কেটে ফেলা জিভ ও একটি চারাগাছ
“ আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া
অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। কিন্তু আমাদের রাজকীয় দণ্ডধারী পুরুষটি
ভাষার ঠিক কোন্ সীমানায় ঘাটি বাঁধিয়া চুপ করিয়া বসিয়া আছেন তাহা আমি স্পষ্টরূপে
জানি না, এবং আমি ঠিক কোন্খানে
পদার্পণ করিলে শাসনকর্তার লগুড় আসিয়া আমাকে ভূমিশায়ী করিবে তাহা কর্তার নিকটও
অস্পষ্ট; কারণ, কর্তার নিকট আমার
ভাষা অস্পষ্ট, আমিও নিরতিশয় অস্পষ্ট, সুতরাং স্বভাবতই তাঁহার শাসনদণ্ড আনুমানিক আশঙ্কা-বেগে অন্ধভাবে
পরিচালিত হইয়া দণ্ডবিধির ন্যায়সীমা উল্লঙ্ঘনপূর্বক আকস্মিক উল্কাপাতের ন্যায়
অযথাস্থানে দুর্বল জীবের অন্তরিন্দ্রিয়কে অসময়ে সচকিত করিয়া তুলিতে পারে। এমন
স্থলে সর্বতোভাবে মূক হইয়া থাকাই সুবুদ্ধির কাজ, এবং আমাদের এই দুর্ভাগ্য দেশে অনেকেই কর্তব্যক্ষেত্র হইতে
যথেষ্ট দূরে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া সেই নিরাপদ সদ্বুদ্ধি অবলম্বন করিবেন তাহারও
দুই-একটা লক্ষণ এখন হইতে দেখা যাইতেছে।”
[রবীন্দ্রনাথ সিডিশন বিল পাশ হবার আগের দিন কোলকাতা টাউন হলে যে বক্তৃতাটি
দিয়েছিলেন, তার অংশবিশেষ।]
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একজন পুরোপুরি রাজনীতিবিদ ছিলেন না, তবু তাঁর এই লেখাটির অংশ
তুলে আনলাম আমদের বর্তমান সময়ের সাহিত্য, শিল্প ও রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে। একটা অদ্ভুত ও
অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে যাচ্ছি এখন। প্রতিদিন সকালে খবরের কাগজ বা
টিভি চ্যানেল খুললে মনে হয় ‘আবহমানের ভাঁড় এসেছে গাধার পিঠে চড়ে।’ প্রতিটি চ্যানেল বা কাগজ
টিকে থাকার জন্য হয় বায়াসড বা পেড নিউজ প্রচার করে চলেছে, অথবা অকিঞ্চিৎকর, অপ্রয়োজনীয় খবরকে অত্যধিক গুরুত্ব দিয়ে
কৃত্রিম খবর সৃষ্টি করে চলেছে। আমরা জানতাম দায়িত্বশীল সংবাদপত্র বা
টিভি চ্যানেল জনসাধারণের রুচি বা মতামত তৈরির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
পালন করে। কিন্তু আজ আমাদের অজান্তে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে অন্যের তৈরি করা
ভুলরুচি এবং নিম্নরুচি আমাদের সিটিংরুম থেকে বেডরুমে ক্রমশ শিকড় চারিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শিল্পসাহিত্য, নিম্নমেধার
মাইক্রোফোনকে উঠিয়ে আনা হচ্ছে সমাজের মুখ হিসেবে। কারণ আপনার সমাজ ও শাসক পছন্দ
করে না আপনি অন্যরকম ভাবুন। বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং। আপনি যদি খোলা হাওয়া পছন্দ
করেন তবে আপনার জিভ কেটে নেওয়া হবে। অর্থাৎ রবীন্দ্রবাবুর এই বক্তৃতার সময় থেকে ‘সেই ট্র্যাডিশন সমানে
