খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ - হিন্দোল ভট্টাচার্য



                                       স্বীকৃতি পরস্মৈপদী

আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ এবং অভিশাপ হল আমরা নশ্বর। গৌতম বুদ্ধ বলেছিলেন- কোনও মানুষ যদি একবার বুঝতে পারে যে সে একদিন মারা যাবে, তবে তার জীবন পালটে যেতে বাধ্য। কারণ একটা দিন আসবে, যেদিন 'আমি' আর কোথাও থাকব না, - এই ভাবনাই মনের মধ্যে এক অস্থিরতার জন্ম দেয়। সেই অস্থিরতার প্রথম প্রশ্ন হল, আমি কে? এবং কেন? এই প্রশ্নটি যে কেবলমাত্র এ হেন দার্শনিক সংকটের  মুখোমুখি হলে তবেই আসবে, নাহলে আসবে না, তা কিন্তু নয়। বরং বলা ভালো, জীবমাত্রেই, এ হেন ভাবনা প্রকারান্তরে নানা উপায়ে থাকে। নানা আঙ্গিকে থাকে, নানা সংকটে থাকে, নানা ভাষায় থাকে। এ কথা অনস্বীকার্য, কাজ-ই যদি মানুষের জীবনের আইডেন্টিটি হয়, তবে তা-ই হলো আসল স্বীকৃতি। একজন মুচি যদি নিজের কাজ ঠিকমতো করে যেতে পারে, তবে সে-ই ঠিক মতো করে যাওয়াটাকে বলা যেতে পারে মুচির স্বীকৃতি লাভ। একজন কৃষক যদি ক্ষেতে জন্ম দিতে পারে ভরা ফসল, তবে, তা-ই হল তার স্বীকৃতি। আদতে কিন্তু কাজ-ই স্বীকৃতি হওয়াটাই দস্তুর। সমস্যাটি হল, কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় সমাজ। আমি নিজে যদি দেখি আমার ক্ষেত ভরা ফসল, তাতে ফসলের আনন্দ আর আমার আনন্দ উভয়েই হতে পারে, কিন্তু তা আমার ব্যক্তিগত আনন্দ। তা, কোনওমতেই আমার কাছে স্বীকৃতি হিসেবে পরিগণিত হয় না, কারণ, স্বীকৃতি পরস্মৈপদী। 
প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি বেসিকস-এ যাচ্ছি কেন? যাচ্ছি, কারণ আমাদের সব সমস্যার মূলে তো বেসিকস। এই ধরুন, আমি খুব ভালো একটা দেওয়াল তৈরি করলাম, একটা ভালো বাগান তৈরি করলাম, তাতে ফুল ফোটালাম, কিন্তু এইগুলি সত্তেও আমার মনে আত্মবিশ্বাস এলো না, যে আমি এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছু দাগ কেটে গেলাম। তা আসবে কখন, যখন কেউ এসে বলবে, এমন ভালো বাগান কেবল আমিই করতে পারি বা এমন অসামান্য ফুল আমার হাতের ছোঁয়া না থাকলে সম্ভব-ই হত না। এই যে আমি মূর্খ হয়েও সামাজিক হয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছি, এই যে আমি জানি, যে আমার সৃষ্টি আমাকে আনন্দ দিয়েছে, তবু, মনে খুঁত রয়ে গেছে, কই, আর তো কেউ বলল না, ব্যাস, মনের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধল, আমার কাজ কি স্বীকৃতি পেল? তার পরে সেই কাজ যেহেতু আমার অস্তিত্বের সঙ্গে যুক্ত, তাই প্রশ্নটি আরও দীর্ঘায়িত হল, আমি