
দেয়। কিন্ত ফাইনাল রেজাল্ট বের হতেই দেখা গেল ট্রেডটপার হয়েছে রাকেশ কুমার যে কিনা
প্রথম বর্ষে প্রথম তিনজনের মধ্যেই ছিলনা। প্র্যাক্টিক্যাল পরিক্ষাতেও সে সময়ের
সাহায্য নিয়ে কোনরকম ভাবে জব্ ফিনিশড করেছিল। অথচ তিন নম্বরের পার্থক্য নিয়ে সময়
সিং দ্বিতীয় হয়। রেজাল্ট পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ে সে।
ট্রেডটপার হলে পরবর্তী সরকারী চাকরির পরীক্ষায় না বসেই
সরাসরি চাকরী পেয়ে যেত সে – এই আশা মনে মনে পোষণ করেছিল দু’বছর ধরে। সেইমতো
খেটেছেও। অভাবের সংসারে একটা চাকরী যে কি ভীষণ জরুরী সে বুঝতে পারে। এরপর চাকুরীর পরিক্ষার
জন্য প্রস্তুতি ছাড়া আর কোনও উপায় নেই। যাই হোক কি আর করা যাবে- এই ভেবেও সে একবার
প্রিন্সিপালের সাথে দেখা করতে যায়। সময় সিংকে দেখে প্রিন্সিপাল পিঠ চাপড়িয়ে সাবাসি
দেয়। সময় তবু উদাস। ‘এখন চাকরির জন্য মেহনত কর বেটা। চাকরি পেতে হবে। অবশ্য
পরীক্ষায় বসলেই তুই চাকরী পেয়ে যাবি জানি, তোদের তো রিজার্ভেশন আছেই !’ প্রিন্সিপাল যেন নিশ্চিত
অভয় দেন সময় সিংকে। এটা সাবাসি না খোঁচা সময় সিং ঠিক বুঝতে পারলো না। সে চুপচাপ
দাঁড়িয়ে আছে।
‘কি হল সময় কিছু
বলবি?’
‘না স্যর! আসলে
আমি পরীক্ষাতো ভালোই দিয়েছিলাম। প্র্যাক্টিক্যালও দুর্দান্ত হয়েছিলো। আশা করেছিলাম
যে গতবারের মত এবারও ট্রেডটপার হব। কিন্তু...’
‘আরে বাবা তিন
নম্বরেরই তো ফারাক মাত্র ! সেকেন্ড তো হয়েছিস !’
‘তা ঠিক স্যর
তবুও ট্রেড টপার হওয়াটা খুব জরুরি ছিল আমার জন্য।’
‘এত উদাস কেন
হচ্ছিস তুই ! আরে তফসিলি জাতিদের মধ্যেতো প্রথম বানিয়েছি তোকে। আর কি চাই !’
‘মানে ?’
‘দেখ সময়, রাকেশ
কুমার যে ট্রেডটপার হয়েছে সে জেনারেল কাস্টের। তুই সিডিউল্ড কাস্টের। এস সি কোটার
মধ্যে তো তুই টপার হয়েছিস, নাকি ...’