চলিতেছে।’ আমি বিশ্বাস করি এই দুর্ঘটনা আমাদের সময়ে একটি
মুক্তচিন্তক সমাজের কণ্ঠরোধের সবচেয়ে বড় সচেতন প্রয়াস।
আপনি তাকিয়ে দেখুন আপনার আমার
চারপাশের সমাজ সবকিছু সহ্য
করতে রাজি। টিভি টিজারের স্ক্রোলে অশিক্ষিত ভুল
বানানে তার কিছু আসে যায় না, মিথ্যে খবরে কিছু আসে যায় না, আপনি ভোটে মনোনয়ন জমা দিতে গিয়ে মার খেলেও খুব কিছু আসে যায় না। আমার মেয়ে
সন্ধ্যবেলা টিউশানি থেকে ফেরার পথে ধর্ষিত হলে নেতা বলবেন তার খোলামেলা পোশাক
যুবকদের কেন উত্তেজিত করেছিল ? মেট্রোতে আমার ছেলে তার বান্ধবীকে চুমু খেলে, কোনো বাহুবলি
প্রৌঢ় তাকে উদোম ক্যালানোর স্বাধীনতা পেয়ে যাবে এবং তাতে বৃহত্তর সমাজের সচেতন
অ্যাপ্রুভ্যাল এমনকি সমর্থন থাকবে। আপনি যদি
হিন্দু হন, একান্ত মানবিক
কোনো ইস্যুতে যদি কোন ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সমর্থন করেন, আপনাকে জোর করে
চুপ করিয়ে দেওয়া হবে। আপনাকে বলা হবে, কই হিন্দুদের অমুক ইস্যুতে তো আপনি প্রতিবাদ করেন নি। আপনার
প্রতিবাদের কোন জায়গা নেই। কারণ আপনি মুক্তচিন্তায় বা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাসী
মানুষ। অতএব আপনি
সংখ্যালঘু। আপনার
প্রতিটি চিন্তনের প্রতিবাদ এবং কণ্ঠরোধ এই সমাজের পবিত্র কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
আপনার
মুক্তচিন্তা এই সমাজের চোখের বালি, প্রাণের বৈরি।
এই সমাজ তার চারপাশের চোর, ডাকাত, বদমাশ, লম্পট, মিথ্যাবাদী, প্রমোটার, রাজনৈতিক
নেতা,
সবাইকে
ক্ষমা করতে, বুকে
জড়িয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু সমাজ উদ্ধত জিভকে সহ্য করতে পারে না। চোর, জুয়াড়ি, লম্পট
এবং ধর্ষককেও সে একটু নিন্দা, একটু বিরক্তি, একটু
ক্ষোভ প্রকাশ করেই ক্ষমা করে নিতে প্রস্তুত (তাই ধনঞ্জয়কে নিয়ে আজও সিনেমা তৈরি হয়)। কিন্তু
নাস্তিক,
অবিশ্বাসী,
এবং
প্রশ্নকারীর অন্য স্বরকে সমাজ কখনো মাফ করতে জানে না। তার জিভ কেটে
নিলে তবেই সে স্বস্তি পায়।
এই কণ্ঠরোধের
ইতিহাস নতুন কিছু নয়। যীশু, মহম্মদ
থেকে শুরু করে গ্যালিলিও, সোক্রাতেস, কোপার্নিকাস, জিয়োর্দানো
ব্রুনো, এঁদের
প্রত্যেকের শরীরের প্রতিটি ক্ষততে সেই ইতিহাস লেখা আছে এবং তার ধারাবাহিকতা আজও
প্রবাহিত হচ্ছে প্যান এশিয়ান ভূখণ্ডে।
এই পোড়াদেশকে আমরা
পৃথিবীর বৃহত্তম গনতন্ত্র বলে একটি মূর্খ দাবী তুলি। একটি
স্বশাসিত আন্তর্জাতিক সংস্থা, ‘রিপোর্টারস উইদাউট
বর্ডারস’ যারা প্রতি বছর
সংবাদমাধ্যমের বাকস্বাধীনতার সূচক নির্দেশ করেন তাদের রেটিং অনুযায়ী ২০১৭ সালে ভারতের স্থান ১৩৬তম। এটি আদৌ শ্লাঘার
বিষয় নয়, অপমানের বিষয়।
কারণ এর অর্থ মুক্তচিন্তার
