খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

গ্রন্থ আলোচনা- বেবী সাউ

         


                  'অতিরিক্ত ঠান্ডা গলায় কথা বলি'

আধুনিক কবিতার এক অন্যতম কাব্য-আঙ্গিক হল ইঙ্গিতময়তা, যেখানে খুব অল্প কথায় মহাকাব্যিক পরিস্থিতি গড়ে তোলা যায়। চমকপ্রদ কাব্যঝংকার, চিত্রকল্পের উন্মার্গগামীতার পাশাপাশি, নির্জন কাব্যভাষ্যের এক ধারাবাহিকতা তাই দেখতে পাওয়া যায় বাংলা কবিতায়, যেখানে অল্পেই প্রস্তুত করা হয় বৃহতের আয়োজন। এক মুঠো ধুলোর মধ্যেও যে মহাকাশের অস্তিত্ব টের পাওয়া যায়, তা তো আর মিথ্যে নয়, কথা হল এই এক মুঠো ধুলোর মধ্যে কীভাবে মহাকাশ আছেন, তাকে দেখা। তার জন্য মহাকাশকে যেমন জানতে হয়, তেমন ভাবেই জানতে হয় ধুলোকেও। আর কবি বা শিল্পী প্রজ্ঞার গভীর স্তর থেকেই ধুলোর মধ্যে মহাকাশকে ও মহাকাশের মধ্যে ধুলোর অস্তিত্বকে টের পান।
নব্বই দশকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি সুবীর সরকারের কবিতায় এই বৈশিষ্ট্যকে টের পাওয়া যায়। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থ নাচঘর-এও এক প্রকৃত কবির নির্মেদ কাব্যব্যক্তিত্বের যে প্রতিফলন আমরা পদে পদে টের পাই, তা কবিতা নামক শিল্প মাধ্যমকেই আরও গভীর পর্যায়ে উন্নীত করে, সন্দেহ নেই।
যেমন ধরা যাক বাঘ শীর্ষক কবিতাটির কথা।

 ম্যাজিকের পর ম্যাজিক।
বেড়ালের চোখে চোখ রেখে কথা
                                              বলা
পাশবালিশের পাশে ফুটবল
জখম বাঘ সারারাত ডাকে

চিত্রকল্পগুলি কিন্তু সহজ। সেখানে কোনও শব্দের জাগলারি নেই, বা শব্দের সঙ্গে শব্দ মিলিয়ে নতুন অভিনবত্ব তৈরি করার বাসনাও নেই। আসল কথা হল কাব্যসজ্জায়। প্রতিটি চিত্রকল্প যেন এক একটি জাম্প কাট এবং সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ভিন্ন অর্থ।
এই ভাবে বলা যায় রেডিও, বাজনা, স্মৃতি প্রভৃতি কবিতার কথা। যেখানে সামগ্রিক ব্যঞ্জনার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কবির অভিপ্রায়। আবার এমন কবিতাও আছে , যা সামগ্রিক ভাবে গঠন করছে এক নতুন চিত্রকল্প। সেখানে চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে দর্শন।
যেমন-

আমাদের পলায়ন থেকেই পূর্বপাড়ার রাস্তাগুলি
শুনছি বৃষ্টির শব্দ
পৃথিবী ক্রমে গমরঙের দিকে ঝূঁকে
                                        পড়ছে

                                                   ( পূর্বপাড়া)

তাঁর প্রতিটি কবিতায় অমোঘভাবে এক দর্শনের দিকে আমাদের ঠেলে দেয়। তা হয়ত কখনও হয় স্টেটমেন্ট, আবার কখনও সামগ্রিক ভাবেই হয়ে ওঠে এক অভূতপূর্ব চিত্রকল্প। সেখানে চিত্রকল্পের নির্মাণই যেন বা কবিতার নির্মাণ। যেহেতু কবিতার আসলে কোনও ক্লাইম্যাক্স নেই, তাই এক একটি অমোঘ ক্লাইম্যাক্স তাঁর কবিতায় যখন আমাদের অভিভূত করে, তখন বুঝতে পারি, আদতে সেই ক্লাইম্যাক্স আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক ক্লাইম্যাক্সহীন চলমান সময়ের দিকে, যার কোনও শুরু বা শেষ নেই, যাওয়াটাই আসল।

