খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

গ্রন্থ আলোচনা- হিন্দোল ভট্টাচার্য



                     গৃহযুদ্ধের উঠোনে রচিত তর্পণের আখ্যান


কবিতার মধ্যে ব্যক্তিত্বের স্পর্শ এবং স্থিতি, কবিতার নিজস্ব দিগন্তকে বোঝার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সহসা আলোর মতো এই ব্যক্তিত্বের স্পর্শ কবিতায় আসতে পারে না। তার জন্য প্রয়োজন হয় একজন কবির ধারাবাহিক অভিযাত্রার। কবি দীপক রায় সেরকম-ই এক কাব্যব্যক্তিত্ব, যিনি বাংলা কবিতায় সব সারেগামা থেকে একটু দূরে বসেই রচনা করে চলেছেন তাঁর জীবনচর্যার ধারাপাত। আমরা সকলেই জানি, কবিতা আসলে  এক দীর্ঘ দিগন্তের মতো। সেখানে মিশে যায় আপাত খণ্ড সমস্ত চেতনাই। সব অভিজ্ঞতা মিলেমিশে তৈরি করে এক অখণ্ড চেতনাসমুদ্র। দীপক রায়ের সামগ্রিক কবিতাযাপন মনে হয় খণ্ড খণ্ড অভিজ্ঞতা  দিয়ে সেই অখণ্ডকে অনুধাবন করার কাব্যিক ও দার্শনিক বীক্ষা। বীক্ষা তো অনেকের থাকে, কিন্তু তাকে সারাজীবন ধরে ধরে রাখা এক সাধকের কাজ। তা, সে সাধক বহু প্রাচীন কাল আগের হোন বা আধুনিক তথা উত্তরাধুনিক সময়ের। নিজেকে বস্তুত এক গ্রাহক যন্ত্রের মতো করে প্রস্তুত রেখেছেন কবি দীপক রায়।
গৃহযুদ্ধের উঠোনে রচিত - এরকমই এক কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যগ্রন্থটি যেন আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে এক চিরন্তনী মানুষের মানসিক সংকটের ভাষ্য রচনা করছে প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই।

থমকে আছে ঝড়ের পূর্বাভাস
          কে এমন কাটাকুটি করে চলে গেল।

   এক ক্ষতবিক্ষত আলবাট্রস
মাথার ভিতরে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছে
          একটা পাঁচমাথার মোড়

কোন দিকে যাব

                                                    ( আলবাট্রস)

এক সন্ধিক্ষণের মানুষ যেন আমরা। নিজেরাই ভীষণ কনফিউজড। আর এই 'কনফিউশন'-ই আমাদের সবচেয়ে বড় সংকট। আমরা জানি না কোনদিকে যাব। অথচ অজস্র রাস্তা চারিদিকে চলে গেছে। রাস্তা যে নেই, তা নয়। কিন্তু সন্দেহও আছে। বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়ের কবিতাতে যেমন ছিল মাঝপথে নেমে যাওয়া এক মানুষের কথা,যেখানে ভীষণ রাত। অথচ দীপক রায় জানেন, রাস্তা আছে। তিনি রাস্তা দেখতে পাচ্ছেন। অথচ সংশয় তাঁর ভিতরে বাসা বেঁধেছে। তিনি স্থির বিশ্বাসে কোনও একটা রাস্তা অবলম্বন করতে সাহস পাচ্ছেন না। এই একই সংশয় আর সন্দেহ ও আতঙ্ক মিশ্রিত কথা প্রতধ্বনিত হয় তাঁর গৃহযুদ্ধের উঠোনে কবিতাটিতে যেখানে তিনি বলেন-

সারারাত তোপধ্বনি-- বন্দীশিবির থেকে
       লুকিয়ে চুরিয়ে দেখি, কথা বলি নীচু স্বরে

কেউ শুনে ফেলছে না তো?

আমাদের এই সময়কে তিনি বলে ফেলেন কয়েকটি নীচু স্বরে বলা পঙক্তিতে-

যে আগুন লাগিয়েছিল সে নেই
                           জানলা খুলে আগুন
                                  দরজা খুলে আগুন

সবাই জড়ো হয়ে দেখছে
                      ছোটো আগুনের বড় হওয়া
                                   বড়ো আগুনের আরও বড়ো হওয়া

                                                                          (দাবানল)

