খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ - প্রবুদ্ধ বাগচী

ক্রোড়পত্র





না-বলা বাণীর আঁচল

এন্টালি পদ্মপুকুর বাসস্টপ থেকে একটু দূরে একটা প্রাচীন প্রতিষ্ঠান আছে যার নাম বেঙ্গল লাইব্রেরি আসোসিয়শন (বি এল এ) সেখানে বেঙ্গল লাইব্রেরি ক্যাটালগ বলে একটি সুপ্রাচীন তথ্যভান্ডার  রয়েছে  যেখানে ১৯২৫ সাল থেকে বাংলায় প্রকাশিত বইয়ের তালিকা খন্ডে খণ্ডে বাঁধানো আছে । আপাতভাবে এই তথ্যভান্ডার গবেষকদের পক্ষে দরকারি হলেও এর পেছনে অন্য একটা ইতিহাস আছে যা আরেকটু পুরোন । ১৮৫৭র মহাবিদ্রোহের পর যখন কোম্পানির শাসন শেষ হয়ে সরাসরি রাণীর আওতায় ব্রিটিশ সরকার তাঁদের উপনিবেশের অধ্যায় শুরু করে, তার অল্প পরেই তাঁদের মনে হয়েছিল বাঙালি নামক এই বেয়াড়াজাতির নেটিভরা পড়াশোনা শিখে কী লিখছে-টিখছে তার দিকে একটু নজর রাখা দরকার । তাই ১৮৮৬ সাল থেকে বাংলায় প্রকাশিত সমস্ত বইপত্রের একটা তালিকা সরকারিভাবে তৈরি করা শুরু হয়। শুধু বইয়ের নাম বা লেখকের নাম নয়, সেখানে সংক্ষেপে বইয়ের বিষয়বস্তুও লেখা থাকত। সেই তালিকার বছরভিত্তিক সঙ্কলন বর্তমানে রয়েছে লন্ডনের ব্রিটিশ ইন্ডিয়া লাইব্রেরিতে, আগ্রহীজন ইচ্ছে করলে তার নির্বাচিত কিছু অংশ ইন্টারনেট থেকে দেখে নিতে পারেন । কিন্তু ‘কণ্ঠরোধ’ শব্দের আড়ালে যে আগ্রাসী মনোভাব, যে দমনমূলক মানসিকতা তার শুরুর শুরু সম্ভবত এইখানে ।  সাম্রাজ্যের স্বার্থের বিরুদ্ধে কোথায় কে কী মত প্রকাশ করছেন বন্দুকের নলটা উঁচিয়ে রাখতে হবে সেই দিকে, এটাই তার সহজ দর্শন ।
আমাদের অনুমানকে অভ্রান্ত প্রমাণ করে  উনিশশতকের শেষ পর্ব থেকে ধারাবাহিকভাবে সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধিরা এই দেশে একের পর সাহিত্য, সংবাদপত্রে মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর নিজেদের দখলদারি কায়েম করতে থাকে। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ নিষিদ্ধ হয়, কণ্ঠরোধের হুকুম নেমে আসে অরবিন্দ ঘোষ সম্পাদিত ‘বন্দেমাতরম’ পত্রিকার ওপর, দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক মঞ্চস্থ করা বারণ হয় । তারপর ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট --- বাংলায় প্রকাশিত সমস্ত সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ করে দেওয়া হয় । তারপর যত গতি পেতে থাকে জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন তত বেড়ে যেতে থাকে কণ্ঠরোধের উন্মত্ততা । শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবি’, কাজী নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ --- শাসকের মানসিকতা অনুসারে কোথাও এতটুকু ভিন্ন স্বর খেয়াল করলেই তাদের উষ্মা ও ক্রোধ । ‘ওদের বাঁধন যতোই শক্ত হবে মোদের বাঁধন টুটবে’ --- হয়তো আদপে ব্যাপারটা তাই, তবে তার মধ্যে অনেক জটিলতার মার প্যাঁচ আছে অন্তত গানের লাইনের মতো ঠিক অতটা সরল নয় বিষয়টা । হওয়ার কথাও নয়।
