খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ- শুভ্র বন্দ্যোপাধ্যায়





যেখানে সমসাময়িক কবিতা নগরভোগ্য,  সেখানে স্বীকৃতির মূল্য কি?

প্রিয় হিন্দোল,

            তোকে চিঠি লিখতে বসা মানেই হুড়মুড় করে তত্ত্বকথা ঢুকে পড়তে চায় স্মৃতির মোড়কে। তুই লিখতে বলেছিস স্বীকৃতি বা অস্বীকৃতি নিয়ে। কবির স্বীকৃতি স্মরণে এ কথা যদি উপপাদ্যের মত মেনে নিই তাহলে এখানেই চিঠি শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আমরা এমন এক সময়ে কবিতার জগতে সে সময় স্বীকৃতি দাবী করে হয়তবা প্রাচীন শতাব্দিদেরই মত। কিন্তু এসময় স্বীকৃতির চাহিদা অনেক বেশি উদগ্র, অনেক বেশি নির্লজ্জ। আর উল্টোদিকে পুরস্কারের ছাপ্পা না লাগা কবিরাও ততটা অস্বীকৃত নন। আর এখান থেকেই প্রশ্ন ওঠে স্বীকৃতি কী?

আমি ফিরে যাব আমাদের সকলেরই প্রিয় লেখক মিগেল দে সেরবান্তেসের কথায়। জীবনে ৬৩ বছর বয়স অব্দি কবিতা লিখে কলকে না পেয়ে শেষ অব্দি লিখে ফেলেছিলেন দোন কিখোতে, যা কিনা দুনিয়ার প্রথম গদ্যে লেখা উপন্যাস। এবং সে উপন্যাসও প্রথমে কবিতায় লেখা। পরে তাতেও কোনও সাড়া না পেয়ে তিনি লেখেন গদ্যে। যদিও তেমন কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না যে তিনি স্বীকৃতির জন্যই গদ্যে মন দেন, কিন্তু ধারণা করা যায় যে সতীর্থ কবিদের টিটকিরি তাঁকে অমন ঘাতক স্যাটায়ার লেখায়। ভুলে গেলে চলবে না সেরবান্তেসের কালকে বলা হয় স্পেনীয় ভাষার সুবর্ণ শতক। ওই সময়ের কবি ফ্রান্সিস্কো কেবেদো বা লুইস দে গোনগোরা আজও প্রাসঙ্গিক। এতটাই প্রাসঙ্গিক যে গোনগোরার মৃত্যুর ৩০০ বছর উপলক্ষ্যে গার্সিয়া লোরকারা জন্ম দেন ২৭-এর প্রজন্ম আন্দোলন। কেবেদোই সেই কবি যাঁকে নেরুদা তাঁর কাব্যের পিতা বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। অমন এক সময়ে জন্মে কবিতা লেখা কঠিন ছিল বইকি!

কিন্তু আমাদের সময়, হিন্দোল আমাদের সময় বড় অন্যরকম। এত কবিদের সমাহার কখনই দেখা যায় নি ইতিহাসে। কবিরা চিরকালই সংখ্যায় বেশি কিন্তু আমাদের সময়ে কবিতার সমস্ত পাঠকই কবিতা লেখেন (হয়ত আগেও লিখতেন) এবং তাঁরা তা ছাপাতে পারেন। ইন্টারনেট বিপ্লবের পর জনৈক সম্পাদকের ইশারার উপর আর নির্ভর করে না কবি ভাগ্য। কিন্তু গোলমাল বাঁধে যখন দেখা যায় ছাপার অক্ষরে স্বীকৃতি নয় পুরস্কারের স্বীকৃতির জন্য কবি ব্যাকুল। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ভাগ্যিস আমি কলকাতাচ্যুত। আমাকে স্বীকৃতির অসামান্য দৌড় প্রতিদিন সামনে থেকে দেখতে হয় না। কারণ আমার মাতৃভাষাভূগোলের বাইরে থাকা আমাকে শিখিয়েছে নিজের ভাষায় লিখতে পারাই বিরাট পাওয়া।

