খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

10.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ - বেবী সাউ

ক্রোড়পত্র
               

                 
                 এক লোভী রাজার মুকুট

লোকে তাকে রাজা সাজায়। রাস্তাঘাট দেখলেই নত করে মাথা। হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকে বহু পুরনো গাছ। প্রথম প্রথম তারও অস্বস্তি হত। লজ্জা লজ্জা। তারপর সয়ে গেল সবকিছু। তারপর একদিন সে নিজেকেই নিজে রাজা ভাবল। হাঁটল রাজার মতো। কথা বলল রাজার মতো। সে তখন সত্যি সত্যি রাজা। সবার দুঃখে-সুখে সেই ভগবান। ঝাঁপিয়ে পড়ে দুর্যোগে। প্রলয়ে। আবার সুখের ফোয়ারা ছোটে তার ঘরের দালালে। ভরাট রাজ্য তার, সংসার। অহংকার যে কখন চুপিসারে ঢুকে পড়েছে ঘরে, বোঝাই যায়নি। এখন  অতটুকু সম্মান না পেলে নিজের নিজেকেই অপমান লাগে। কেমন একটা ভাব! একের পর এক দুঃসাহসিক কাজ তখন তার। এই সূর্য থেকে ছিনিয়ে আনছে আলো। এই পেতে ধরছে সত্যের জন্য অনুসন্ধিৎসু মন। আর সারা গ্রাম তাকে বাহবা দিচ্ছে। মেনে নিচ্ছে তার কলা-কৌশলের দক্ষতা। 

   সাধারণ মেয়ে তখনও সে। মা-মরা। সৎ মা তাকে দুচোখে দেখতে পারেনা। ঘৃণার আসন দখল করে থাকা সেই মেয়ে ধীরে ধীরে বিষে পরিণত হয়। প্রেম নেই, ভালোবাসা নেই, স্বীকৃতি নেই। সমস্ত নেই-র মাঝে কেমন যেন এক হিংস্র আছে। হিংসা তৈরি হয়।  মেয়ে চারপাশে তাকায়। ইচ্ছে করে সমস্ত সমাজকে পাল্টে দিতে। কিন্তু সে যে জন্ম অভাগী। সে যে নিঃস্ব। গজিয়ে উঠা অন্ধকার। আলোর বিপরীত তো থাকবেই। তার এই খোঁচানো চোখ নিয়ে কতটুকু নেই কে পাল্টে ফেলা যায়! কীভাবে ভেঙে ফেলা যায় এই না-পাওয়ার দুনিয়াকে! নিজেই নিজের জন্য হিসহিস করে ওঠে। ব্যর্থ ভাবে তাকায় শূন্যে। আর তখনই...

রাজা আসছেন হাসতে হাসতে। রাজা আসছেন ভালো বাসতে বাসতে। আলো হয়ে জ্বলছে তার চোখ। ভালো হয়ে উঠছে তার থাকা-খাওয়া-পরা। ভালোবাসা ধরিয়ে দিচ্ছে গোলাপ। সুগন্ধী আতর। আর রাজা এত সব কিছুর মধ্যে পাড়ি জমাচ্ছেন দুঃসাহসের দিকে--- দিগন্তের আকাশ ছিনিয়ে আনতে। মেয়েটি অপলকে দেখছে। মেয়েটি অপলকে ভাবছে। হবে তার স্বপ্ন পূরণ হবে। কেউ যদি স্বীকার করে নেয় তাকে-- রাজা পদবাচ্য-- নেতা, মন্ত্রী-- তবে সমাজও মেনে নেবে তাকে। সমাজ তখন রাজার চোখ দিয়ে তাকে দেখবে। ভাববে, অন্ধকার কখনও অপয়া নয়-- এই দৃশ্যের জগত ঘুমিয়ে আছে তার চোখে। বলবে, আলো যতটা জরুরি অন্ধকারও তাই। মুছে যাবে কানা মেয়ের জ্বালা। আশা বুকে ভরে হাত পেতে দাঁড়ালো রাজার কাছে-- " দাও রাজা! শুধু সবাইকে বল, এই মেয়ে পঙ্গু হতে পারে, কিন্তু শক্তির অধিকারি। বল, ভালোবাসা পেলে এও আলো এনে দিতে পারে সূর্যাস্ত থেকে। বল, রাজা--- একবার শুধু বল!" রাজা নিরুপায়। রাজা তখন প্রজা বশবর্তী। ইচ্ছে থাকলেও বলা যাবে না বিরুদ্ধ কিছু। পদের ভার যে অনেক বেশি। করুণা অথচ তাচ্ছিল্য ভরা চোখ একবার তাকালেন রাজা তার দিকে। নিস্পৃহ। তাপ নেই। সবাই হো হো করে হেসে উঠল। চিৎকার করে বলল কানা মেয়ের কথা। একা মেয়ে আরও একা হয়ে গেল। চারপাশ ফাঁকা। চারপাশ হিংস্র তখন। কাঁদে। আর ভাসে। কিন্তু সমস্ত ভাসার আগে তাকে স্বীকৃতি দিল অন্ধকার ঘর। লুকিয়ে থাকে। কেউ দেখতে পায়না। সমাজ তাকে মনেও রাখে না। ততদিনে তার হৃদয়ে "... প্রেম নেই, রতি নেই,  অনুভব নেই....... ক্ষতমুখে তুলো চেপে ধরে"। একদিন রাজা দেখেন সেই ক্ষতমুখে কালো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। হিংসার থাবা এনে বসিয়েছে মহা রহস্য। 