এই প্রসঙ্গে অবধারিত ভাবেই বলতে হয় গানমাস্টার শীর্ষক কবিতাটির কথা-

মাঝরাতে একা একা ঘোড়ার পিঠে গানমাস্টার
ডেটলের গন্ধ ভাসে।
অসুখ সারাবে বলে এগিয়ে আসে
                                                 সিরিঞ্জ
যত্ন করে চাঁদ লিখি
ডুবে যাবার জন্য তৈরি আছে
                                             পুকুর

একই রকম ভাবে বলা যায় ইতিহাস শীর্ষক কবিতাটির কথা-

ইতিহাস ভুলে যাই, খিঁচুনি ভুলি
                                            না
সাজানো হকিস্টিক, মাকড়সার জাল
রোদ ওঠে না; তাই মনখারাপ

তাঁর কবিতার মধ্যে এক প্রশান্ত অস্থিরতা আছে। এই প্রশান্ত অস্থিরতাই সুবীরকে আঞ্চলিক চিত্ররূপময়তার মধ্যেও করে তোলে গ্লোবাল সিটিজেন। নব্বই দশকের পর থেকে যে লোকালের গ্লোবালে এবং গ্লোবালে লোকালে প্রতিফলিত হওয়ার পারস্পরিকতা শুরু হয়, তা-ই নব্বই পরবর্তী কবিতাকেও করে তোলে দেশ-কাল-সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী। এখন উত্তরবঙ্গ বা দক্ষিণবঙ্গ বা বাংলার যে কোনও প্রান্তে বসে কবিতা লিখে চললেও সেই কবি পাল্লা দিতে পারেন বিশ্বের যে কোনও কবির সঙ্গে। এই যেমন তাঁর কবিতা পড়ে মনে হয় ট্রান্সট্রমারের কবিতার কথা।

নরক বলে এই কবিতাটির কথা না বললে সুবীরের এই নাচঘর কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলোচনা অর্ধেক থেকেই যাবে

যে যাপনে ঘোর নেই, কুয়াশাভরা টানেল
                                                               নেই
রচিত নরকের ভিতরে কিছুটা নাচগান
রোড শো কিংবা শো-কেসময় জীবন
                                                       আমাদের

আর ঠিক এভাবেই সুবীর আমাদের উত্তরাধুনিক এক পৃথিবীর সংকটের কাছে নিয়ে যান এই কাব্যগ্রন্থে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হবে টেলিফিল্ম এবং পাড়া-গাঁ কবিতাদুটির কথা। প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই অপ্রত্যাশিতের মতো আসে চিত্রকল্প। অন্তর্লীন এক নতুন ভাষাপ্রবাহ আমাদের নিয়ে যায় সেই কাব্যপ্রবাহের বিভিন্ন বাঁকে। এই কাব্যগ্রন্থের কোনও শুরু বা শেষ নেই। যে কোনও জায়গা থেকে শুরু হতে পারে এবং যে কোনও বিন্দুই এখানে কেন্দ্র।

মানানসই প্রচ্ছদ ছিমছাম এই গ্রন্থটিকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছে, বলা যায়।

গ্রন্থ- নাচঘর
সুবীর সরকার
প্রকাশক- আদম
প্রচ্ছদ- পার্থপ্রতিম দাস
মূল্য- ৭৫/-

2 comments:

  1. সুবীর দাকে ধন্যবাদ, এমন সহজ সাধারণ ভাবে বলা অসাধারণ কবিতার জন্য।আর অবশ্যই ধন্যবাদ বেবীকে,এমন গভীর আলোচনার জন্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ আপনাকে। সুবীরদা খুব বড় কবি। তাঁকে ধরা খুব কষ্টসাধ্য।

      Delete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...