এটুকুর মধ্যেই
প্রিন্সিপালের কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরেই যেন মাথার মধ্যে দপ্ করে আগুন জ্বলে উঠল
সময় সিং এর। আরকিছু কানে শুনতে পাচ্ছিল না সে, চারিদিকে যেন একঝাক ফাইটার প্লেন
ছুটে যাচ্ছে মাথার ঠিক উপরেই। নিজেকে সামলে নিতে গিয়ে হয়ত একটা খিস্তিই বেরিয়ে
আসতো মুখ দিয়ে কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়েই চট করে বেরিয়ে এল প্রিন্সিপালের অফিস
থেকে।
একটু জ্ঞান হতেই
সমাজের মাহোল দেখে এটুকু বুঝতে পেরেছিল যে তারা সমাজের সবচেয়ে নিচুজাতের লোক।
পেশাগতভাবে তার বাবা একজন প্রান্তিক চাষি হলেও অন্যান্য জাতির লোকেরা তাদের চামার
পরিচয়েই জানে। এরকম আরও অনেক ভাগাভাগি আছে তাদের মত নিচু জাতের মধ্যেও। ছোটো যখন
ছিল সে কিছুতেই বুঝত না যে সেই সব সমাজের অনেকেই হয়ত আর বংশানুক্রমিকভাবে সেই কাজ
করে না তবু তাদের পরিচয় সেই পেশার নামানুসারেই রয়ে গেছে কেন আজও! বাবা ঠাকুরদার
কাছে সে বিষয়ে জানতে চাইলে সে জানতে পারে প্রাচীন ভারতে পেশার উপর ভিত্তি করে যে
জাতিভেদপ্রথার প্রচলন হয়েছিল সেই প্রথাই আজও বিদ্যমান। ধীরে ধীরে সে আরও জানতে
পারে যে প্রাচীনকালে সেই বর্ণভেদ প্রথার ফলে তাদের মত নিচু বর্ণের লোকদের বাকি
উচ্চবর্ণের লোকেরা কীরকম হীনচোখে দেখত। নিম্নবর্ণের সমাজের প্রতি উচ্চবর্ণের
সমাজের নানা অত্যাচার ও অবহেলার কথাও শুনতে পায়। যেমন সার্বজনিক কুয়ো থেকে আর সব
জাতির লোকেরা খাবার জল সংগ্রহ করতে পারলেও নিচু বর্ণের লোকেরা তা পারত না। তাদের
মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল- এরকম অনেক বিধিনিষেধ জারি ছিল নিচু বর্ণের সমাজের
জন্য। বলতে গেলে সমাজের মূল স্রোত থেকে তাদের একরকম সরিয়েই রেখেছিলো উঁচু বর্ণের
লোকেরা। যদিও সেই ব্যবস্থার অনেক পরিবর্তন হয়েছে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পরে তবু
এখনও তার কিছু কিছু ছায়া রয়ে গেছে তার নিজের বেড়ে ওঠা সমাজের চারপাশে। তবে যতটা
অমানুষিক সব গল্প সে পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শোনে ততটা কিন্তু সে দেখতে পায়না
বর্তমান সমাজের মধ্যে। তাই স্কুলে, কলেজে আর সব জাতির ছেলেপুলেদের সাথে যখন একসাথে
ওঠে বসে নিজেকে আর অচ্ছ্যুত মনে হয় নি কখনো। কিন্তু আজ প্রিন্সিপালের ঐরকম
খোঁচামারা কথা আর বিদ্রুপপূর্ণ সাবাসির পরে যেন এক চোরা বিভেদরেখা টের পেল সে।
একটা অভিমান দলা পাকিয়ে উঠল গলা দিয়ে। অভিমানের দলাটাও কোনমতে গিলে নিল সে। তারপর
থেকে একটা কথাই কানে বাজতে লাগল নিরন্তর- ‘আরে তফসিলি জাতিদের মধ্যেতো প্রথম
বানিয়েছি তোকে।’
একি, তার মানে
ট্রেড টপার যে হয়েছে তাকে কি তবে বানানো হয়েছে, সে নিজের যোগ্যতায় হয়নি! মানে টপার
বানানো তবে কারো যোগ্যতার উপর নয়, অন্য কারোর ইচ্ছের উপর নির্ভর করে। প্রিন্সিপাল, প্রিন্সিপাল, হ্যাঁ প্রিন্সিপালই তবে ইচ্ছে
করে তাকে টপার বানায়নি ! ষড়যন্ত্র ! নিশ্চিত এটা ষড়যন্ত্র! ভাবতে ভাবতে চারদিকটা