এমন কিছু অসম্ভব এপিফ্যানিক মুহূর্ত তাঁর কবিতায় ছড়িয়ে রয়েছে। বিশেষ করে এই কাব্যগ্রন্থটিতে আপাত বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু ইমেজ,কিছু কিছু মুহূর্ত একসঙ্গে রচনা করে এক বিশেষ বলার কথা। যেন কিছু মন্তাজ চলছে আর তা রচনা করছে অপ্রত্যাশিত এক অর্থ। কাব্যশৈলীর এই প্রয়োগ কী শান্ত অথচ নিখুঁতভাবে কবির অভীপ্সাকে বাস্তবায়িত করছে, তা দেখার মতো। ক্র্যাফটম্যানশিপ এবং কবিতার প্রাণ কী নির্মেদভাবে কবিতাকে তীক্ষ্ণ করে তুলতে পারে, তা দীপক রায়ের এই কাব্যগ্রন্থ আমাদের প্রায় শিখিয়েই দিতে পারে। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে বার্ষিকী বলে কবিতাটির কথা।

জেল থেকে মুক্তির পর কয়েদির পূর্ণ হল একটা বছর

খুব ভোরবেলা বেরিয়েছে যারা -- আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী

দরজায় তালা দিয়ে বাইরে এলেন মিসেস পাকড়াশি
                                        ওঁর স্বামীর আজ মৃত্যুবার্ষিকী

ওঁরা সকলেই এখন পার্কে যাবেন। ফেরার পথে
          কেউ ফুল কিনবেন-- হিসেব করবেন কেউ

ওঁরা বাড়ি ফিরে চা খাবেন, অন্যমনস্ক।

আখ্যান পর্বের এই কবিতাগুলিতে যেমন কবির ইঙ্গিতময়তা, ইমেজ এবং দর্শন পরস্পর মানুষের গভীর বোধের ভিতরের দরজায় কড়া নাড়ে, তেমনই এই কাব্যগ্রন্থের তর্পণ অংশটি, যা আবার অনেকটাই কবির অন্তর্গত কথোপকথনের মতো ছড়িয়ে আছে।

যেমন মৃত্যুর আগের দিন শীর্ষক কবিতাটিতে কবি লিখেছেন- মৃত্যুর আগের দিন/ রঙ করে যাব বাড়ি
// সামনের চেয়ারখানি/ খালি থাকবে   এসো-
এই যে গভীর ইঙ্গিতময়তার বিষাদ, যা আদপেই অবসাদ নয়, তা-ও দীপক রায়ের কবিতার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই অংশে আরেক মহৎ কবিতার সঙ্গে আমাদের দেখা হয়। কবিতাটি মাত্র দু লাইনের।

এক অনিশ্চিত ফেরিওলার সঙ্গে দেখা হয়
                         এক অনিশ্চিত বসন্তের সন্ধ্যায়    ( ফেরিওলা)

এভাবেই কখনও অজানা, কখনও মন্দারমণির চোরাবালি শীর্ষক কবিতাগুলিতে, আবার কখনও জ্বর শীর্ষক কবিতাগুলিতে তিনি মানবজীবন, মনের অন্দরমহলে প্রকৃতির যে বিপুল দার্শনিক অভিযাত্রা, তাকে ধরার চেষ্টা করেন, প্রশ্ন করেন। কিন্তু সেই সব কথা থাকে নিভৃতলোকের নিরভিসন্ধির মতো। আমাদের বাংলা কবিতার সংসারে এই প্রকৃত নিভৃতচারী কবির সঠিক মূল্যায়ণ হবে, আশা করি। কারণ গভীর ভাবনা তো কখনওই পায়রামহলে চঞ্চলতা সৃষ্টি করার জন্য অকারণ বন্দুক ছোঁড়ে না। সে নিভৃতে কথাগুলি বলে যায়। সে থাকে তার ব্যক্তিত্বের কাছে আজীবন সৎ । এই সততা এবং নির্জন সাধনাই তার রাজনীতি, সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিক সংকটগুলিকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলে। তখন হয়ত বেশি কথা বলার প্রয়োজনও থাকে না। গৃহযুদ্ধের উঠোনে রচিত হলেও তাই এই সব কবিতায় প্রতি আক্রমণের হিংসা নেই, বরং সহিষ্ণু হয়েই বিষাদের অন্দরমহলে ঘুরে বেড়ানোর স্পর্ধাও আছে। আগামী সময়ের দিকে তাই কবি দীপক রায়ের কবিতাকে সময়ের এক মহাসময়ের দিকে চোখ পেতে রাখা দ্রষ্টার আত্মগত উচ্চারণ হিসেবে বাড়িয়ে দিতে পারি।

গ্রন্থ- গৃহযুদ্ধের উঠোনে রচিত
দীপক রায়্
প্রকাশক- আদম
প্রচ্ছদ- সেলিম মল্লিক
মূল্য- ৬০/-



1 comment:

  1. আলোচনা বই পাঠের প্রতি লোভ বাড়ায়।আলোচনাও তেমনি।ধন্যবাদ।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...