বনসাই
স্যামুয়েল বাঙালি যীশু
ওর জিনে বিশুদ্ধ বামন অবতার
কুৎসিত দুটো হাত
ও কোথায় রাখবে ভেবে পায় না
এক যাদবের গোয়ালে কাজ পেয়েছিল ও
বাঁট টানতে টানতে,
জোড়া পায়ের লাথি খেতে খেতে
ফিরে এসেছিল
একদিন
চুরি করে এনেছিল এক বৃদ্ধ পাকুড় গাছের বনসাই
স্যামের মোটা পেট, চার ফুট চেহারার কদাকার মুখে
আজ অবধি কেউ চুমু খায়নি
সেদিন খুব ঝড়, সেদিন খুব বৃষ্টি,
পাকুড় আছড়ে পড়ল স্যামের বুকে
চুমু খেল ওর ভেটকে থাকা ঠোঁটে
সেই থেকে স্যামুয়েল সুন্দর হয়ে উঠছে
হাত দুটো যেন ঢেউ
থ্যাবড়া পায়ের পাতায় নূপুর
হেঁড়ে গলায় ভীমসেন...
স্যামুয়েল সুন্দর
আর সুন্দর সেই বনসাই
জাইগ্যান্টিজম একটি
গুপ্তরোগ। দৈত্যর চেহারায় এসে যে আমাদের বেঁটে করেছে, ক্ষুদ্র ও হ্রস্ব
ভাবনা দিয়েছে, সুপ্ত বাসনা কে বলেছে, ওই আকাশ তোমার, ওই বাতাসকে মুঠোয়
ধরে আলগোছে উড়িয়ে দিতে তুমিই পার। ডোয়ার্ফ স্যামুয়েল এসব জেনে গেছিল বলে হাকিমের চিকিৎসা
তাকে যৌনতার দিকে টেনে এনেছে।
স্যাম ক্রমশ লম্বা হচ্ছে
ওর ছোট প্যান্ট শার্ট
ওর খাটো মাথা
তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ
করছে
এই দীর্ঘসূত্র
স্যামকে আপনারা চেনেন
না
ওর পাকস্থলীর বাঁক
আর ক্ষুদ্রান্তের
ভাঁজ
আমার মুখস্থ!
আমিই স্যামকে জন্ম
দিয়েছি
ওর বাবা ছ'ফিট
আমি ও মাঝারি
আমাদের লুকনো মিশ্র
সংকর জিনে
ওর ইতিহাস আছে।
ডোয়ার্ফিজম প্রকাশ্য, তীব্র ও প্রকট। সে জানে, দরজায় ছিটকিনি দেওয়া,
উঁচু তাক থেকে কিশমিশের
কৌটো পেরে আনা তার অসাধ্য। দীর্ঘ হতে থাকা স্যামুয়েল মাটিতে তাকায়- ওর চেয়ে অনেক নীচের
এই অবস্থান তাকে প্রলুব্ধ করে। ভাবে, মাটি আর পৃথিবীর বুকে হাল চাষ
তারই একান্ত অধিকার!
তেল ও মালিশ, সুন্দরতর
করে তোলে ওকে। হাকিম বদলে যায়, ইউনানি প্রাচীন ও আদিম টান দেয় ছিলা ধরে। রাত ঘন হলে
পরিদের ডানা খসা দেখবে বলে উঁচু, আরও উঁচু হয়ে ওঠে আকাশ, তারা খসা দেখে ফেলবে বলে সৌভাগ্য
জড়ো করে। নীচু হয়ে দেখে না আর ও আজকাল। খোলা ছাদে চিৎ হয়ে শুয়ে সারারাত পরিদের ডানা
খসা দেখে...তারা খসার ভ্রমে দেখে ফেলে কিছু জোনাকিও।
স্যামের টেলর হাল
ছেড়ে দিয়েছে
মাপ নিতে নিতে
পরিসীমার বাইরে চলে
যাচ্ছে ও
ওর উঁচু চেয়ারের পায়া
কেটে দিয়েও
ওকে আজকাল খেতে বসলে
খুব লম্বা লাগে!
