খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ- শুভদীপ নায়ক

ক্রোড়পত্র




'কণ্ঠরোধ'— মানুষের চিৎকার, গণকণ্ঠের দাবি


আলোর বিদ্রোহ না থাকলে অন্ধকার বীভৎস গাঢ় হয়ে ওঠে । পরিত্যক্ত পাতকুয়োর নিচে থাকা শীতল জল, এবং সেই নিস্তরঙ্গ জলের আরও নিচে জমিয়ে রাখা অন্ধকার কেমন, তার খোঁজ করতে শুরু করেছে মানুষের মন, মানুষের প্রশ্ন , মানুষের দ্বিধাহীন আত্মপ্রত্যয় ।


একটা কারাগারের দরজা খুলে গেল । সেখান থেকে সারিসারি মানুষ, প্রত্যেকে এতকাল বন্দী ছিল , সকলের হাত-পা বাঁধা ছিল লোহার শিকলে , তারা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে । তাদের কি মুক্তি আসন্ন  ? নাকি তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অন্য আরেকটি পৃথক কারাগারে ? সুদূর ইতিহাস থেকে আজ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী শাসনকর্তারা মানুষকে ভাগ করে নিয়েছে বিভিন্ন সম্প্রদায়ে । সরিয়ে রেখেছে আলাদা আলাদা প্রেক্ষাপটে । কেননা অবিভক্ত মানুষ যখনই পথে নেমেছে, সংগ্রাম করেছে, কিংবা ছবি এঁকেছে, অথবা লিখেছে,— সৃষ্টির ইতিহাসে তা পরিণত হয়েছে বিদ্রোহে । বিদ্রোহ প্রাণ কেড়েছে , ক্ষমতাচ্যুত করেছে , নাড়িয়ে দিয়েছে সময়কে । আবার ভেঙেও গেছে, পরাস্ত হয়েছে,—সব মিলিয়ে দেশের মানচিত্রে একটা বদল ঘটে গেছে । যে ব্যাপারটা নিয়ে বলতে শুরু করেছিলাম, সেটা ছিল অন্ধকার, সেটা ছিল একটা চিৎকারকে আবদ্ধ জলের মধ্যে নিঃশব্দে ডুবিয়ে মারার একটা আক্ষরিক প্রয়াস । সার্ত্র বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না, যুদ্ধ শুরু হয় , এবং সেই যুদ্ধ চলতেই থাকে ।  একটা যুদ্ধ মীমাংসায় পরিণত হওয়ার আগেই নতুন দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়ে যায় ।’ অন্ধকারের মধ্যে আমি তার চুরুটের ধোঁয়াটির কথা মনে করি । আগুনে তামাক পুড়ে সেই ধোঁয়া মিশে যাচ্ছে অন্ধকারে । বাতাস ভারী হচ্ছে আরও । নিষিদ্ধ পত্রিকায় লেখালিখি করার জন্য গ্রেপ্তার হলেন তিনি । ছাড়া পেলেন, আবারও নেমে পড়লেন বিরুদ্ধতার পথে এবং টিকে রইলেন বিরোধীর ভূমিকাতেই । ফ্রান্সের রাজপথে ছাত্র আন্দোলনের আগুনে যোগ করলেন যুক্তির বাতাস । সরে গেল ছাই, নিভন্ত আগুন গর্জে উঠল । পুড়ল টায়ার, আহত শতাধিক ছাত্রছাত্রী, আক্রমণ চলল বহু নিরাপরাধের ওপর । পরিশেষে আন্দোলনকে মদত দেওয়ার অপরাধে তাঁর বিরুদ্ধে জারি হল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা । 