দেশের সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী লড়াই ক্রমশ যত পুষ্ট হয়েছে ততটাই তীক্ষ্ণ হয়েছে এইসব কণ্ঠরোধের পালাপাব্বন । ১৯৩৪ সালে তো ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকেও নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। যারা আজও কমিউনিস্ট দলের বিরুদ্ধে বিয়াল্লিশ সালের ‘পঞ্চম বাহিনী’র জন্য কুৎসা করে, তাদের পক্ষে এই তথ্য উপাদেয় নয় জেনেও ইতিহাসের সম্মানে এটা বলতেই হবে। এবং মাউন্টব্যাটেন যাদের হাতে তার ব্যাটন তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন তারা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পরে এই নিষেধ আবার জারি করে দেয় ভারতের কমিউনিস্ট দলের ওপর । তার পরে ধারাবাহিকভাবে স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ভারতে নানান রকমারি নিষেধাজ্ঞার ফুলঝুরি আমরা দেখেছি। যার সর্বোচ্চ শিখরে আমরা পৌঁছালাম এশিয়ার মুক্তিসূর্যের দুর্বার নেতৃত্বে । ২৫ জুন ১৯৭৫ । অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা জারি করার সঙ্গে সঙ্গে চালু হয়ে গেল প্রেস সেন্সরশিপ । সরকার যা বলবেন তাই খবর, তাদের চাকুর তলায় যা উচ্ছিষ্ট তা কিছুতেই সংবাদ হতে পারে না । দেশের জাতীয় সংগীতের রচয়িতা গুরুদেবও ছাড় পেলেন না --- একরকম বলেই দেওয়া হল,  তাঁর কবিতা ও গান আমলাবিশেষের বা পুলিশকর্তার মনঃপুত না হলে তা আর সাহিত্য নয়, দেশদ্রোহ ! সে তিনি নোবেল পেয়েছেন কি পাননি সেটা বিবেচনার নয় --- সবার ওপরে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সত্য, তার ওপরে রবীন্দ্রনাথ-ফবীন্দ্রনাথের জায়গা হতেই পারে না !   পেটের কাছে উঁচিয়ে আছো ছুরি / তাই তো এখন ইচ্ছে মতো ঘুরি ।
তবে দেখতে দেখতে সেই তানাশাহীও তো চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে, তার পরে কি সব শান্তিকল্যাণ ? না, তা তো নয় । আসলে রাষ্ট্র মানে যদি লেফট রাইট হয় তবে সেই বুটের তলায়  চাপা পড়বেই কিছু ঘাস-পাতা-ফুল এবং কিছু পোষ না-মানা কন্ঠ । ভারতবর্ষ নামের এই সুমহান দেশে কি সত্যিই তার ‘বেশি’ কিছু ঘটেছে নাকি ? মোটেই না, মোটেই না । এই চার সাড়েচার  দশকে তাই অজস্র আইনের গজিয়ে ওঠা যা কেড়ে নিতে চায় নাগরিকের অধিকার , তার পরিসর মিসা নাসা এসমা টাডা থেকে ইউ এ পি এ, আর আফস্পা তো আছেই --- এসবই তো আসলে জনগণের স্বার্থে , জঙ্গি নিধনের ঢালাও পারমিট ---- তাতে যদি খুচরো কিছু উলুখাগড়ার প্রাণ যায় সেটাকে কোল্যাটারাল ড্যামেজ বলে মেনে নেওয়াই তো বুদ্ধিমানের কাজ । ওরকম তো কতই হয়ে থাকে !