কণ্ঠরোধ। এই ধর্মান্ধ উপমহাদেশের ক্ষেত্রে আমরা বারবার দেখেছি ২০১৩ সাল
থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত দশজনেরও বেশী ব্লগারকে
হত্যা করা হয়েছে। শাস্তি দূরের কথা বেশীরভাগ মামলায় কোন
অগ্রগতি হয় নি। একটি মাত্র মামলা বাংলাদেশের সুপ্রিম
কোর্ট অবধি গিয়েছে। আমাদের দেশেও ধর্মীয় সংখ্যাগুরুর দ্বারা
কণ্ঠরোধের প্রয়াস আজ ভয়ংকর। বিজেপি রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসার পর থেকে তাদের অঘোষিত নীতি ভারতে
হিন্দুত্ববাদীদের শাসন প্রতিষ্ঠা করা। এই দলের অশিক্ষিত এবং মূর্খ নেতারা ইতিহাসকে
এবং ইতিহাসের যুক্তিকে সরাসরি অস্বীকার করেন এবং তাঁরা সংখ্যালঘুর সমানাধিকারের
বিরুদ্ধে। সমস্যাটা এই পর্যন্তও ততটা নয়।
সমস্যা শুরু হয় প্রথমে যুক্তিবাদীর নাস্তিক্য নিয়ে। আমরা জানি যিনি পুরোনো সমাজধর্মের রীতিনীতি
ও ঐশ্বরিক আচার-সংস্কারে অবিশ্বাসী, প্রশ্ন তোলেন, তিনিই নাস্তিক। আজ বিজেপির ডায়েরিতে তিনিই অসামাজিক এবং বেইমান। অথচ এই নতুন চিন্তক তথা প্রশ্নকারী নাস্তিক ব্যক্তিটি কিন্তু কারো
কোন বৈষয়িক ক্ষতি করছেন না। তিনি তাঁর
ধর্মবিষয়ক অবিশ্বাস প্রকাশ করছেন মাত্র। নাস্তিকেরা সাধারণত বিবেকবান, বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদী, কল্যাণকামী
ও নৈতিক
সাহসে ঋদ্ধ। এজন্যে সাধারণ ভাবে নাস্তিকদের থেকে
নৈতিক বা বৈষয়িক ক্ষতির কোনো আশঙ্কা থাকে না। তবু তাকে সমাজ
প্রমূর্ত উপদ্রব বলেই মনে করে। তাই নাস্তিকের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ
সংগ্রামে সবাই সর্বক্ষণ প্রস্তুত । ইতিহাস বলেছে
নাস্তিক হওয়া সহজ নয়। এ এক অনন্য মানসিক শক্তিরই অভিব্যক্তি। বিশেষ জ্ঞান, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা
ও মনোবল না থাকলে নাস্তিক হওয়া যায় না। আশৈশব লালিত বিশ্বাস-সংস্কার, আচারআচরণ, রীতিনীতি
পরিহার করা সাধারণের পক্ষে সম্ভব নয়, কেবল অসামান্য
নৈতিকশক্তিধর যুক্তিবাদী মানুষের পক্ষেই
তা সহজ। তাই প্রাচীন ও আধুনিক দুনিয়ার প্রায় প্রত্যেক প্রখ্যাত নাস্তিকই
সুজন,
সুনাগরিক
ও মনীষী। মানুষ হিসেবে এদের সামাজিক দায়িত্বজ্ঞান, কর্তব্যবোধ
ও কল্যাণবুদ্ধি অপরের চাইতে অনেক
তীক্ষ ও তীব্র । কিন্তু বর্তমান সমাজের চোখে এদের এ চেহারার গুরুত্ব নেই।
এদের থামানোর জন্য প্রতিযুক্তির সাহায্য না নিয়ে বরং ধর্মান্ধ খুনীরা
চাপাতি ও বন্দুক তুলে নেয় মুক্তচিন্তাকে থামানোর জন্য। তাই বারবার ব্লগাররা এই উপমহাদেশে খুন হন। কালবুর্গী, গৌরী লঙ্কেশ, শাহজাহান বাচ্চু, সুজাত বুখারি সবাইকে মরতে হয় ধর্মান্ধ উগ্রপন্থীদের হাতে। কর্নাটকের সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশ খুন হন গত শারদোৎসবের আগে