অস্বচ্ছ ধোঁয়াশায় ঢেকে গেলো কেন? কালো ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে কেন চলার পথ ? সে কি আর
এগোবে নাকি বসে পড়বে কোথাও! না এগোতে হবেই! পড়ে যাবে না তো চলতে চলতে ? এইসব ঘোরের
মধ্যেই সে একটি ক্যানালের পাড়ে এসে বসে পড়ল। গলা যেন শুকিয়ে আসছিল। একমাত্র জলই পারে তার তৃষ্ণার জ্বালা
মেটাতে। দুহাতে আঁজলা করে ঢক্ ঢক্ করে ক্যানালের ঠাণ্ডা জল খেল সে। চোখে মুখে
ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে শার্টের কোনা দিয়ে মুখটা মুছে নিল। ক্যানালের ওপারে দৃষ্টি
যেতেই দেখতে পেল দূরের হাইওয়েতে ছুটে যাচ্ছে গাড়ির ভিড়। হাইওয়ের একদিকে রাজধানী
আরেকদিকে হিমালয়! এ পথের যাত্রী জানে কখন তাকে কোন্দিকে যাত্রা করতে হবে। সময়ের
দৃষ্টিতে স্বচ্ছতা ফিরে এল।
চারবছর প্রায় হয়ে
গেছে, চাকরির জন্য আর পরীক্ষায় বসেনি সময় সিং, প্রস্তুতিও নেয়নি। বাপের যে দু’চার
বিঘা জমি আছে তাতেই শ্রম দেয় আর বাকি সময় নানারকম সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজকর্মের
সাথে জড়িয়ে থাকে। সে এখন সচেতন ভোটার , সে জানে কোন রাজনৈতিক দল তার ও তার সমাজের
পাশে এসে দাঁড়াবে,তাদের হয়ে লড়বে! তাই সেও মনপ্রান দিয়ে সমাজ সংগঠনের কাজে লেগে
থাকে। যেখানেই তাদের সমাজের প্রতি কোনও অন্যায় ও অবিচার দেখে দলবল নিয়ে তার
প্রতিরোধ করে। ধীরে ধীরে সে সমাজের একজন যুবনেতা গোছের হয়ে উঠতে লাগল।
সময় তখন বাইশ
বছরের সুঠাম এক যুবক। গ্রামেরই একজনের বিয়ের বরযাত্রী যাচ্ছে সবাই অন্য একটি
গ্রামে। মাঝে পেরতে হবে বিশ্বপতি নামের একটি গ্রাম। সেই গ্রামে পৌঁছতেই বরযাত্রির
দল বাঁধা পেল। উঁচুজাতি প্রাধান্য সেই গ্রামের একদল লোক নিচুজাতির বরকে ঘোড়ায় চড়ে
সেই গ্রামের রাস্তা দিয়ে যেতে দেবে না। তাদের বক্তব্য ঘোড়ায় চড়ে বিয়ে করতে যাবার
অধিকার একমাত্র উঁচু জাতির লোকেদেরই আছে। যদি এই রাস্তা দিয়ে যেতে হয় তবে ঘোড়া
থেকে নেমে যেতে হবে। বরযাত্রীরা প্রতিবাদ করে- বর ঘোড়া থেকে নামবে না! দু’পক্ষের
মধ্যে বাদনুবাদ চলতে থাকে। সময় সিং ও তার দলবল তীব্র প্রতিরোধ করে এগিয়ে যেতে গেলে
প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায় পরিস্থিতি। এর মধ্যেই খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশের
একটি টিম চলে আসে ঘটনাস্থলে। দু’পক্ষকে শান্ত করিয়ে আলাদা আলাদা করে তাদের বক্তব্য
শুনল। কোনও পক্ষকেই যখন তারা মানাতে পারল না তখন পুলিশ অধিকারী বরপক্ষকে অন্য একটি
বিকল্প রাস্তা দিয়ে যাবার আদেশ করল। সময় সিং ও তার দলবল প্রতিবাদ করে বলল তারা কেন
যাবে শুধু শুধু চার কিলোমিটার ঘুরপথে? আর পুলিশ কি করে উঁচু জাতির অন্যায় আবদারকে
প্রশ্রয় দিচ্ছে? পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হতে থাকে। এদিকে বিয়ের লগ্ন পেরিয়ে যাবার
ভয়ে বরকর্তা পুলিশের আদেশ মেনে নেয় এবং বরযাত্রীদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঘুরপথেই এগিয়ে
যায়।
স্বাধীনতার দীর্ঘ