সেই সত্তরের দশকে আমরাই তো প্রতিবাদী যুবকদের নির্বিচারে গুলি করে মেরেছি থানা হাজতে, জেলের ভিতর এবং মাঠে-ময়দানে । রাতের অন্ধকারে এলাকা ঘিরে ফেলে মানুষখেকো বাঘেরা লাফিয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে তারপর ঠেলাগাড়ি করে লাশের পাহাড় ফেলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে পতিতোদ্ধারিণী জাহ্নবীর স্রোতে ।  আবার অন্য আমরা  মরিচঝাঁপিতে বিদেশি রাষ্ট্রের চক্রান্ত বলে একদল নিঃসহায় মানুষকে ঘিরে ফেলে গুলি করে মেরে লাশের স্তুপ সুন্দরবনের রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে উপঢৌকন দিয়েছি ।  সেই আমরাই সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা করব বলে বিরোধীদের ঢুকতে দিইনি, তাদের পুলিশি দাওয়াই দিয়ে এলাকাছাড়া করেছি, প্রতিবাদী ‘গাঁয়ের বধূ’দের রাতে থানায় তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছি । নন্দিগ্রামে ‘কেমিক্যাল হাব’ করব বলে হাওয়াই-চটি-পরা মার্ক্সবাদীদের ভিড়িয়ে দিয়েছি পুলিশের পেছনে । পস্কোতে আবার আরেক আমরা জমির অধিকারে লড়াকু কৃষকদের আন্দোলনকে বারবার ভোঁতা করে দিতে চেয়েছি ছলে বলে কৌশলে । মাল্কানগিরির বক্সাইট আর ম্যাঙ্গানিজ খনির পাহাড়, ছত্তিশগড়ের জল-জঙ্গল-জমি সব বেচতে চেয়েছি ‘উন্নয়নের স্বার্থে’ আর তাতে যারা বাধ সেধেছেন তাদের জন্য জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছি কোবরা গ্রুপ, যৌথ বাহিনী --- কেবল দেশভক্তির স্বার্থে, স্রেফ উন্নয়নের অজুহাতে তারা ছিতামণি মূর্মুর চোখে ঢুকিয়ে দিয়েছে বন্দুকের বাঁট আর সোনি সোরির যৌনাঙ্গে পাথরের টুকরো । এই একই বেয়াড়া প্রতিবাদের জন্যই তো গুরগাঁও-এ মারুতি কারখানার লড়াকু শ্রমিকদের গায়ের ওপর দিয়ে চলে যায় ভারি ট্রাক, উপকূলে পারমাণবিক বিদ্যুতকেন্দ্র মানবেন না বলায় কুড়ানকুলামের মৎস্যজীবীদের ওপর বর্ষিত হয় বুলেট, আর এই সেদিন ‘বেদান্ত’ নামের এক বহুজাতিক হাংরের দাঁতে বিদ্ধ হয় তাদেরই কারখানার শ্রমিকরা ! এই সবই আমরা । আমরাই ইশরাত জাহানকে ভুয়ো সংঘর্ষে নিকেশ করি, আমরাই আহমেদাবাদে বিধর্মীর গায়ে জ্বলন্ত টায়ার ফেলে দিই, গর্ভবতী নারীর পেট চিরে অসীম আহ্লাদে তরোয়ালের মাথায় তুলে  ধরি সেই অজাতভ্রূণ । আমরাই সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে আটকে দিয়ে রামের নামে জেনোসাইড করি, গণতন্ত্রের সমস্ত শর্তকে থোড়াই কেয়ার করে বধির রাখি প্রশাসনকে । আমরা এগুলো পারি বলেই অকুতোভয় এক তরুণী সাংবাদিককে  ছদ্ম-পরিচয়ে ঘুরে বেড়াতে হয় প্রকৃত সত্যের সন্ধানে , সমাজকর্মীদের আনাগোনা আটকাতে তাদের নামে তৈরি করতে হয় আষাঢ়ে অভিযোগের আখ্যান । গত চার বছরে মুক্তমনা পানেসর, দাভোল্কার, কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ প্রমুখ ব্যক্তিত্বকে বিদায় নিতে হয় এই পৃথিবী থেকেই যে গ্রহটাকে তারা আরেকটু মানুষের মতো বাসযোগ্যই করতে চেয়েছিলেন । হিসেব বলছে গত কয়েক বছরে দেশে নিহত খ্যাত সাংবাদিকের সংখ্যা আচমকাই খুব বেড়ে গিয়েছে যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ শুজাত বুখারি । বুঝতে পারি, সবাই ভয় পাচ্ছেন না বলেই আপনারা বড় ভয়ে আছেন ।