কি স্বীকৃতি পেলাম? চাই বা না চাই, আমি নিজেকে সামাজিক করে তুলছি এবং সামাজিকতার পরাকাষ্ঠায় আমি নিজেকে স্বীকৃত বা অস্বীকৃত করার লেবেলটিও দিচ্ছি। মানে, প্রথমে আমি মারছি নিজেকেই। তার পর সমাজ এগিয়ে আসছে, হুয় আমাকে মণিহার পরাচ্ছে, নয়্ আমাকে তীব্র উপেক্ষা করে, করে তুলছে এক দীর্ঘমেয়াদি হতাশাগ্রস্ত মানুষ। নিজেকেই তখন আমি প্রশ্ন করছি, সারাজীবন কি আমার কাজের কোনও স্বীকৃতি পাব না? 
আচ্ছা, এমন কি সম্ভব যে সমাজ থাকবে অথচ ক্ষমতা থাকবে না? ক্ষমতা থাকবে, অথচ তা হবে সমবণ্টিত? ক্ষমতা থাকবে, অথচ তার অপব্যবহার হবে না? যখন আমি বা আপনি আমাদের কাজের আইডেন্টিটি বা স্বীকৃতির ভার চাপিয়ে দিচ্ছি সমাজের উপর, তখন আমি আসলে তার ভার চাপাচ্ছি সমাজের চালকদের উপর। সব কাজের, সব ক্ষেত্রের এক একটি অভয়ারণ্য থাকে। সেই অভয়ারণ্যের রাজনীতির বৃত্তে বা ক্ষমতার উপর মহলে যাওয়ার জন্য যে দেওয়ানেওয়া, যে স্বজনপোষণ যে গোপন অন্তর্বৃত্তের খেলা চলতে থাকে, তা এক বিশেষ ধরণের কাজ এবং তার সাথে শিল্পী বা কবি বা শ্রমিক বা কৃষকের কাজের সম্পর্ক থাকে না বললেই চলে। যেমন ধরুন আমি লেখালেখির কাজ করি বলে কবি বা সাহিত্যিকের কথাই বলছি। এক প্রকৃত সাহিত্যিক বা কবি কখনওই নেতা হতে চাইবেন না। চাইবেন না ক্ষমতার শীর্ষে কীভাবে যাওয়া যায়, তার জন্য ক্রমান্বয়ে হা পিত্যেশ করে বসে থাকতে, তার চারিপাশের সমব্যবসায়ী মানুষজনকে সঙ্গে নিয়ে বৃত্ত তৈরি করে সেই বৃত্তকে সমাজের বিভিন্ন অংশে চালিত করে এক সামাজিক ফেনোমেনন তৈরি করতে। এটি হল নেতা হওয়ার কাজ। নেতা হওয়ার আইডেন্টিটির জন্য, স্বীকৃতির জন্য এই বিশেষ কাজগুলি করে যাওয়াই তার ধর্ম। কিন্তু তিনি বা তাঁরা দেবেন স্বীকৃতি। কারণ স্বীকৃতি দেওয়ার অথরিটি বা পুঁজি কোনওটাই আপনার হাতে নেই। সুতরাং স্বীকৃতি একটি সামাজিক কাজ, একটি অর্থনৈতিক ইসু এবং ক্ষমতার কাছ থেকে একটি সার্টিফিকেট পাওয়ার বিষয়। আপনি একজন কৃষক হতে পারেন, কিন্তু জমি আপনার নয়, সার কেনার পয়সা নেই, ফসল যাও বা ফলালেন, তা বিক্রি করার ক্ষমতা নেই। একজন অসামাজিক কবি এবং আত্মহত্যাপ্রবণ আলুচাষীর মধ্যে ফারাক কিছু আছে কি? আগেকার দিন হলে জমিদারের হাতে প্রকাশ্যে মার খেতে হত, এখন তা হয় না। আগেকার দিন হলে আপনি সরাসরি দেখতেন সভাকবিরা স্বীকৃতির মুকুট পরে, অলংকার পরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এখন তার জায়গায় আছে মিডিয়া। 