বালিশ বদল হয়, বদলে যায় জুতো
রাত নামলে পরিদের
ওড়াউড়ি বাড়ে
স্যামের ঘুম আসে না...
সম্পর্কের মাপে উচ্চতা বাড়ে, উচ্চতা কমে। প্রত্যক্ষ করেছে সেই, যার নিজস্ব অনুপাত
সময়ানুপাতিক। বেঘোরে মরেছে সেই, যার আকার ও অবয়ব কালচ্যুত, ঘনঘোর। ধাতুদৌর্বল্য প্রত্যক্ষ
করেছে তিল তিল করে বেঁচে থাকা ধাতব জবানী।
পাকুড়ের মাপ বাড়ে
নি বলে
স্যামের হৃদয় খুব
খালি খালি লাগে
স্যাম বিয়ে করে ফেলে
বেডরুমের বন্ধ দরজার
বাইরের ব্যালকনিতে
পাকুড় চোখের জল লুকোয়
স্যামের বউ আমিই
আমি ওকে আরও বড় করে
তুলেছি
দীর্ঘ হতে হতে ওর
মাথা এখন ছাদ ছুঁই ছুঁই
মাথা নীচু করে ঘরে
ঢোকে স্যামুয়েল
কেউ কি জেনেছে তুলাদন্ডের কথা?
কালো কাপড়ে চোখ বাঁধা সেই রমণীর কথা? নিয়ম ও নিয়মানুবর্তীতা আমাদের বেঁধেছে, মুক্ত
করেছে। সেই গান্ধারী রমণী এসব জানে নি, হাতে ধরে রেখেছে তুল্যমূল্য কিছু।
স্যামের আবারও
খালি খালি লাগে
সপ্তাহে সপ্তাহে
জামা বদলিয়ে দেখেছে
অভাব মেটে নি
সেভাবে
খালি হতে থাকে
তার বুক,
পাঁজরের ফাঁকে
ঠেল দিয়ে ওঠে আরও কিছু হাওয়া
ফুসফুসে চাপ
স্যাম প্রেমে
পড়তে থাকে ঘনঘন
এ হাতের খবর ও
হাত জানে না তার
বনসাইয়ের শেকড়ে
তখন ভীষণ আঁট
এঁটে বসেছে শেকড়
যে মাটিতে, তারই লাগাম ধরে আছে মাটিরই ওপরে কেউ। কৃষ্ণ সারথী সে, নাকি সখা বা
দুর্বৃত্ত, লাগাম শুধু খবর রেখেছে। এই সেই
কুরুক্ষেত্র, এই সেই আদিম যুদ্ধভূমি, মৃত্যু ও লালসার, ত্যাগ ও সততার বধ্যভূমি।
স্যামুয়েল নিজের কাছে হারতে চলেছে, বনসাইও হেরেছে নিজের কাছে। জয়ী কেউই হয় নি
কোনদিন, সাময়িক প্রস্ফুটিত হয়েছে।
দর্জি-বউ জানে বাসা
বুনতে, ফেলে দেওয়া বাড়তি কাপড়ের টুকরো জুড়ে আল্পনা এঁকে দিতে পারে কাঁথার শরীরে। কাঁচি
ও ছুঁচ, সুতো ও বোতাম তার নয়, অধিকার একান্ত হয়ে থাকে নিজস্ব সীমার ভেতরে। জামার গায়ে
শরীর লেগেছে বলে, শরীর কোনদিন জামার কেউ হয়ে উঠবে, এমন অহেতুক ভাবনার ভেতরে বনসাই থেকে
গেছে।
ঘাড় ক্ষয়ে যেতে থাকে
ওর
ক্রমশ্য নুয়ে পড়ে
ওর দেহ
পায়ের গোছ ভেঙে আসে
গোড়ালিতে চাপ
স্যাম ছোট হতে থাকে
আবারও
প্রেমিকারা থমকায়
কিছু দূরে
আমিও ভাবি এই স্যামের
ঢিলে জামা,
ঢলঢলে পাতলুন ছোট
করাতে হবে
টেলরের মেড ইজি অভিধানে
স্যামের জামাপ্যান্ট
ফিট করে না
বৃক্ষ হতে বাদ সেধেছে
যারা, তারা তার কেউ নয়, নিজের খেয়ালে তাকে বেঁধেছে।
বনসাইয়ের গুঁড়ি স্ফীত
হয়েছে
ওকে দেখে বয়স্ক লাগে
মূল শেকড়ের বাড় কেটে
দিই যত্ন করে
চ্যাপ্টা টবে ও ক্রমশ