৫ই সেপ্টেম্বর, আর কাশ্মীরের সাংবাদিক সুজাত বুখারি খুন হলেন ঈদের ঠিক আগে। এসব প্রমাণ করে
এই সমাজে বাঁচতে গেলে আপনাকে শাসক ও ধার্মিকদের অনুগামী হতে হবে। রাজনৈতিক বেশ্যাবৃত্তিতে সামিল হতে হবে। নইলে
নির্মম ভাবে আপনার গলা টিপে ধরা হবে। জানি না, ধর্মীয় উগ্রতা কোন পর্যায়ে পোঁছালে সমস্ত শুভবুদ্ধি বিসর্জন দিয়ে মানুষকে
নির্মমভাবে হত্যা করা যায়।
বেশীরভাগ ধর্মানুসারেই, পৃথিবী ও সমস্ত প্রাণীকূলের সৃষ্টিকর্তা হলেন স্বয়ং ঈশ্বর। তাই নিজের
সৃষ্টি যদি তাঁর বিরোধিতাই করে, তার শাস্তি দেওয়ার মতো ক্ষমতা ও অধিকার তাঁরই হওয়া উচিৎ । তিনি কাউকে ‘সুপারি’ দিতে পারেন না। ধর্মরক্ষার সবথেকে বড়ো দায়িত্ব তো সেই ঈশ্বরের। বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক আবুল ফজল তাঁর ‘মানবতন্ত্র’ প্রবন্ধে এবিষয়ে একটি সুচিন্তিত বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। তিনি সেখানে ধার্মিক ও সাহিত্যিকের পার্থক্য তুলে ধরতে একটা উদাহরণ
দিয়েছিলেন। সেটা হলো, একজন ধার্মিককে যদি বলা হয় বিধর্মীকে হত্যা করলে সে স্বর্গলাভ করবে, তাহলে একাজ করতে সে ইতস্ততঃ করবে না। কিন্তু বিপরীতে একজন সাহিত্যিক তথা শুভবোধসম্পন্ন মানুষের
কাছে মানব হত্যা করে স্বর্গলাভ চিন্তার বাইরে। সে বিশ্বাস করতে
পারবে না সে ঈশ্বর এমন নির্দেশ দিতে পারে। কিন্তু ধার্মিক সম্ভব-অসম্ভবের বিচার
করবে না। দুজনের মধ্যে ফারাক এক জায়গায়। আর তা হল অন্ধ বিশ্বাস আর অন্ধ অনুকরণ।
ধর্মরক্ষার জন্যেই সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশের উপর গুলি চালিয়েছিল বলে কর্নাটকের সিট বা বিশেষ
তদন্তকারী দলের জেরায়
স্বীকার করেছে শ্রীরাম সেনার সক্রিয় সদস্য পরশুরাম ওয়াঘমোরে। জেরার মুখে পরশুরাম
বলেছে, সে জানতই না গৌরী লঙ্কেশ কে ? তিনি নারী
না পুরুষ। এমনভাবে তার মগজ ধোলাই করা হয়েছিল যে, সে এইসব প্রশ্ন করার কথা একবারও ভাবে নি। শুধু তাকে বলা হয়, এনার জন্য ধর্ম সঙ্কটে। আর সেই ধর্মরক্ষার জন্য
ধর্মের ষাঁড় গুলি করে মারল নিরীহ মহিলা সুনাগরিক লঙ্কেশকে। কিন্তু তাতে কি কট্টরপন্থী হিন্দুত্বের দিকটিই আরো প্রকট হল
না ? যারা তাকে লঙ্কেশ
হত্যার নির্দেশ দিল, তারা কি প্রকৃত অর্থে ধার্মিক? তাদের
ভিতরে কি সামান্য ধর্মবোধও আছে ? এ ব্যাপারে
বলা যায়, হিন্দু, মুসলমান, খ্রিস্টান
যাই হও না কেন, খাঁটি
অর্থে যারা ধার্মিক তারা কখনও নিজের বা অপরের মনুষ্যত্বকে আঘাত হানতে পারে না।
মানবতাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে পারেনা। তবু
ইতিহাস দেখিয়েছে দ্রোহীরা
চিরকালই সনাতনীদের হাতে লাঞ্ছিত ও নির্যাতিত।
সবসময়ে এই কণ্ঠরোধ আবার এত উচ্চকিত ও সরাসরি নয়। মানুষ ইদানীং সোশ্যাল