কিন্তু এই সবই তো ক্ষমতায় থাকার ভয়, ক্ষমতা থেকে আচমকা উলটে পড়ার ভয় --- ‘এখন চারদিকে শ্ত্রু, মন্ত্রীদের চোখে ঘুম নেই’ ! কিন্তু এর বাইরে কি আছে  কণ্ঠরোধের অন্য কোনও মাত্রা যেখানে সরাসরি রাষ্ট্রক্ষমতার যোগ নেই ? বৃটিশ সরকার ‘বন্দেমাতরম’ গান গাওয়ায় নিষেধ জারি করেছিলেন, মুকুন্দ দাসের গান গাইলে পুলিশ গ্রেফতার করত, প্রচুর বই, পত্রপত্রিকা তারা বাজেয়াপ্ত করেছিলেন সেখানে নয় ছিল এক ক্ষমতার যুক্তি এবং ক্ষমতা হারাবার সূচিমুখ আশঙ্কা । কিন্তু গণনাট্যের যুগে সলিল চৌধুরির ‘গাঁয়ের বধূ’ গানটির ওপর গণনাট্য সঙ্ঘের চাপিয়ে দেওয়া নিষেধাজ্ঞার যুক্তিটা ঠিক কী ? কেনই বা তাঁর সুরারোপিত ‘আল্লা ম্যাঘ দে পানি দে’ গানটিও গাইবার অনুমতি মেলেনি ? তাঁর স্বল্পকালীন সংযোগে উৎপল দত্ত গণনাট্যের আওতায় সেক্সপিয়ার চর্চা করতে গেলে তাঁকে ‘শোধনবাদী ট্রটস্কিপন্থী’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল কোন ভিত্তিতে ? কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় কার্ল মার্ক্সের ‘ওয়েজ লেবার ও ক্যাপিটাল’ চমৎকার বাংলায় ‘ভুতের বেগার’ শিরোনামে অনুবাদ করলে কেন তাঁর দল ওই বই পড়া ও বিক্রির ওপর ফরমান জারি করেন ? এ কি তাহলে সেই পিতৃভূমি সোভিয়েতের অনুসরণ ---- যেখানে বরিস পাস্তেরনাক বা সলঝিনেতসিন শুধু তাদের সাহিত্যের জন্য নির্বাসিত হন ? এমনকি গোর্কিও শেষ জীবন কাটান বিষণ্ণ ঘরবন্দি হয়ে, রম্যা রঁলা যখন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান তিনি বলেও ফেলেন তাঁর আশাভঙ্গের গল্প , মায়াকোভস্কি শেষ অবধি আত্মঘাতী হন অবসাদে । এর কোনোটার সঙ্গেই সেইভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার নড়াচড়ার যোগ নেই।
যেমন এই দেশকে মৃত্যু উপত্যকা বিবেচনায় যারা দেশ ও সমাজবদলের স্বপ্নিল সংগ্রামের আগুনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন তাঁরা উনিশশতকের সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারকদের লেখা ও ভাবনাকে ব্রাত্য করে সবাইকে ডাক দিলেন তাঁদের লেখা বয়কট করার এবং স্কুল কলেজের লাইব্রেরি পুড়িয়ে দেওয়ার, মূর্তি ভাঙার । হয়তো প্রত্যক্ষত এটা তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন --- কিন্তু এ কেমন তত্ত্ব যা কোনও বই পড়ার ওপর নিষেধ চাপাতে চায় ? মনে পড়ছে, চিন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময় যখন চিন-বিরোধিতাই দেশপ্রেমের একমাত্র অভিজ্ঞান বলে বিবেচিত হচ্ছিল, তখন কলেজ স্ট্রীট আর মহাত্মা গান্ধী রোডের সংযোগস্থলে রাস্তার ওপর পোড়ানো হয়েছিল চিনপন্থি বই ও পত্রিকা যার