থেবড়ে বসেছে
স্যাম এখন আমার মাথায়
মাথায়
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের
সঙ্গম হয়
যেমনটা অতীতে কখনও
হয়ে নি
তৃপ্ত আমি ঘুমিয়ে
পড়ি
স্যাম বারান্দায় রাত
কাটায়
ওদের পুরনো প্রেমের
কথা শুনেছি
বিশ্বাস করিনি
সন্দেহ কুঁকড়ে দিয়েছে
আমাকেও
সন্দেহর কাছে হাত
পেতে কুড়িয়ে নেওয়া যায় যত, রিক্ত করে দেবে সে ততই তোমাকে। বিশ্বাস আরেক নাম,
সন্দেহর বিপরীতে থেকেছে। সময়ে সময়ে কুঁকড়ে গেছে তারা দুজনেই, দ্বিতীয়র বিস্তার
ঘটেছে শেষে। কুঁচকে যেতে যেতে সন্দেহ একদিন নিঃশেষ হবে, এমনই তার পরিণতি, জেনে
গিয়েও সে আর হাত পা ছড়াতে পারে নি, টান দিতে পারে নি সেই ছিলায়।
শেষ পর্যন্ত
দেওয়াল। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়াই নিয়তি মেনে নিলে, দেওয়ালকেই মেনে নেওয়া হয়।
বিছানা ও বালিশে যথেচ্ছ দেওয়াল এসে বসে, নিরেট হয়ে ওঠে তুলোর কাহিনী। বেড়াল এক
অনাবশ্যক আড়ম্বর, আবশ্যক হয়েছে, ভুল করে মাঝখানে এসে বসেছে। বাছাই প্রক্রিয়া শুরু
করার আগেও ছিল রোমের বৃত্তান্ত, কে আর কত ভাতের মাঝে চুলের খবর জানতে এসেছে!
আমার কুতকুতে চোখ
স্যামের ধেবড়ে
থাকা ঠোঁট
একে অন্যকে ছুঁতে
গেলে বমি আসে
আমাদের বিছানায়
এখন বেড়ালটা এসে শোয়
আমি ওকে বারণ
করিনি
মাঝখানে দেওয়াল
করেছি
চাদর বদলাতে গিয়ে
ঝেড়ে ফেলি ওর লোম
আমার গায়েও দেখি
লোমের বাহার!
স্যামের দাঁত পড়ে
গেছে
চোয়াল ঠেলে
বেরিয়ে এসেছে যেন আমারই দিকে
আমার থুতনি এখন
ওর মাথার ওপর থাকে
বনসাই আমাদের দেখে নির্লিপ্ত চোখে
ওর চোখ আমি দেখিনি যদিও
স্যামের কাছে শুনেছি
সেই টেলরের কাছে আমি রোজ যাই
সে চোখ দিয়ে মাপে
স্যামের থেকে আমার ছাতির মাপ ওর বেশি জানা
স্যামের প্যান্ট ফিট হয় না কখনোই
দাঁত ও নখের গল্পে আঁচড় থেকেই যাবে। চোয়ালের হাড় শক্ত হতে হতে পাথরের ভূমিকায়
মঞ্চ কাঁপাবে। চোখের নির্লিপ্তি আসে না কোনদিন, যেটুকু বাইরের দেখনদারী এড়িয়ে চলা,
এলিয়ে থেকেছে। বুক ও কোমর একের অধিক স্থানাংকে মানিয়ে নিয়েছে, যেভাবে মানিয়ে নিতে
হয়, একে অন্যের ভারসাম্য বহন করে, পারস্পরিক অবস্থানে প্রকাশ্য থেকেছে।
এ রাজ্য ছেড়ে চলে
যাওয়া কেউ কেউ তবু সুজলাং সুফলাং, এদেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া কেউ ভাবে, সারে জাঁহা সে
আচ্ছা-স্যামুয়েল মাটি খুঁড়ছে, বীজপত্র থেকে সারা মেলে নি যদিও। প্রবাস, নিবাস মিলে স্যামুয়েলের বোধ জাগ্রত হবে কি কখনো?