গিলগামেষ, বীর। নারী তো তাকে চাইবেই। ইসথার। প্রেম হিসেবে। পুরুষ হিসেবে। স্বীকৃতি চাইবে ভালোবাসার। কিন্তু স্বীকৃত পাওয়া তো সহজ নয়। রেগে ওঠে গিলগামেষ। উদ্ধত। অহংকারী। আত্মদম্ভী নারী, যে কি না সৌন্দর্যের স্বীকৃতি চায় গিলগামেষের কাছে! স্বীকৃতি মেলা না। তার বদলে অপমান করা হয় তাকে। সেও কম নয়। স্বীকৃতি অবহেলিত বলে মেতে ওঠে ধ্বংস কার্যে। ঠিক সেই বাঙালি মেয়েটির মতো। সাপের ফণায় যার লকলক করে ওঠে মৃত্যুর গন্ধ। প্রতিশোধের স্পৃহা।

স্বীকৃতি তবে কী? আত্মঘোষণা-- যাই কি না অপরের কাছ থেকে শুনতেই হবে? যা কি না "লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়" গোছের। আত্মতুষ্ঠি। সমাজের কাছে তুলে ধরা ব্যক্তি "আমি"কে!  "Our Pagan Times"  এর ওই লাইনগুলোর মতো! আইসিসের ঘোষণার মতো! আমি সব পারি-- তোমার দেখো এই তার কার্ড। ঠিক বার্থ সার্টিফিকেটের মতো। জন্মেছি এটাই সত্য। এই সময়,  এই স্থানে। এই যে বর্তমান এটা মিথ্যে? আবার শ্মশানে চলে যাওয়া শোক, চিতা সব মিথ্যে হয়ে যায়-- মৃত্যু প্রণাম পত্রের অভাবে! আশ্চর্য! কিন্তু আশ্চর্য নয়। সত্যি অথচ মিথ্যেও নয়। 

অথচ, একটা সময় আসে, রাজা তখন নিঃস্ব। শূন্য। চারপাশে অজস্র অন্ধকার। নিজে কাছে নিজেই হেরে যাওয়া। তিনি আর নতুন নন। চমক নেই। সমাজ তাকে ছুঁড়ে দিয়েছে। নির্বাসন দিয়েছে অন্ধকার। স্বর্গের ষাঁড়কে অপমানের জন্য একটা একটা অপমান উপহার পাচ্ছে গিলগামেষ। স্বীকৃতি নেই। ভালোবাসা নেই। সমাজ নেই। ঘিরে ধরেছে মৃত্যুভয়। কিন্তু আছে নিজের কাছে নিজের অস্তিত্ব। মৃত্যুর মধ্যেও শাশ্বত চিন্তা। নিজেকে খুঁজে পাওয়া-- আর এটাই বড় স্বীকৃতি। না-ফুরানো এক কবির কাছে-- এটাই বিরাট এক সত্য। নত হয়নি সে কালের কাছে। লোভের কাছে। অন্ধকার কে সে তুলে দেয় নি ফুলের সৌন্দর্য। বেলপাতার পবিত্রতা। কিন্তু এই অনমনীয় ভাব কী থাকবে শেষ পর্যন্ত? না। দেখা যাবে, রাজা লোভী। বিষের কাছে পেতে দেয় তার জন্ম, সত্য। আবার অপরপক্ষে দেখা যায়,  স্বীকৃতির জন্য পঙ্গু মেয়েটি একের পর এক দুঃসাহসিক কাজ করে। ধ্বংস ডেকে আনে। অর্থাৎ ছলে বলে কৌশলে তার অধিকার চাই-ই। আর তখনই ভেঙে পড়ে আসল স্বীকৃতি। ওটা  হয়ে ওঠে রাজনৈতিক কূটকৌশল! যা আজ একবিংশ শতাব্দীর মূল উদ্দেশ্য। 


এই স্বীকৃতি অনেকটাই মেটারমরফোসিসের মতো। নিজেকেই হারায়। আবার হয়ত পুনর্জন্ম। বিভিন্ন স্তর, শব্দ ভেঙে কিন্তু সেই নিজের কাছে ফেরা। একটি শিল্পের প্রতি কবি যতটুকু নত থাকেন, স্বীকৃতির কাছে কী! না বরং তাঁর আনন্দ; তাঁর জয় সবকিছুতেই কাজ-- তাঁর সৃষ্টি। তাই একটা সময়ে তিনি নিজেই ছুঁড়ে দেন স্বীকৃতির মানপত্র-- নৌকো হয়ে ভেসে যায় দূরে-- কালের স্রোতে। থাকে তাঁর জন্ম দেওয়া সৃষ্টি--- ওখানেই তিনি ঈশ্বর। আর তখনই তিনি কালের শব্দ পাঠ করে ওঠেন--- 

" held up by the tips of water's fingers 
At the tip of the fingers of the insensate hand 
Of the terrible hand 
Of the excrement eating hand 
Of the mortal hand 
Of his own reflection"

6 comments:

  1. অনেক স্তরে কথা বলে এই লেখা!

    ReplyDelete
    Replies
    1. পাঠক-ই তো প্রকৃত বিচারক

      Delete
  2. খুব ভালো লাগলো
    -মন্দিরা

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...