খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ - সন্দীপন চক্রবর্তী

ক্রোড়পত্র





স্বীকৃতি ও গোলকধাঁধা


সাহিত্যের ক্ষেত্রে কোনো লেখকের স্বীকৃতিই যদি বিবেচ্য বিষয় হয়, তাহলে প্রথমেই বলে রাখা উচিত যে, এ বিষয়ে অনেক ভেবেও আমি স্থির কোনো ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারিনি। তাই এ লেখায় বড়জোর কিছু প্রশ্ন উত্থাপন আর তার মাধ্যমে কিছু চিন্তার জট পাওয়া যেতে পারে। তার বেশি আর কিছুই নয়। 
প্রথমেই ভাবা দরকার যে, কাকে বলে স্বীকৃতি? কতটা দরকার আছে তার? স্বীকৃতি মানে কি পুরস্কার? খ্যাতি? মিডিয়া কভারেজ? প্রকাশকদের হত্যে দিয়ে বসে থাকা? অনেক অনেক বই আর প্রচুর বই বিক্রি? কিন্তু এর সবগুলি হওয়া সত্ত্বেও, তাহলে কোনো কোনো লেখক কেন পরবর্তীকালে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যান? আবার এর কোনোটাই না হওয়া সত্ত্বেও, কোনো কোনো লেখককে কেন পাঠক পরবর্তীকালে বিস্মৃতির অন্ধকার খুঁড়ে তুলে তুলে আনে আলোয়? তাহলে কি স্বীকৃতি মানে পাঠকের ভালবাসা, শ্রদ্ধা, সম্ভ্রম? তাছাড়া আরও কিছু প্রশ্ন ওঠে। 
প্রথমত, এখানে স্বীকৃতি বলতে কার স্বীকৃতি বিবেচ্য -- ব্যক্তির না প্রতিষ্ঠানের? অনেকসময়ে কোনো প্রতিষ্ঠান হয়তো তার সুবিধামতো কোনো লেখককে তুলে ধরার চেষ্টা করে। তার লেখা, সাক্ষাৎকার, তাকে নিয়ে লেখা – এসব ক্রমাগত মুদ্রিত করে, অন্যান্য মিডিয়ায় তুলে ধরে, সেই লেখকের স্বপক্ষে একধরণের জনরুচি গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এই যে ‘জনরুচি’ বললাম, তাহলে ব্যক্তিরুচি কি কোনো আলাদা কিছু? নাকি তার নিয়ন্তা সেই প্রতিষ্ঠানই? প্রতিষ্ঠান মানে কী – ইন্সটিটিউশন নাকি এস্টাব্লিশমেন্ট? এ দুই কি অনেকসময়ে একাঙ্গী হয়ে যায় না? তবু প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করেও কি কোনো পাঠক তার ব্যক্তিরুচি গড়ে তুলতে পারেন না? সেইরকম ব্যক্তির স্বীকৃতিও কি একজন লেখকের কাছে স্বীকৃতি হিসেবে বিবেচ্য নয়? ব্যক্তি হোক বা প্রতিষ্ঠান, স্বীকার করলে কী কী সুবিধা আর অসুবিধা? আর স্বীকার না করলেই বা কী কী সুবিধা আর অসুবিধা? 
দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিরুচির কথাই যদি ভাবি, তাহলে কাদের স্বীকার করা? সেক্ষেত্রে সংখ্যাগত মান বিবেচ্য? নাকি গুণগত মান বিবেচ্য? কোন পাঠক? শুধুই দীক্ষিত পাঠকের ছোট বৃত্ত? নাকি তার বাইরের সাধারণ পাঠক বা আম-জনতাকে এই হিসেবের মধ্যে বিবেচনা করবো? নাকি ধরতে হবে দুটোই? যেটাই বাছি না কেন, তার কারণগুলোও স্পষ্টভাবে বোঝার চেষ্টা করা উচিত। দীক্ষিত পাঠকের খুব ছোট বৃত্তে কারও লেখার সমাদর হওয়া মানেই যে সাধারণ পাঠক তাকে ‘ওর লেখা আর ক’জন পড়ে’ এই হেলার চোখে দেখবেন অথবা সাধারণ পাঠকের বড় বৃত্তে কারও লেখার সমাদর হওয়া মানেই যে দীক্ষিত পাঠক ধরে নেবেন যে ‘ও তো বাজারের জন্য লেখে, শিল্পের জন্য নয়’ – এই রোগ আমাদের সাংস্কৃতিক মণ্ডলে ভয়ংকর উৎকটভাবে দেখা গেলেও, তা অনেকসময়েই পাঠককে ভুল পথে চালিত করে।  
তৃতীয়ত, এই স্বীকারের স্থানগত গণ্ডি কতটুকু? অর্থাৎ একজন লেখক যে ভাষায় লিখছেন, শুধুই সেই ভাষাভাষী মানুষদের মধ্যে স্বীকৃতি? যেমন, বাংলা ভাষায় লেখালিখি করা এমন অনেক লেখক আছেন, যাঁদের লেখা আন্তর্জাতিক মানের হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের আন্তর্জাতিক স্তরে কোনো স্বীকৃতি তৈরি হয়নি। আবার, ইংরেজি ভাষার এমন অনেক লেখক আছেন, যাঁদের লেখা অনেক বাঙালি লেখকের থেকে নিম্নমানের হলেও শুধুমাত্র ভাষাগত কারণে তাঁর একধরণের আন্তর্জাতিক পরিচিতি আছে। বা, এই একই সমস্যার গণ্ডিটা যদি আরেকটু ছোট করে আনি আমাদের দেশের মধ্যে, তাহলে এই একই সমস্যা দেখবো হিন্দি বা উর্দু ভাষার লেখকদের সঙ্গে অন্যান্য ভারতীয় ভাষার লেখকদের। কিন্তু অনুবাদের মাধ্যমে অন্য ভাষার মানুষদের মধ্যেও ছড়াতে পারে নাকি তাঁর স্বীকৃতি? রবীন্দ্রনাথের উদাহরণ ভাবি যদি?      