কথা হলো এই, যে, স্বীকৃতি পেতে গেলে আপনাকে নিজের কণ্ঠরোধ করতেই হবে। আর এটা আপনাকে নিজেকেই করতে হবে। কারণ আপনাকে জানতে হবে শাসকের ভাষা কী। জানতে হবে তাদের পছন্দ, তাদের গুনগুন, তাদের ইচ্ছে, উদ্দেশ্য, গতিবিধি- সব। কারণ আপনি সামাজিক ভাবে পরস্মৈপদী। স্বীকৃতিও তা-ই। ভেবে দেখুন, আপনার সৃষ্টি কেমন, তা থাকার উপযুক্ত কিনা, আপনি ঠাঁই পাবেন কিনা সমাজের কুলীন অংশে,  কুলীন তাঁবুতে, তার জন্য আপনাকে নির্ভর করতেই হয় সমাজের উপর। হা পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতেই হয় ক্ষমতার দিকে। ক্ষমতার প্রসাদ পাওয়া-না-পাওয়ার উপরে নির্ভর করে আপনার স্বীকৃতির পূর্ণতা। ধরুন আগেকার দিনে ছিল তপস্যার রূপক। এক ক্ষমতাবান ভগবানের জন্য দিনের পর দিন ধরে কৃচ্ছসাধন। এই সব কাহিনি থেকে সাধনার রূপক বাদ দিলে এক ক্ষমতার সামনে নতজানু হওয়ার রূপক কাজ করে নাকি? সেই ক্ষমতাবান এসে বর দেন এবং সেই বর-হেতু আমরা দেখেছি রামায়ণ-মহাভারতেও কত কত ক্ষমতার অধীশ্বর হয়ে গেছেন কত চরিত্র। এগুলি হল ক্ষমতার প্রসাদ। ক্ষমতার প্রসাদ তো একধরনের স্বীকৃতি, যে তুমিই বীর, তুমিই আমার আওতাভুক্ত আরও কিছু ক্ষমতালাভের উপযুক্ত। আর প্রবহমানতা মানব-ইতিহাসে বহুদিন ধরেই রয়েছে। এক্ষেত্রে যদি প্রশ্ন আসে, তাহলে যোগ্যতম মানুষজন পাচ্ছেন না কেন প্রসাদ? মানব-ইতিহাসে তো এও দেখা গেছে বহুকাল ধরে, যে, প্রতিভাবান, ক্ষমতাবান কবি সাহিত্যিক শিল্পী, বিজ্ঞানী, সাধকরা ক্ষমতার প্রসাদ না পাওয়ায় রয়ে গেছেন আড়ালে। তাঁদের কণ্ঠরোধ হয়নি ঠিক, কিন্তু স্বীকৃতিও পাননি।  আবার পাননি, এটিও বলা যায় না। সময়ের নিজস্ব নিয়ম আছে। সময় আপনার কাজকে স্বীকৃতি দেবেই, যদি তা কাজ হয়।
কিন্তু তা কি আপনাকে স্বীকৃতি দেওয়া? এখানেই আসল দ্বন্দ্ব। আর এ দ্বন্দ্ব সমাজের নয়। এ দ্বন্দ্ব বা লড়াই নিজের মধ্যে। আমি নিজেকে যদি  বলি, আমাকে নিজেকে যত আমার কাজের সঙ্গে লীন হয়ে যেতে হবে, তত কাজের সঙ্গে আমার তথাকথিত আমিত্বের বিযুক্তিও আসবে। অর্থাৎ আমি ভাবিত হব আমার কাজের জন্য, আমার আইডেন্টিটির জন্য না। কারণ স্বীকৃতি অনেক সময়েই (বেশির ভাগ সময়েই) সামাজিক মানুষ হিসেবে সেই ব্যক্তিটির, কিন্তু কাজটির জন্য হলেও তা কাজটিকে দেওয়া হয় কি? ধরুন, উদাহরণ হিসেবে বলছি, একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ধরা যাক শালিখের ওম। এখন তার কবির নাম ধরা যাক শালিখ। অসামান্য সেই কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি পেলেন কাকভূষণ পুরস্কার। শালিখ পেলেন কাকভূষণ পুরস্কার। কিন্তু শালিখের ওম পেল না। তাহলে স্বীকৃতি এক আত্মতৃপ্তি ছাড়া অন্য কিছু নয়। তার সঙ্গে কাজটির কোনও সম্পর্ক নেই।