মধ্যে ছিল মনোজ বসুর ‘চিন দেখে এলাম’ --- আর সেই বহ্ন্যুৎসবের অধিনায়ক ছিলেন কলকাতার এক তৎকালীন উঠতি চিত্রশিল্পী যিনি পরবর্তীকালে ‘পরিবর্তন’ নামক এক উদ্বায়ী প্রক্রিয়ায় দাড়িগোঁফ-ওয়ালা প্রধান মুখ ছিলেন । কিন্তু সত্তরকে মুক্তির দশকে বদলে দিতে চাওয়ার বজ্রবাহকরা কেন তাঁদের পরম সুহৃদ সমর সেন ও তাঁর ‘ফ্রন্টিয়ার’ পত্রিকাকে শেষ পর্যন্ত ব্রাত্য করলেন, কেন তাঁরা নোটিশ দিয়ে ‘ফ্রন্টিয়ার’ পড়া, দল বিরোধিতার সামিল বলে হুলিয়া জারি করলেন বলা বড় কঠিন --- কিন্তু এও তো একরকম কণ্ঠরোধেরই চেষ্টা ! উৎপল দত্তের বেলায়ও তাঁদের ভূমিকা একই ----‘তির’ নাটকের মতো একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক প্রযোজনা এবং সিপিআই এম এল প্রতিষ্ঠার গোড়ায় যার তুলনাহীন শ্রম তাঁকে সম্পূর্ণ একটি অনুমানের ওপর ভর করে ‘দলবিরোধী’ বলা কোনও দ্বন্দ্বমূলক দর্শনে আস্থাশীল দলের পক্ষে কি শোভা পায় ? হায়, তাঁরা যদি একবার উৎপল দত্তের ‘রবি ঠাকুরের মূর্তি’ লেখাটি পড়ে দেখতেন ! অথচ মাও তো শতফুল বিকশিত হওয়ার কথাই বলেছিলেন বারবার !
এইসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল হতভাগ্য অনিতা দেওয়ানের কথা । কলকাতার উপকণ্ঠে সরকারি কাজে গিয়ে তিনি দুষ্কৃতীদের হাতে গণধর্ষিত ও নিহত হন, হাসপাতালে তাঁর জননাঙ্গের ভিতর থেকে কাঠের টুকরো ও বোতল বার করা হয়। নিষ্ঠুর এই ঘটনা নিয়ে একটি অসামান্য গান লিখেছিলেন নাগরিক কবিয়াল কবীর সুমন । সে গান যে মঞ্চেই গাইতে যান তাঁকে বাধা দেওয়া হতে থাকে, আসতে থাকে হুমকি ফোন । কেন ? এই একটি গান কলকাতার মঞ্চে মঞ্চে গাইলেই কি বামফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটত ? গণ অভ্যুত্থান ঘটত পশ্চিমবঙ্গে ? ২০০৬ এর পরের পর্বে কয়েকটি নাটক এর মঞ্চায়ন ঘিরেও শাসক দলের মাতব্ব্ররা সমানে চোখ রাঙিয়ে চলেছিলেন নাট্যসংস্থাগুলিকে , ঠিক যেমন ষাটের দশকের শেষে উৎপল দত্তের ‘দুঃস্বপ্নের নগরী’ নাট্যপ্রযোজনাকে আটকানো হত প্রথমে হুমকি দিয়ে, পরে যুব কংগ্রেসের লুম্পেনদের দিয়ে বোমা মারিয়ে ।
  ঠিক যেমন মনে পড়ল তসলিমা নাসরিনের কথা --- তাঁর ‘দ্বিখণ্ডিত’ বইটি কি এই বাংলায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করত বলে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের সরকার বইটিকে নিষিদ্ধ করেছিলেন ? পরে যাদের অতি-সক্রিয়তায় লেখিকাকে কলকাতা শহর থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার নোটিশে বেড়াল পার করার মতো করে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, তাঁরা কেউ বাংলাভাষী নন --- ওই বইয়ের একটি অক্ষরও তাঁরা পড়েননি । আর যারা প্রতিবেশী বাংলাদেশে তসলিমাকে নিষিদ্ধ করায় এইদেশে সোচ্চার হয়ে তাঁর ‘লজ্জা’ নিজেরা ছাপিয়ে বিলি করেছেন তারাই আবার মকবুল ফিদা হুসেনকে এইদেশে থাকতে দেননি , দীপা মেহতার ‘ফায়ার’ চলচ্চিত্রের শুটিং পণ্ড