মিডিয়ার দেওয়ালে অনেক স্বচ্ছন্দ। যেহেতু
এই দেওয়ালে কোন সেন্সরসিপ নেই, এই দেওয়ালে মুক্তচিন্তার মত প্রকাশ করতে পারা আমাদের
উচিত। এখন ধরা যাক আপনি ক্রীড়ামোদী, এবং যে কোন
দুদলের খেলায় আপনার পছন্দের দলকে আপনি সমর্থন করছেন, সে সমর্থনের ভিত্তি ক্রীড়াকুশলতা বা ব্যক্তিগত পছন্দ
ইত্যাদি যা খুশী হোক না কেন। ভারত পাকিস্থান খেলায় আপনি পাকিস্থানকে সমর্থন করে একবার দেখুন। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই মত
প্রকাশ করলে আপনি ভয়াবহ ট্রোলিং-এর শিকার
হবেন। সমাজের স্বঘোষিত কীবোর্ড ওয়রিয়ররা আপনাকে
অ্যান্টিন্যাশানাল তকমা দিয়ে দেশ ছেড়ে পাকিস্থানে
থাকার পরামর্শ দেবে। আপনার বাড়ি আক্রান্তও হতে পারে। অর্থাৎ সমাজ ও
সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় আপনার ব্যক্তিগত পছন্দ ও যুক্তিকে ওভাররাইড করে ঠিক করে দেবে আপনি কি করবেন। আপনার নিজস্ব
জিভ ও কলমকে তা ঠিক করতে দেওয়া হবে না। আমাদের প্রত্যেককে তো এই সমাজেই বেঁচে
থাকতে হয়, বাজারে যেতে
হয়, চায়ের দোকানে
আমাদের বন্ধুরা বসে থাকেন। আপনি কোথায় নিজেকে প্রকাশ করবেন ? মেডুসার চোখ
আপনাকে পাথর করে দেবে।
শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রটা বিশেষ করে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ নামক রাজ্যটিতে
একটু ঘেঁটে দেখা যাক। ধরা যাক আমি কবিতা বা গল্প লিখে থাকি। ব্যাপক অর্থে শিল্পসংস্কৃতির
খানিকটা চর্চা আমার সখ। এখন এটা জানার জন্য পি-এইচ-ডি ডিগ্রি লাগে না যে কবিতা লিখে আজকাল সংসার নির্বাহের
মত অর্থ উপার্জন কারোর পক্ষেই সম্ভব নয়, আমার তো নয়ই। কোনদিন ছিলও না। এমনকি রবিবাবুকেও তাঁর
নিজের পয়সাতেই কবিতাবই ছাপতে হতো, এবং সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ একবার হূমকি দিয়েছিল, তাঁর অবিক্রিত বইগুলি সমাজের লাইব্রেরীঘরে ডাই হয়ে পড়ে
আছে, যদি না সরানো
হয়, ইত্যাদি
ইত্যাদি। লিখে লক্ষ্মীলাভ না হলেও আমি যদি যোগ্য হই, তো খানিকটা স্বীকৃতি, একটা পুরষ্কার, অনুষ্ঠানে কবিতা পাঠের সুযোগ, এগুলো তো চাইতেই
পারি। এই অবধি কোন সমস্যা নেই। কিন্তু
অর্থ ও ক্ষমতা একান্তভাবেই শাসকের হাতে। তাই তৃতীয় বা চতুর্থ
শ্রেনীর শাসকদল ঘনিষ্ঠ কবিরা ঠিক করে দেন
কে পুরষ্কার পাবে। কাকে অনুষ্ঠানে ডাকা হবে ইত্যাদি। প্রায়শই তাঁদের অজ্ঞতাবশত
রবীন্দ্র বা আকাদেমি পুরষ্কারের যোগ্য কবিকে সন্তুষ্ট থাকতে হয় শিশুসাহিত্যিকের
সান্ত্বনা পুরষ্কার নিয়ে। আপনি যদি প্রতিবাদ করেন এই নেক্সাস আপনার গলা টিপে ধরবে।
আপনাকে কবিতাউৎসব বা সাহিত্য অনুষ্ঠানে ডাকবে না। টোটাল বয়কট এবং তাতে মদত থাকবে
ফুরিয়ে যাওয়া দাদা কবিদের যারা কবিতার বদলে এখন এই সব পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতিতে অনেক