লড়াই জাতি সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশের সমস্ত জনগণকে একজোট করলেও আভ্যন্তরীণ
বর্ণভেদের নোংরা প্রথার কোনও পরিবর্তন হত না যদি না বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের
মতন একজন নেতা নিপীড়িত, দলিত সম্প্রদায়ের হয়ে আন্দোলন না করতেন ও সংবিধানে বিশেষ
আইন প্রণয়ন করে তাদের সামাজিক অধিকারকে সুরক্ষা না দিতেন। আজ দেশ স্বাধীন হয়েছে
প্রায় সত্তর বছর। বর্ণভেদপ্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথে দলিতদের সামাজিক অবস্থানের
ধীরে ধীরে অনেকটাই পরিবর্তন হয়েছে। শিক্ষা ও পেশার ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ তৈরি
হয়েছে। যুগে যুগে অপমান ও হীনমন্যতার চাপে প্রায় প্রস্তরীভূত হতে যাওয়া
আত্মবিশ্বাস ফিরে আসতে শুরু করেছে ক্রমশ। উচ্চবর্ণের মানুষেরা আর নিজেদের সুবিধেমতো
তাদেরকে ব্যবহার করতে পারছে না বরঞ্চ আর্থিক ও সামাজিক দিক থেকে তাদের সমানে সমানে
উঠে আসছে দলিতেরা। এটা কেন সহ্য হবে সেইসব গোঁড়াদের! তাই এখনও সেইসব সংকীর্ণ
কিছু মানুষের মধ্যে শেকড় গেঁড়ে থাকা ছুঁৎমার্গ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ছোটবেলায় সে
বুঝতে পারত না তাদের সমাজে বাবাসাহেব কে নিয়ে কেন এত মাতামাতি করে, কেন তাদের সমাজ
তাঁকে ভগবান বলে মানে? এখন সব বুঝতে পারে
সময় সিং ! এসব ভাবতে ভাবতে তাকে ঘোড়ারোগে ধরে। একটি ঘোড়া কিনবে মনস্থির করে সে।
বাবাকে বলতেই ধমক খেতে হয়,তাদের অভাবের সংসারে ঘোড়া কেনা ও তাকে পালা যে হাতি
পালার সমান ! তবু সে জেদ ধরে থাকে। ‘আচ্ছা ঘোড়া না কিনে তোকে বাইক কিনে দেব!’
সময়ের বাবা সময়কে তার আবদার থেকে বিরত করার চেষ্টা করে। কিন্তু সময় যে অনড় ।
‘ ঘোড়া কিনে ঘোড়া
সামলাতে পারবি তো?’ বাবা প্রশ্ন করে সময়কে।
‘ঠিক সামলে নেব ,
তুমি কিনে দাও।’ সময়ের গলায় আত্মবিশ্বাস।
সময়ের জেদের কাছে
আত্মসমর্পণ করে শেষে কষ্টেসৃষ্টে একটি কালো ঘোড়া কিনে দেয় তার বাবা। নিজের
উদ্যোগেই চোট খেয়ে খেয়ে ঘোড়ার রাশ ধরতে শিখে যায় সময় সিং। এরপর ঘোড়াই তার বাহন !
গ্রামের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত , এ গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ঘোড়ায় চড়েই ছুটে বেড়ায়
সে নিজের কাজে হোক বা সমাজের বা দলের যেকোনো কাজে।
ঘোড়ায় চড়লে আজকাল এক নতুন অনুভূতি হয় সময় সিংএর- নিজেকে
রাজা বলে মনে হয়, আত্মবিশ্বাসও বেড়ে যায় তার প্রচণ্ড! মনে হয় এমন কোনও কাজ নেই যে
সে পারবে না ! ঘোড়া যখন ছুটতে থাকে ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দের সাথে সাথে তার স্বপ্নগুলোও
যেন টগবগ টগবগ করে ফুটতে থাকে মাথার ভেতর। এই জন্যই কি উঁচু জাতের লোকেরা
নিচুজাতের লোকেদেরকে ঘোড়ায় চড়তে দিত না যাতে তারাও স্বপ্ন দেখার সাহস করতে না পারে
! তারাও স্বপ্নের পিছনে ধাওয়া করে স্বপ্নকে ছুঁতে না পারে! না সময়কে কেউ আর আটকাতে
পারবে না। কোনও স্কুল-কলেজের প্রিন্সিপালও না ! রাস্তার উপর একটা জটলা দেখে ঘোড়ার