করেছেন, ‘পদ্মাবতী’ নিয়ে ইতিহাসবিরোধী হুজুগ তুলে সারা দেশে গুন্ডামি করেছেন । অথচ সালমন রুশদির বিরুদ্ধে ইসলামিক মৌলবাদীদের ধিক্কারযোগ্য অবস্থানে তাদের সায় ছিল । এখন তো বইপড়া বা চলচ্চিত্র বা ছবি নয় কে কী খাবে বা খাবে না তা নিয়েও তাদের মাথাব্যথার অন্ত নেই শুধু নয়, তাদের সবক শেখাতে তারা নিশ্চিন্তে খুন জখম ধর্ষণ করে ধর্মের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছেন । কিন্তু এগুলো কোনোটাই কিন্তু তাদের ক্ষমতার চেয়ারের পায়ার সঙ্গে যুক্ত নয় । এটা একটা প্রবণতা । এই অঙ্গরাজ্যেও তো মাঝে মাঝে কোনও নিউজ চ্যানেল না দেখার বা বিশেষ সংবাদপত্র  না-পড়ার প্রকাশ্য ফতোয়া দেওয়া হয় --- যদিও বাস্তব প্রযুক্তিগত কারণেই এইসব হুকুমনামা এখন  তামাদি হয়ে যায়। তবে প্রবণতাটা থাকে , থেকেই যায় । কণ্ঠরোধ । 
রাষ্ট্রক্ষমতার দাপ  বা একবগগা মৌলবাদীর রক্তচোখেই কি তবে কণ্ঠরোধের জন্ম ও মৃত্যু ? আমাদের চারপাশে যা কিছু চলমান, যা কিছু ঘটমান সব কি তবে নিটোল ও মসৃণ পথে গড়গড়িয়ে চলছে ? এই জিজ্ঞাসার সামনে তাহলে আমাদের থামতে হবে একবার । একটু দেখে বুঝে নিতে হবে চারপাশ, ঠিক যেমন একজন ব্যাটসম্যান পরের বলটি খেলার আগে দেখে নেন ফিল্ডিং সাজানোর আদল । আর তখনই মনে পড়ে যাবে ওই কিশোরীটির মুখ যার পরিবার তাকে পড়াশোনার বৃত্ত থেকে ছাড়িয়ে এনে জড়িয়ে দিতে চায় বিবাহের জটে --- অপরিণত তার শরীর ও মন এই ইচ্ছেকে মেনে নিতে প্রস্তুত নয় অথচ --- তবু সে নিজের কথা বলবে কোথায় ? কোথায় যেন তার কথার ওপর চাপা পড়ে যায় এক ভুল ইচ্ছের পাথর । অথবা, এমনও তো হয়, বিবাহযোগ্যা কোনও তরুণী হয়তো চায় না তার বিবাহের পণ যৌতুকের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাক তার অভিভাবক, তবু .... তবু তাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেনে নিতে হয় এই বেসামাল চাপ আর সেই চাপ যারা দেয় তাদেরই পরিবারের এক পুরুষের সঙ্গে তাকে কাটাতে হয় বাকি জীবন তার সেই না-বলতে-পারা কথার ভার বুকের ভিতর আগলে রেখে। কে থামিয়ে দেয় তার কথা ?  আবার হয়তো একজন ভালবাসে তার কোনও সহপাঠী বা কোনও অন্য বৃত্তের বন্ধুকে, ক্রমশ ঘন হয় সেই যোগ কিন্তু তা কোনও পরিণতিতে পৌঁছানোর আগেই মেয়েটিকে অন্য কোনও জায়গায় বিয়ে দেওয়া হয়, কিছু মুখ ফুটে বলার আগেই অথবা বলার পরেও --- বলা আর না-বলার কোনও প্রভেদ নেই আর --- সমস্তটাই আসলে এক মুখ-চেপে-ধরা অশ্লীলতা !  একটু পুরোন হলেও আজও এমন ঘটে না এমন নয়, যখন তার পুরুষসঙ্গীর প্রয়াণে  স্ত্রীকে তার শরীর থেকে ঝরিয়ে দিতে হয় সমস্ত লাবণ্যচিহ্ন, অলংকার --- পালটে নিতে হয় পোশাক ও খাদ্যাভ্যাস ! এও তো একরকম চাপিয়ে দেওয়া নিষেধের শাসন,  খালি দেখা যায় না ঠিক কে কখন এই নিষেধের পরোয়ানা এনে হাজির করল তার কাছে । কেউ কিছু বলে না,  তবে সকলেই কিছু বলে --- আর এই বলা ও না-বলা জমে ওঠে এক প্রবল নিষেধের পিন্ডে !