বেশী উৎসাহী। এটা কি আপনার এবং শিল্পসাহিত্যের মুক্ত চিন্তার গলা টিপে মারার কল নয়
? আপনি ছবি
আঁকলে একই অবস্থা। আপনার ছবি সরকার কিনবে না। আপনি কোনো গ্রান্ট পাবেন না। উল্টোদিকে আপনি চোখ বড় বড় করে দেখবেন
বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতার আঁকিবুঁকি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের উচ্ছ্বাস।
এই দ্বন্দ্ব চিরকালীন। রক্তে আগুনে বিপর্যস্ত পৃথিবী
বারবার এই গলা টিপে ধরা দেখেছে। আসলে এই ক্ষতিটা করেছেন আমাদের মহাপুরুষেরা। যদিও তাঁরা নিজেরাই পিতৃধৰ্ম ও সমাজদ্রোহী এবং নীতি-সত্যের চিরন্তনতায়
আস্থাহীন, এবং তাঁদের
সমসাময়িক নতুনের যুক্তিবাদী প্রবক্তা, তবু লোকস্মৃতিতে অমরত্বের মোহে পড়ে তাঁরা তাদের উদ্ভাবিত মত
ও পথের উপযোগের চিরন্তনত্ব দাবি করেছেন এবং স্থায়ী
ক্ষতির পথ ও ধ্বংসের কারণ সৃষ্টি করে রেখেছেন। তা নইলে কি আর আমরা ছোটবেলায় দেওয়াল লিখনে দেখতাম ‘মার্কসবাদ বিজ্ঞান, কারণ ইহা সত্য’। যারা নিজেদের জীবনে নতুন সভ্যতার কল্যাণকামী পথ ও দর্শন তৈরি করে গেছেন পুরনো সবকিছু অকেজো বলে বর্জন করে। তাঁরাই কামনা করেছেন
নিজেদের বাণী, প্রবর্তিত মতাদর্শ ও নিয়মনীতি চিরকাল সভ্যতার নিয়ামক হিসেবে সনাতন হয়ে টিকে থাকুক। এই প্রবণতা থেকে প্রকৃতপক্ষে চিরন্তনতার বিরোধীরা চিরন্তনতারই শিকার হন। নশ্বরতার প্রতি বীতরাগ এবং অবিনশ্বরতা ও
অমরত্বের প্রতি আকর্ষণ একটা
মানবিক দুর্বলতা। এই দুর্বলতার জন্যেই সমকালীন প্রজ্ঞাবান মানবপ্রেমিক নিজের অজ্ঞাতেই অমঙ্গলের অনিবার্য কারণ হয়ে ওঠেন। এই অমরত্বের আকাজক্ষাতেই উৎপত্তি হয় আইকনের। অনুগত মানুষদের মন-বুদ্ধি বন্ধ্যা করে দেয় আইকনোক্ল্যাস্টি। সাধারণ মানুষ নতুন চিন্তার পরিশ্রম নিতে চায় না। তারা পুরুষানুক্রমে পিতৃধনের মতো
এই পৈতৃক মতাদর্শ ও রীতিনীতি অনুসরণ করে নিশ্চিত জীবনযাপন করতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাতে ক্ষমতারও সুবিধে। তারা নিজস্ব গুরুবাদী দালাল
তৈরি করতে পারে যারা ছুঁড়ে দেওয়া এঁটো হাড়ের বিনিময়ে এই ইমারতটাকে টিকিয়ে রাখবে।
কিন্তু বন্ধু, আপনি যখন নতুন চিন্তা, নতুন সারমন উচ্চারণ করবেন, তখন আপনাকে তো এই শান্তি, এই স্টেবল সিস্টেমের এনট্রপি, ভেঙে ফেলার অপরাধে
অভিযুক্ত করা অনিবার্য। আপনার জিভ তো কেটে ফেলা হবেই। আশার কথা তবু এই পৃথিবীতে সোক্রাতেস থেকে সুজাত বুখারিরা মৃত্যুর পরেও টিকে থাকেন। আর
তাঁদের হাড়মাংসের সারজল পেয়ে সেই কাটা জিভ
থেকে একদিন আবার চোখ মেলে একটি নতুন চিন্তার চারাগাছ।
অমিতের এমন চিন্তা আমাকেও অমিত করে তোলে । এটাই দরকার বলে আমার মনে হচ্ছে এখনো ।
ReplyDelete