তা যা বলছিলাম আমাদের সময়! এই সময়ের ছটফটে ভাব, অপশানের বাড়াবাড়ি,  আমাদের এক অনন্ত করিডরে এনে ফেলেছে। আমাদের মধ্যে বেড়েছে সামাজিক স্বীকৃতির লোভ। আর সে স্বীকৃতি থেকে পাওয়া ক্ষমতার লোভ। সেই যে নিৎশে লিখেছিলেন মানুষের একমাত্র লোভ ক্ষমতা। সে কোথাও না কোথাও ক্ষমতাবান হতে চায়। হয়ত সেই লোভেরই প্রকাশ আমাদের স্বীকৃতি চাওয়া। যত জনসংখ্যা বাড়বে বাড়বে আমাদের ক্ষমতা চাওয়া। একক হতে চাওয়া। কারণ সংখ্যাধিক্যের সঙ্গে ধৈর্য ব্যাস্তানুপাতিক। এর সঙ্গে জুড়ে যায় আমাদের সামাজিক জীবনে ব্যর্থতা। সাধারণত দেখা যায় অন্য দিকে ব্যর্থ হওয়া মানুষেরা কবিতার সঙ্গে বেশি জড়িয়ে থাকেন, আর সেখানেই আসে এই স্বীকৃতি চাওয়ার দায় ও দাবী। এতে দোষের কিছু নেই কিন্তু গোলমাল হয় তখনই যখন দেখা যায় কবি কবিতার বা অন্ততঃ তাঁর নিজের লেখার বিবর্তনে মন না দিয়ে ছোটেন স্বীকৃতির পিছনে। যা হোক করে সারাবছরে লেখা কবিতা জড়ো করে পরিকল্পনাহীন এক কাব্যগ্রন্থের জন্ম দেওয়া এবং তাকে একটা পুরস্কার, তা সে যেমনই হোক, পাওয়ানোর দিকে ছুটে যাওয়া বা টিভিতে মুখ দেখানো, সবই থেকে যায়। 

আমার ব্যক্তিগতভাবে সবসময় মনে হয়েছে সামাজিকভাবে কবি হতে চাওয়া একধরণের গোলমেলে বিষয়। বিশেষত শুধু স্বভাবকবিতার চর্চা করে যাওয়া। ২০ বছর বয়সে যে আবেগ সেই একই আবেগ থেকে পরপর বই লিখে যাওয়াকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি। শুধু বয়ঃসন্ধির প্রেমের কবিতা বা কলেজ কলিজায় আলোড়ন তোলা বাক্স বাজানো কবিতাকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি। কারণ আমার সবসময় মনে হয়েছে কবিতার একটা প্রধান কাজ হল ভাষার নানা সম্ভাবনাকে উশকে দেয়া। তাকে নতুন করে দেখার চেষ্টা করা। যেটা আমাদের স্বীকৃতিপ্লাবিত বাংলা কবিতায় বিরল। আমরা বাঙালিরা বোধহয় কোনওদিনই কবিতা লেখাকে গভীর শিল্পমাধ্যম হিসেবে নিইনি। আমাদের কাছে কবিতা শুধুই এক আবেগ বর্ষণের জায়গা। আর এই আবেগ বর্ষণের সঙ্গে স্বীকৃতির যে বিপুল যোগ তা অন্য কোনও কবিতার নেই। একটু রিস্ক নিয়ে লেখা কবিতাকে বাংলা কবিতার মেইনস্ট্রিম তাছিল্যে ফেলে দেয়। আড়ালে হাসে। আবার সেই কবিই বাইচান্স একটা পুরস্কার পেয়ে গেলেই তিনি কত মহৎ কবি তা নিয়ে সহর্ষ সন্দর্ভ লেখা হয়।