কিন্তু এই দার্শনিক অথচ আমার মতে বাস্তব বিষয়টি বাদ দিয়ে যদি দেখি, দিনের পর দিন ধরে যোগ্য মানুষ ক্ষুদ্র রাজনীতির বলি হচ্ছেন, সামাজিক ভাবেই তিনি যা পেতে পারেন, তা পাচ্ছেন না। যদি দেখি, সামাজিক ভাবে এই স্বীকৃতি এক বিশেষ ধরনের সত্য তৈরি করার ফলে, কাজটির মধ্যে যে সত্য, তা পাঠকের কাছেও স্বীকৃত হচ্ছে না এবং প্রকৃত শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও তিনি থেকে যাচ্ছেন অনুল্লেখিত, তখন খারাপ তো লাগবেই। কারণ যুগটিও আর জীবনানন্দের সময়ে পড়ে নেই। এখন সত্য উৎপাদিত হয়। এই সত্যকে নির্মাণ করে তারাই, যারা স্বীকৃতি দেয়। কারণ স্বীকৃতি দেওয়ার মেশিনারি তাদের হাতে। সত্যকে নির্মাণ করার মেশিনারিও তাদের হাতে। তাহলে কবিতা বা সাহিত্য বা শিল্পের দীর্ঘকালীন নন্দনতত্বের দার্শনিকতার সঙ্গে এই বাস্তব রাজনীতির  একটা সংঘর্ষ বাঁধছে। জেনুইন ট্র্যাজেডির মতোই এই ম্যাক্রোকজম সুলভ রাজনীতির সামনে ব্যক্তি অসহায়। যে স্বীকৃতি দিচ্ছে বা দিচ্ছে না, তার স্বীকৃতি দেওয়ার অধিকার আছে কিনা বা নেই, সে সম্পর্কে প্রশ্নটি শোনার মতো অডিয়েন্স-ও এখন পাওয়া যাচ্ছে না। 
এ হল প্রকৃত কণ্ঠরোধ। হয় তুমি আমার মতো নয়, নয় হারিয়ে যাও। তোমার স্বীকৃতি নির্ভর করছে আমি তৃপ্ত হব কিনা তার উপর। এর মানে, প্রথমে আমাকে অস্বীকার করলে তোমার মুশকিল। আর আমি চোখ রাখছি তোমার উপর। কিন্তু এ হেন কাজ কারা করে? বিশেষ ভাবে লক্ষ্য করার মতো বিষয় তাদের সৃষ্টির দিকে তাকালে বোঝা যায়, যারা তাদের স্বীকার করছে, তারা আসলে তাদের ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে বলেই স্বীকার করছে। কারণ তুমি যদি সেই স্বীকৃতিটা না দাও ক্ষমতাকে, তাহলে তোমাকে স্বীকৃতি দেওয়ার সময় তারা বিশেষ ভাবে তোমার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। আগে তা রেখে ঢেকে হত, এখন তা খোলাখুলি হয়। স্বীকৃতির সঙ্গে এই যে কণ্ঠরোধের সংস্কৃতি যুক্ত হয়ে পড়েছে এখন, তার বিপরীতে দাঁড়ানো এক পরম সহিষ্ণু শিল্পীর কাজ। 
বোর্হেসের একটি গল্প দিয়ে শেষ করি। সেই যে দুজন বন্দীকে শাসক বলেছিল দৌড়োও, যে জিতবে, সে বাঁচবে। আর সেই দুজন বন্দী যখন দৌড় শুরু করলো, তখন শাসকের নির্দেশে তাদের দুজনের গলাই কেটে ফেলা হল। দুজন গলাকাটা মানুষ দৌড় দিল এই আগ্রহে যে, যে জিতবে, সে বাঁচবে। একজন লাইন পেরিয়ে গেল। বোর্হেসের গল্পটি শেষ হচ্ছে এই ভাবে, যে জিতল, সে জানতেই পারল না, যে, সে আসলে জেতেনি। 

2 comments:

  1. ভালো লাগলো।

    ReplyDelete
  2. প্রবুদ্ধJuly 12, 2018 at 7:30 AM

    বেশ ভালো লাগল

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...