পিছিয়ে যাই আরেকটু অন্ধকারে, শাসকের বিরুদ্ধে শাসিতরা জমা হয়েছে ব্রাসেলস্-এ । প্রলেতারিয়েত সমাজব্যবস্থা তৈরির দাবিতে জড়ো হচ্ছে দুনিয়ার শ্রমিক-মজুর-খেটে খাওয়া মানুষের দল । জড়ো হচ্ছে শতাব্দীর সেরা দার্শনিক কার্ল মার্কসকে সামনে রেখে । মার্কস তার নিজের জীবনের দারিদ্র্য , স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের লন্ডনে রেখে চলে এলেন । কী হবে তার ভবিষ্যৎ, আদৌ তার সংগ্রাম তার চেতনা প্রবাহমান সমাজব্যবস্থাকে ধাক্কা দিয়ে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে কি ? কার্যত এসব না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়লেন বিদ্রোহে এবং পৃথিবীর বুকে টিঁকে গেলেন আমৃত্যু পর্যন্ত । ইতিহাসের এই পথ ধরে পরিকল্পিত ন্যায়নীতির মাধ্যমে যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন , তাঁরাই পরিণত হয়েছেন নিষ্ঠুর শাসকে । হিটলার, মুসোলিনি, স্ত্যালিন থেকে শুরু করে বিশ্ব ইতিহাসে এই উদাহরণের কোনও অভাব নেই । এমনকী দেখা গেছে, আজকের মুক্তি কালকের শোষণ হয়ে মানুষের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ ঘোষণা করেছে । 


উল্লেখ্য , যে কথাগুলো বললাম তা সমষ্টি মানুষের ক্ষেত্রেই শুধু গুরুত্বপূর্ণ নয়, একইভাবে ব্যক্তিমানুষের ক্ষেত্রেও সেটা ভীষণভাবে জরুরি । বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি কবি হয় , কিংবা কোনও শিল্পী , অথবা যদি তার মধ্যে ফুটে ওঠে দার্শনিক জিজ্ঞাসা । একটা একটানা রাত, সেই রাতের নিচে শিল্পীর ভাবনাগুলো ঝরে পড়ে অন্তহীন সত্য হয়ে ।  ভাবনা, যা এমন একটা জিনিস যেটা কখনই মেনে নেয় না একতরফা সিদ্ধান্তগুলোকে । সৃষ্টিকে প্রশ্ন করা, নিয়মকে আমল না দেওয়া, গতানুগতিক জীবনকে প্রত্যাখ্যান করাই শিল্পীর সত্যিকারের পরিচয় । যে কোনও মহৎ শিল্পের পরিভাষা যদি লক্ষ্য করি, তা হলে আমরা দেখব যুগে যুগে গড়ে ওঠা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার মাধ্যমেই সেই শিল্প অমর হয়ে আছে । আসলে, সেইসব বিখ্যাত সৃষ্টি সর্বদা আক্রমণ করে প্রবণতাকে ।  ধরা যাক, নগ্নতা । নগ্নতা মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় । মানুষের ভিতরে যে আসল মানুষ চাপা থাকে, তাকে শিল্পী ফুটিয়ে তোলে ছবিতে । যুগান্তের কঠোর বর্বরতার বিরুদ্ধে ওটা হল মানুষের ভালবাসার নিদর্শন । তেমনি, একজন লেখক তার লেখনীতে ফুটিয়ে তোলে ছবি । বৈচিত্র , খণ্ডিতাংশ, বিভাজনের পাশাপাশি কাহিনি ,চিত্রনাট্য কিংবা কবিতা তখন আর শুধু শিল্পকলায় সীমাবদ্ধ থাকে না । নেমে আসে শাসনের ওপরে , চাপ সৃষ্টি করে , কৈফিয়ৎ দাবি করে । প্রতিটি আন্দোলন তাই ভেঙে যাওয়ার পরেও টিঁকে থাকে ইতিহাসে । ফেরৎ আসে অন্য ভূমিকায় । কিন্তু , ততদিনে বদলে যায় সামাজিক মানচিত্র । 


বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলনের সময়ও প্রচেষ্টা করা হয়েছিল কলমকে থামিয়ে দেওয়ার । অশ্লীলতার দায় চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল একাধিক কবির প্রকাশিত কবিতা, কাব্যগ্রন্থের ওপর । বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা । অশ্লীলতার দায় চেপেছিল বুদ্ধদেব বসুর ‘রাত ভরে বৃষ্টি’ কিংবা সমরেশ বসুর ‘প্রজাপতি’-র মতো উপন্যাসেও । কণ্ঠরোধ, কলমরোধ, আন্দোলনকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া , এরূপ নানা রকমের কার্যকলাপের মাধ্যমে শাসক তার আধিপত্য অক্ষুণ্ণ  রাখতে চেয়েছে । কিন্তু একসময় সরে গিয়েছে ঔদ্ধত্য , ঝরে পড়েছে একনায়কতন্ত্র । ফ্যাসিস্টতুল্য মনোভাবকে পথ থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে । এখানে একটা প্যারাডক্স আছে , রাষ্ট্র কখনও সরাসরি মানুষকে মারে না । এতে তার ওপর গণহত্যার দায় আরোপিত হয় । রাষ্ট্র মানুষকে মারে পিষে ফেলার মাধ্যমে । অধিকার থেকে বঞ্চিত করার মাধ্যমে । গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সৃষ্টি করে মানুষকে ভাগ করে নেয় ছোট ছোট দলে । এর ফলে বৃহত্তর জনসংখ্যাকে শাসন করা যায় সহজেই । বিপুল জনসমষ্টিকে নৈতিকতায় পৃথক করে রাখলে তারা অাত্মবিরোধিতায় মেতে থাকবে , এর ফলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কেউ কখনও প্রশ্ন করবে না, রাষ্ট্রের তৈরি করা সিদ্ধান্তের কোনও বিরোধিতা উঠে আসবে না । ম্যাকিয়্যাভেলি প্রথম বলেছিলেন, ‘সাধারণ মানুষের ব্যবহার ও ব্যক্তিবোধ খুব নিচু ধরণের । তারা কখনও সত্যের জন্য জিজ্ঞাসু হয় না । প্রাপ্যকে যাচাই করে নেয় না । কেননা তাদের মধ্যে রাষ্ট্রবিরোধিতার ভয় কাজ করে । ’ একজন কবির , লেখকের কিংবা শিল্পীর কাজ হল মানুষের ভিতর থেকে এই রাষ্ট্রভীতিকে সরানো, এবং সেই কাজ একমাত্র হতে পারে শিল্পের মাধ্যমে । প্রথমত, রাষ্ট্রের ন্যায়নীতি সম্পর্কে সন্দিহান প্রকাশ করলে মানুষ শুরুতেই কেন তা মেনে নেবে ? শিল্পের মধ্যে সৃষ্টি করা চাই সংস্করবিরোধী টান, চিরাচরিত সত্য । এবং সেটা করতে পারলেই, মানুষ আপনা থেকে সেটিকে নিজের জীবনে গ্রহণে করা শুরু করবে । ফলে রাষ্ট্রব্যবস্থার নির্যাতন তাদের ওপরে আর খাটানো যাবে না । কোনও অসত্য তাদের ওপর আরোপ করা যাবে না । প্রতিটি প্রাপ্যকে তারা যাচাই করতে শিখবে । বিশ্বের ইতিহাসে খ্রীষ্ট, গ্যালিলিও, সক্রেটিস,—এঁরা কি ন্যায় প্রতিষ্টা করেননি ? কিন্তু এঁদেরকে মরতে হয়েছে রাষ্ট্র কিংবা কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর হাতে । সক্রেটিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি রাষ্ট্র সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছিলেন । পৃথিবীর বহু দেশে , একাধিক সভ্যতায়, বিভিন্ন সময়কালে এমন অনেক নিদর্শন ছড়িয়ে আছে যা চিৎকার করে সত্য প্রতিষ্ঠার তাগিদগুলোকে জন্ম দিয়ে গেছে । যুদ্ধ, অস্ত্র এবং কারাগার এগুলোর বিপুল ব্যবহার তো আসলে কণ্ঠরোধের ক্ষেত্রেই হয়েছে । আইন তৈরি হয়েছে , কিন্তু সেই আইনের শাসন জারি নেই । তার নেপথ্যে বাসা বেঁধেছে শাসকশ্রেণীর ফ্যাসিস্ট সিদ্ধান্তগুলো । 


পরিশেষে এটুকু বলতে পারি, যে মানুষ কবি কিংবা শিল্পী ,—তিনি নেহাৎ একজন মানুষই শুধু নন, তিনি আসলে গণকণ্ঠের তীব্র উচ্চারণ । যতবার শাসকের ভূমিকায় কেউ না কেউ এসেছেন , ততবার শিল্পীর অাবির্ভাব হয়েছে শাসনব্যবস্থার বিপরীতে । চেষ্টা হয়েছে কণ্ঠরোধের , কিন্তু একটি বিদ্রোহ সহস্র বিক্ষোভকে অগ্নিসংযোগ করে গিয়েছে । ঠিক এই কারণেই সার্ত্র বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ কখনও শেষ হয় না, যুদ্ধ শুরু হয় এবং চলতেই থাকে । ’


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...