চতুর্থত, সেই স্বীকারের কালগত গণ্ডি কতটুকু? অর্থাৎ, সেই স্বীকার কি শুধু সমসময়ের নিরিখে বা সেই লেখকের জীবৎকালে? নাকি আরো অনেক বড় সময়ের গণ্ডিতে? আর এই সময়ের গণ্ডিকে যদি আমরা অতি ক্ষুদ্রতে সংকুচিত করে আনি বা অতি বৃহতে সম্প্রসারিত করি, তাহলে কি এই স্বীকৃতির প্রসঙ্গটাই মূল্যহীন হয়ে পড়ে না? কোনো লেখকই কি চান যে তাঁর লেখা খবরের কাগজের মতো প্রত্যহেই ফুরিয়ে গিয়ে বর্জ্য হয়ে যাক? আবার কোনো লেখক যদি ‘মানুষ’ প্রজাতির উদ্ভব থেকে বিনাশ – এই বিশাল কালখণ্ডের মধ্যে রেখে নিজের লেখার স্বীকৃতি খুঁজতে চেষ্টা করেন, তাহলে তাঁর নিজের কাছেই সেটা একটা বিরাট ঠাট্টা মনে হবে। তাহলে এই স্বীকার কোন সময়গণ্ডির মধ্যে এবং সেই সময়গণ্ডি কিসের নিরিখে স্থির করা হবে? 
পঞ্চমত, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্ন যে, একজন লেখক কি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য লেখেন? একজন লেখক তাঁর অন্তরের অন্তঃস্থলে সত্যিই কতটা পরোয়া করেন স্বীকৃতির? তিনি কি নিজের অন্তরের তাগিদে নিজের জন্যই মূলত লেখেন না? এবার প্রশ্ন উঠতে পারে যে, তাহলে ছাপাতে দেন কী জন্য? লিখে নিজের কাছে ফেলে রাখলেই তো হয়! সেটা তো করেন না! তাহলে স্বীকৃতি কার কাছে মূল বিবেচ্য বিষয় -- লেখকের না পাঠকের? নাকি এ দুইয়েরই বাইরে থাকা আম-জনতার? লেখকের মনের গহনে কি সত্যিই কোনো স্বীকৃতির আকাঙ্ক্ষা থাকে না? কারও মতে, কোনো লেখক স্বীকৃতি পেলে সেটা তাঁর কাছে একটা দায়িত্বের বোঝা হয়ে দাঁড়ায় সেই স্বীকৃতিকে ধরে রাখার জন্য। আবার কারও মতে, কোনো লেখক স্বীকৃতি পেলে তাঁর ভিতরের সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষাটা কমে আসে এবং নিজের সম্পর্কে নিজের একটা মূর্খ ধারণা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আবার কারও মতে, কোনো লেখক স্বীকৃতি পেলে তা তাঁকে শান্ত সুস্থির হতে আর নিজের কাজের প্রতি মনযোগী হতে শেখায়, স্বীকৃতিলাভের জন্য কোনো ছট্‌ফটানি আর তখন তাকে কাজ থেকে বিক্ষিপ্ত করে অন্যদিকে চালিত করতে পারে না।   
ষষ্ঠত, স্বীকার না করা মানেই কি অস্বীকার করা? নাকি এ দুয়ের মাঝে এক তৃতীয় পরিসর আছে? আর স্বীকৃতির কি কোনো শেষ আছে? তারও কি অজস্র ধাপ নেই? তার কোন পর্যন্ত যেতে চান একজন লেখক? আর কাউকে সরাসরি অস্বীকার করাও কি একভাবে তার স্বীকৃতিকে স্বীকার করা নয়? অস্বীকার মানে তো এই – ‘আমি জানি তোমার একধরণের স্বীকৃতি আছে, কিন্তু তোমার পথকে আমি আমার পথ করবো না। আমার পথ আমি নিজেই তৈরি করে নেবো নিজের মতো করে’। ফলে অস্বীকারের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে যাকে অস্বীকার করা হয়, তার স্বীকৃতি সম্পর্কে একধরণের সচেতনতা। আবার অস্বীকার করে এই যে নিজের মতো চলা, সেটাও কি আরেকধরণের স্বীকৃতির দিকেই নয়?     
আসলে, প্রত্যেক লেখক যদি নিজের কাছে এই প্রশ্নগুলি করেন এবং নিজেই সৎভাবে নিজের কাছে এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন, তাহলে প্রত্যেক লেখকের উত্তর আলাদা আলাদা হবে। হয়তো অনেক উত্তর খুঁজেও পাবেন না তিনি। কিন্তু এই খোঁজ জারি থাকবেই। তাহলে কি বলা যায় যে, ‘স্বীকৃতি’ শেষ পর্যন্ত একটি চূড়ান্ত ব্যক্তি-সাপেক্ষ ধারণা? তার কি আদৌ কোনো নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ সম্ভব?









No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...