রাশ টেনে ধরে সময় সিং , ভিড়ের কাছাকাছি এসেই থেমে যায় তার ঘোড়া কাল্লু ! এতো
বিশ্বপতি গ্রামেরই সুমিত, অম্বর, দিপক আর সব ! এত স্পীডে ছুটছিল সে ঘোড়া নিয়ে যে
এক লহমায় চলে এসেছে এই গ্রামে ! নিজেই অবাক হয়ে যায় সময়! এত জোরে তো ছুটেনি সে
কোনোদিন! এরমধ্যেই ভিড়টি ঘিরে ধরে তাকে ও কাল্লুকে। কি ব্যপার জানতে চায় সময়।
‘দেখ সময়,অনেকদিন
হল তোর বাড়াবাড়ি দেখতে পাচ্ছি আমরা। ঘোড়া ছুটিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিয়ে ধুলো
উড়িয়ে যাওয়া আসা করবি আর আমরা ছেড়ে দেব? ভাবলি কি করে?’ দলের পাণ্ডা সুমিত আঙুল
উঁচিয়ে সময়কে শাসায়।
‘কেন? রাস্তাটা কি
কারও একার নাকি কারও বাপের সম্পত্তি ?’ সময় সিং পাল্টা প্রশ্ন করে।
‘শালা তবে কি তোর
বাপের সম্পত্তি? সেদিনও বারাত নিয়ে যাচ্ছিলি ঘোড়ায় চড়িয়ে! তার ওপর তুইই বেশি করে
নেতাগিরি করছিলিস!’ বলতে বলতে অম্বর নামের ছেলেটি এগিয়ে আসে।
ভিড়ের আর একজন
জামার কলার ছুঁতে না পেরে সময়ের হাত ধরে টেনে নামাতে চেষ্টা করতে করতে বলে-
‘নিচুজাত নিচুজাতের মত থাকবি !’সময় সিং এক ঝটকায় ফেলে দেয় তাকে। সাথে সাথে পুরো
ভিড়টাই ছেঁকে ধরতে যায় সময় সিংকে। পরিস্থিতি অনুকূল নয় বুঝতে পেরে কাল্লুকে ইশারা
করে সময় সিং ! কাল্লুও ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়। সময় সিংকে ধরতে না পেরে ছুটে পালিয়ে
যেতে থাকা সময়ের উদ্দেশ্যে ভিড় থেকে চিৎকার করে শাসানি ছুঁড়ে দেয় যে- ‘এরপর যদি তুই
এগ্রামে ঘোড়া ছুটিয়ে আসিস তবে কুকুরের মত তাড়িয়ে তাড়িয়ে মারব ! মনে থাকে যেন!’...
সময় ধুলোর মধ্যে মিলিয়ে যায়।
এখন সমাজকে আরও
বৃহৎ মাপে সংগঠিত করতে উঠেপড়ে লেগেছে সময় সিং। দূর দুরান্তের গ্রামের দলিতদের
মধ্যেও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে সে তার কাজকর্মের মাধ্যমে। নতুন নতুন
যুবক-যুবতীদের আত্মসচেতন ও নিজ নিজ অধিকার
বুঝে নেবার জন্য রাজনৈতিকভাবে সমর্থ করে তোলার সাথে সাথে সময় উপযোগী শিক্ষার
ক্ষেত্রে উৎসাহিত করার জন্যও একটি টিম তৈরি করেছে। তবে সব কর্মকাণ্ডের মধ্যেই মূল
যে কথাটি সময় সিং বোঝে সেটি হল ক্ষমতা। মাত্র বাইশ বছর বয়সেই সে বুঝে গেছে যে
দলিতদের সামগ্রিক উন্নতি একমাত্র রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা লাভের মাধ্যমেই হতে পারে। তার
জন্য প্রত্যেক দলিতকে ভারতীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোয় তাদের অবস্থান ও গুরুত্বও বুঝতে
হবে। এই যে ভারতবর্ষের ইতিসাহের মত বৃহৎ
উঁচু প্রাচীর দিয়ে বহু যুগ যুগ ধরে উঁচু বর্ণের লোকেরা দলিত সম্প্রদায়কে বিভিন্ন
সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে আর সেই অভিমানে হোক বা সংবদ্ধভাবে এর বিরোধিতা
করতে না পেরেই হোক ক্ষমতার প্রতি মোহমায়া ত্যাগ করে প্রান্তিক হয়ে থেকেছে,
বৈরাগ্যের সাধনা করেছে - এটা তো শুধুমাত্র কোনও সামান্য অবহেলিত ইতিহাস নয়! এটা