কিন্তু আমাদের সমসময়ে একটা অন্য চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয়েছে। ওই যে আগে বলছিলাম ইন্টারনেট বিপ্লবের পর প্রকাশের মাধ্যম বেড়ে গেছে তার ফলে স্বীকৃতির দাবীও বেড়ে গেছে। এবং অদ্ভুতভাবে মানুষের হাতে খরচ করার মত বেশ কিছু পয়সাও আছে। তার ফলে তৈরি হয়ে যাচ্ছে নানা রকমের পুরস্কার। কিন্তু কলকাতা শহরে বসে লেখার একটা ব্যাপার আছে। সেখানে সরকারি পুরস্কার পাওয়ার রাস্তাটাও অনেকটা কাছের। ফলে মানুষের ফন্দিফিকির ভেবে নেওয়া সহজ হয়।

কিন্তু এই সব কথাই জানা। সবই নিৎশের ক্ষমতা-তত্ত্বে ব্যাখ্যা করে দেওয়া যায়। কিন্তু একটা জিনিস এই সময়েই প্রকট হচ্ছে। আমার দ্বিতীয় ভাষা স্প্যানিশ জগতেও দেখি অজস্র পুরস্কার। কিন্তু অতিরিক্ত পুরস্কারের ফলে পুরস্কারের গুরুত্ব হারিয়ে যাচ্ছে। আগে যে একটা ধারণা ছিল পুরস্কার পেলে বইয়ের বিক্রি বাড়ে সেটা আর এখন ওখানে চলছে না, সংশিষ্ট দেশের জাতীয় পুরস্কার ও  সে ভাষার সর্বোচ্চ তিনটি পুরস্কার বাদে। এটা কবিতায়, যদিও সে পুরস্কারের একটি গদ্যকারদেরও দেওয়া হয়। উপন্যাসের জন্য ইস্পানো দুনিয়ায় দুটো বেসরকারি পুরস্কার আছে। আমাদের তুলনা করলে বলতে হবে দুটো আনন্দ পুরস্কার! অর্থমূল্য প্রায় দু লক্ষ ইউরো। এই পুরস্কার দুটি একজন ঔপন্যাসিককে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করে। এবং ধনী হতেও। কিন্তু কবিতায় এমনটা  হয় না। বেশ কিছু পুরস্কার আছে নামমাত্র অর্থমূল্যের। তাদের কাজ শুধু বইয়ের ওপরে স্টিকার মারা! যেহেতু কবিতা পড়েন শুধু কবিতা লেখকরা, বা ঘুরিয়ে বললে সমস্ত কবিতা পাঠকই কবিতা লেখেন সেখানে অন্য কিছু পুরস্কার গুরুত্ব রাখে।

এবার আমাদের কথায় ফিরি, আনন্দ পুরস্কার ছাড়া কোন পুরস্কারের গুরুত্ব আছে বই বিক্রির জগতে? কারণ অন্য পুরস্কারের খবর কোনও কাগজে বেরোয় না বা নামমাত্র থাকে। কিন্তু এ সব কিছু জানার পরেও পুরস্কারের লোভ আমাদের যায় না। কেন? আমরা কি একজন মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতি মিত্র বা উৎপলকুমার বসুকে দেখিনি? না হয় স্বদেশ সেন কে বেশির ভাগ বাঙালি কবি চিনতেন না কিছুদিন আগে অব্দি, কিন্তু তিনিও তো বাংলা কবিতায় ছিলেন। এখানে সেই বহুশ্রুত কথাগুলো ফিরে আসবে। কবিরা তো আর সন্ন্যাসী নন! এখানে আমার শূন্য দশকের কবিদের বেশ অন্যরকম মনে হয় কারণ দু চারজন বাদে কেউই “বাজারী স্বীকৃতি” নিয়ে ভাবেননি অতটা। ৯০ দশকে যতটা উতলা ছিল লোকে শূন্যে এসে  বোধহয় সেই ছটফটানি কমে।

কিন্তু এই সবকিছুর পরেও আমার একটা প্রশ্ন যায় না, যে ভাষা শহরাঞ্চলে প্রতিদিন একটু করে মরে যাচ্ছে, আর যেখানে সমসাময়িক কবিতা নগরভোগ্য,  সেখানে স্বীকৃতির মূল্য কী?

শুভেচ্ছা রইল

পুরনো আড্ডার কসম

শুভ্র


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...