শুধু মেয়েদের নিয়েই বা ভাবি কেন ? কত প্রখর তরুণ ইচ্ছে থাকলেও বেরিয়ে আসতে পারে না বিবাহের কিছু পচা সংস্কার আর মন্ত্রোচ্চারণের কদর্যতা থেকে --- কোথাও তার নিজের পরিবার, কোথাও বা মেয়েটির পরিবার একরকম জোর করেই চাপিয়ে দেয় এইসব অনিচ্ছের ডালা । রুচির বিরুদ্ধে গিয়ে মেনে নিতে হয় শ্বশুর বাড়ির যৌতুক, কেন বলতে পারা যায় না এগুলো সে মন থেকেই চায় না !  কেউ বা সারাজীবন বয়ে চলে অশান্তির অন্ধকার --- পারিবারিক নানা অসহযোগ, সম্পর্কের খুটিনাটি ঠোক্কর --- কিন্তু বলা যায় না , গলা আটকে আসে । চারশো আটানব্বই সংখ্যাটা কারোর জীবনে যে আমূল প্রতিবিপ্লব ঘটিয়ে দিতে পারে সেটা কেউ কেউ তাদের জীবন দিয়ে বোঝে । কাছের মানুষ কেমন দূরের হয়ে যায়, চারদিকে হঠাৎই তৈরি হয়ে যেতে থাকে নানা আইনি শিকল --- আর কোনও বিনিময় ঘটে না, ঘটবার সব সুযোগ ও পরিসর মুহূর্তে উধাও হয়ে যায় ।  এমন একটা  অবস্থায় গলা বুজে আসে তবু কিছু বলা যায় না কোথাও । কাকে বলবে সেইসব কথা ? ঠিক যেমন, বিকেলের খেলার মাঠ থেকে জোর করে তুলে আনা শিশুটিকে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়  গৃহশিক্ষকের সামনে --- সে কিছু বলতে পারে না, স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মুখ ভার করে । শিশুটির মুখের ভাষা কেড়ে নেয় কে ? আমরা তাকে চিনি ?  না চিনি না ?  
গত তিরিশ বছর ধরে আমি আমার নিজস্ব বারান্দা থেকে রোজ দেখে চলেছি এক তন্বীকে --- বয়স তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো, বদলায়নি তার গতির বিভঙ্গ, কপালের ওপর উড়ে আসা চুল, হাওয়ায় ভাসা আঁচলের তির্যক কোণ, ভ্রূভঙ্গি ও আঁচিল । তবু আজও তাকে বলা হল না , আসলে যা তাকে বলতে চাই --- চেয়ে এসেছি এতদিন ধরে । কে আমার গলায় কাঁটা হয়ে বিঁধে থাকে ? কে ? রাষ্ট্র ? মতবাদ ? সমাজ ? পরিবার ? নাকি  আমার  না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর তমসা ?


1 comment:

  1. অসম্ভব ভাল লেখা। সমৃদ্ধ হলাম।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...