ছিল একটা গভীর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র ! এখনো এই গণতান্ত্রিক দেশে তাদেরকে ক্ষমতার
অলিন্দে ঘেঁষতে দিতে চায় না। এখনও সুযোগ পেলে ‘অযোগ্য’ দেগে ঠেলা দিয়ে ফেলে দিতে
চায় উচ্চবর্ণের লোকেরা। কিন্তু সময় সিং বোঝে এখন এই কৃচ্ছসাধনের পথ ছেড়ে ক্ষমতার
সিঁড়িতে পা রাখতে হবে। সেই ক্ষমতা লাভের একমাত্র উপায় হল রাজনৈতিক ভাবে এক ছাদের
তলায় আসা। তার জন্য যদি বাঁধা আসে লড়াইয়ের জন্যও প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের। একটি
কর্মশালায় এসব কথাগুলোই বোঝাচ্ছিল সময় সিং প্রায় তারই সমবয়সী ছেলেমেয়েদেরকে। তখনই
গ্রামেরই বিবেক নামে একটি ছেলে ছুটে এসে খবর দেয় যে- ওদের গ্রামে পাশের বিশ্বপতি
গ্রাম থেকে একটি জুলুস (শোভাযাত্রা) ঢুকেছে ! সেই নিয়ে গ্রামের কয়েকজন আপত্তি
জানানোয় দু’দলের মধ্যে বচসার পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ খবর পেয়ে সময় সিং দলবল
নিয়ে ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। দু’দলকেই শান্ত করিয়ে বচসার কারণ বুঝতে পারে। বিশ্বপতি
গ্রামের লোকেরা তাদের সম্প্রদায়ের এক মহান ঐতিহাসিক নায়কের জন্মদিন উপলক্ষে তার
মূর্তি নিয়ে জুলুস বের করে পরিক্রমায় বেরিয়েছে। তাই এ গ্রামের দলিত সম্প্রদায়ের
কিছুকিছু লোকের বক্তব্য যে সেই জুলুসের সাথে তাদের যখন কোনও দেওয়া নেওয়া নেই তবে
কেন এ গ্রামের মধ্য দিয়ে সেই জুলুস পরিক্রমায় যাবে? সময় সিং এবার এগিয়ে যায়
জুলুসের ভিড়ে , গিয়ে দেখে জুলুসের নেতৃত্বে সেই অম্বর, সুমিত, দীপকেরা ! সময় সিং
তাদের বোঝায় যে- এ গ্রামের কোনও দলিত যখন ঘোড়ায় চড়ে বরযাত্রীসহ বিশ্বপতি গ্রামের
রাস্তা দিয়ে বিয়ে করতে যেতে পারে না বা অন্য কাজেও ঘোড়ায় চড়ে যেতে পারে না তখন
ওরাও যেন ওদের ধর্মীয় জুলুস নিয়ে দলিতদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে না যায়। ভালোয় ভালোয়
তাদের জুলুস ঘুরিয়ে নিয়ে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। একথা শুনে জুলুসের অগ্রভাগে
থাকা নেতারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তেড়ে যায় সময় সিংএর দিকে। হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।
মুহূর্তের মধ্যেই সময়ের দলবলরাও ঝাঁপিয়ে পড়ে। একমুহূর্ত সময় নষ্ট না করে জুলুসের
মধ্যে থাকা গাড়ির ভেতর থেকে লাঠি রড বেরিয়ে আসে। একটি গুলির আওয়াজ শোনা গেল। বিশ্বপতি
গ্রামের লোকেরা যে পুরোপুরি লড়াই এর জন্য তৈরি হয়েই এসেছে এটা বুঝে আশপাশের
বাসিন্দারা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাতের কাছে যে যেটা পেল তা দিয়েই প্রতিরোধ করতে
ঝাঁপিয়ে পড়ল।
রক্তক্ষয়ী
সংঘর্ষে দুপক্ষেই বেশ কয়েকজন গুরুতর আহত হয়। তবে সময়মত পুলিশ ফোর্স চলে আসায়
প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। চোট থেকে সেরে উঠে সবাই স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে এসেছে