মাঝরাতে একদিন চারফুটের স্যামকে ছেড়ে
আমার প্রিয় বেড়ালকে ছেড়ে
আমি পালিয়ে যাব ঠিক করি
বারান্দায় গিয়ে বিদায় জানাতে যাই ওর কাছেও
পাকুড়ের ঝাঁকড়া মাথা আকাশ কালো করে রেখেছে তখন
কোন তারা নেই, চাঁদ ছিল না কখনোই বোধহয়
ভয়ে বুক হিম হয়ে আসে অন্ধকারে
টেলরের বাইকের হেডলাইট দেখে নেমে আসি
শমীবৃক্ষ ছিল এক। লুকিয়ে রেখে গেছিল কারা তার কোটরে অস্ত্রশস্ত্র। ছিল তার
মাথার ওপরে গান্ডীব। ছিল তার পাতায় পাতায় উপশম। একে একে এসেছে ওরা, ব্যবহারে ব্যবহারে
বিদীর্ণ করেছে, নিয়েছে, কেবলই নিয়ে গেছে ওর ভান্ডার। স্যামুয়েল শমীগাছ চেনে না।
সুদূর মরুর দেশে গিয়ে দৈবাৎ দেখেছে সেই গাছকে। অচেনা ভাষায় আদানপ্রদান ব্যহত
থেকেছে।
মূক ও বধির শমীবৃক্ষ সে
সে এক অবোধ স্যামুয়েল
দুজনে দুজনকে দেখে
নিঃশব্দে ভাবের আদানপ্রদান হয়
নিঃশ্বাসের শব্দ কেউ শুনেছে ওদের?
শুকনো হাওয়ায় থিরথির কেঁপে ওঠা পাতা,
ভাবলেষহীন মুখের আঁকিবুঁকি –
কেউ পড়েছে?
নিঃস্ব দুই দেহ, এখনো প্রাণ ধরে আছে
হাতে হাতে চাপ দিলে রক্তের লালিমাও আছে
ওষধি বৃক্ষ থেকে এখনো কারা যেন প্রাণ পায়
কারা যেন খর্বকায় শরীরের কাছে এসে বসে
প্রাণের আবেশে-
শমীর কানে শিহরণ তুলে
স্যাম কথা বলেছে স্থিমিত স্বরে
সেদিন মরুর বুকে জ্যোৎস্না
হাসনুহানাও কি জেগেছিল?
আর জোনাকি?
কল্পনার বেশি ওরা,
মরুতেও সবুজের ঢল নেমেছে
সুজলাং সেও, সুফলাং তারাও সেদিন
দুজনার কানে কানে বিদ্যুৎ ঢেলেছে।
এই সেই শমীবৃক্ষ, পাশে এসে বসে
স্যাম সখা। সেদিন অকাল বর্ষণ
শমীবৃক্ষ অতীত ভুলেছে গাছ হয়ে,
কারা তারই কোটরে রেখেছিল
অস্ত্রশস্ত্র
সেজেছিল কারা দীনহীন -
কোন সে অর্জুন মস্ত বৃক্ষ থেকে
কবে
পেরেছিল অতীব গান্ডীব!
নবীন শমীগাছ আজ স্যামসখা
স্ত্রী ও মাতাপিতা,
বনসাইয়ের
চোখের আলোয় লীন।
উচ্চতা এক নিরপেক্ষতা ধরে নিয়ে স্যাম এগিয়ে চলেছে। শমীবৃক্ষ জেনেছে স্থিরতা
আপেক্ষিক গতি। অতিসার জীবনে ভ্রম আর অজুহাত, রূপকের অভিমুখ খুঁজতে গিয়েছে। হারাতে
হারাতে ওরা আর হারাবে না নিজেদের, এই সার, এইখানে শুরু- আবারও হয়েছে।
No comments:
Post a Comment