ধীরে ধীরে। সময় সিং প্রায় আট-দশ দিন কাল্লুর পিঠে চড়তে পারেনি হাতে চোট থাকায়। আজ
সন্ধ্যা নাগাদ কাল্লু সময়কে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে গ্রামের রাস্তায়। হাঁটতে হাঁটতে
সে দেখল বিশ্বপতি গ্রামের দিক থেকে একটি গাড়ি এ গ্রামের দিকে আসছে। ক্রমশ কাছে
আসতে বোঝা গেল যে সেটি পুলিশের ভ্যান। ভ্যানটি এসে সময় সিং এর সামনেই দাঁড়াল।
পুলিশের সাথে বেশ উত্তেজিত কথা বার্তা হতে দেখে আশপাশ থেকে লোকজন ভিড় করে। কাছে
গিয়ে জানতে পারে যে সময় সিং সহ এ গ্রামের আরও দশজনের বিরুদ্ধে দাঙ্গা লাগানোর
অপরাধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
দেখায় ও সময় সিংকে পুলিশের কাজে সাহায্য করতে বলে। সময় সিং পুলিশের কাছে জানতে চায়
যে তাদের তরফ থেকে বিশ্বপতি গ্রামের কিছু লোকজনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলার করার
জন্য যে মামলা করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে কি
অ্যাকশন নিয়েছে। পুলিশ তার কোনও উত্তর দিতে চায় না। তারা যা কিছু করছে
উপরওয়ালা পুলিশ কর্তার নির্দেশেই করছে শুধু এটুকুই জানায়। ভিড় ক্রমশ বেড়ে যায়।
পুলিশের বিরুদ্ধে বিরোধ প্রদর্শন করতে থাকে গ্রামবাসী এবং গ্রেপ্তারী পরোয়ানা তুলে
নিতে বলে পুলিশকে। বেগতিক দেখে পুলিশ পিছু হটতে বাধ্য হয়। কাউকে গ্রেপ্তার না করেই
তাড়াতাড়ি সরে পড়ে সেখান থেকে। তারপর প্রায়
মাসতিনেক হয়ে গেছে পুলিশ আর এ গ্রামমুখো হয়নি। সবাই ভাবল হয়ত নিজেদের ভুল বুঝতে
পেরে মামলা তুলে নিয়েছে পুলিশ।
আজ দুপুরেই
বেরিয়েছিল সময় সিং তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সবসময়ের ছায়াসঙ্গি মনোজকে নিয়। গিয়েছিলো শহরে সময়ের হবু বউয়ের সাথে দেখা করতে। হ্যাঁ এই
মাসতিনেকের মধ্যেই সময়ের জন্য মেয়ে দেখেশুনে বিয়ে ঠিক করে দেয় সময়ের মা-বাবা।
ছেলের সামাজিক ও রাজনৈতিক কাজকর্মের জন্য কোনোদিন বাঁধা না
দিলেও,গণ্ডগোলের পর থেকে একটু দুশ্চিন্তা করে তারা। আর সবার
থেকে সময়ই যে আগে আগে যে কোনও ঘটনার সাথে জড়িয়ে পড়ে ঘরের কাজকর্ম ফেলে। এটা কিন্তু
এখন বাড়াবাড়িই মনে হয় তাদের। তাই ভাবে যে ছেলেকে সাতপাঁকে বেঁধে দিতে পারলে হয়ত সংসারের
প্রতি মনোযোগ বাড়বে। তখন চট করে কোনও কিছুতে নিজেকে জড়াতে দুবার ভাববে সে। এই ভেবে এক আত্মিয়ের মাধ্যমে বাদলপুর গ্রামে বিয়ে ঠিক করে
ছেলের। মেয়েটির নাম আলপনা! দেখতে শুনতে ভালোই, হাই স্কুল পাস করেছে গতবার। কলেজে আর
ভর্তি হয়নি। পরিবারটি দেখে সময়ের মা-বাবার মনে হল সে মেয়ে ভালো সংসারী হবে।
তাই আর দেরি করেনি বিয়ে ফাইনাল করতে। সময় প্রথমে বিয়ে করবে
না বললেও জোর দিয়ে মানা করতে পারল না। চব্বিশ বছরের জীবনে কারও সাথে সম্পর্কে না
জড়ালেও মনে মনে সেও নারীসঙ্গ কামনা করে। সমাজের প্রতি তার দায়বদ্ধতার কথা মাথায়
রেখেও শেষে সে সম্মতি জানায়। আসলে এত কর্মব্যস্ততার মধ্যে সেও একজন এমন কাউকে পাশে
পেতে চাইছিল যার কাছে সে তার ব্যক্তিগত ভুলভ্রান্তিগুলোকে জমা রেখে দিয়ে ভারমুক্ত
থাকতে পারে। আলপনাকে দেখতে গিয়ে তারও পছন্দ হয়। কিন্তু কথা কিছু হয়নি তখন। তাই ফোন
নম্বর জোগাড় করে বিয়ের আগে একবার দেখা করার ইচ্ছে জানায়। সেইমতো তারা নিজের নিজের
ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবী দের ম্যানেজ করে মানসর শহরের একটি শপিং মলে দেখা করার প্ল্যান
করে। সময়দের গ্রাম থেকে শহরটির দূরত্ব প্রায় তিরিশ কিমি হলেও আলপনাদের গ্রামটি আবার
কাছেই- শহরের অন্যদিকে প্রায় পনের কিমি। যাইহোক শপিং মলে টুকিটাকি কেনাকাটার
ফাঁকেই দুজনের আলাপ চলতে লাগল। কথাবার্তা বলে সময় সিং বুঝতে পারল যে এই মেয়েই
পারবে তার যোগ্য সহধর্মিণী হতে। ফেরার সময় আলপনার জন্য এক চাপা বেদনা টের পেল সময়
! তৃষ্ণার্তের সামনে শীতল জল পেলে যেমন জলপানের তৃষ্ণা আরও তীব্র হয় ঠিক তেমন
অনুভূতি! একেই তবে বিরহ বলে লোকে ! আলপনাকে বিদায় জানিয়ে বাসস্ট্যান্ডের দিকে গেল
সময় ও মনোজ গ্রামের বাস ধরার জন্য। সন্ধ্যে হবে হবে। গ্রীষ্মের আকাশে মেঘ থালকেও
বৃষ্টি হবার একেবারেই সম্ভাবনা নেই এই হালকা মেঘে। তা না হোক, তবু সে ভিজবে, ভিজবে
নয় ভিজতে শুরু করে দিয়েছে রীতিমতো। স্ট্যান্ডে গিয়ে জানল একটু আগেই একটা বাস
বেরিয়ে গেছে, পরের বাস ছাড়বে দেড়-দু ঘণ্টা বাদে। তা চলে যাক,পরের বাসটিও দেরি করুক
যত খুশি ! সে অপেক্ষা করবে!
‘হাতে সময় আছে চল
পাশের ধাবায় গিয়ে বসি’ সময় সিং বলল।
‘চল! সময় না
থাকলেও বসব আজ।’ মনোজ বলল। দুজনে দুটি ঠাণ্ডা বিয়ার অর্ডার করল। বিয়ের অনুষ্ঠানের
জন্য নানারকম প্ল্যান আলোচনা করতে করতে দুই বন্ধুতে মিলে দুই বোতল করে বিয়ার শেষ
করে দিল।
‘শালা দুই বোতল
বিয়ার শেষ হয়ে গেল অথচ নেশা ধরল না এখনও ! এদিকে পেট ফুলে ঢোল ! দাঁড়া পিসাব্ করে
আসি’ বলেই ধাবার পাঁচিল ঘেঁষা ইউরিনালের দিকে গেল সময় সিং। প্রসাব করা শেষ হয়েছে
কি হয়নি এমন সময় মনোজের চিৎকার শুনতে পেল- ‘ভাগ্ সময় ভাগ্ ! পুলিশ !’
পিছনে তাকিয়ে
দেখে দুটি উর্দিধারী মনোজের কলার ধরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেই কোনোমতে
ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে , পেছন পেছন পুলিশ দুটিও ! কিছুমাত্র বোঝার আগেই দেখতে
পেল আরও দুটি পুলিশ তার দিকেই ছুটে আসছে। আর কিছু না ভেবেই দেওয়াল টপকে ওপারে একটি
খেতের মধ্যে পড়ল সময়। এদিকে সন্ধ্যের অন্ধকার গাঢ় হয়ে গেছে। আশেপাশের আলোতে বোঝা
গেল যে এটি একটি আখ খেত, তার মধ্য দিয়েই সময় সিং দৌড়তে লাগল। আর দেওয়ালের ওপার
থেকে দুটি গুলির আওয়াজ শুনতে পেল সময়। বেশ কয়েকটা খেত পেরিয়ে এসেছে, মনে হয় না
পুলিশ এই খেতের ভেতরে ঢুকবে আর তাছাড়া শরীরের কোথাও তো কোনো আঘাত টের পাওয়া যাচ্ছে
না। এক মুহূর্ত থেমে ভালো করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত হাতিয়ে নিশ্চিত হয় সময়। তবে কি
মনজেকে...! না ! ভাবতেই শিউরে উঠল সময়। বড়
বড় নিঃশ্বাস ফেলে ফেলে একনাগাড়ে দৌড়তে লাগল সময় !
No comments:
Post a Comment