খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

8.7.18

গুচ্ছ কবিতা উৎপল চক্রবর্তী






এপিফ্যানি


১.
ট্রেন

একেকটা ট্রেন দেখি  আসে আর রাজধানি হয়ে যায়।
কোনওটা আবার সামান্য সময় থেমেই ছুটে চলে যায়। 
কখনও এক ঝটকায় অনেকে এসে থামে। থেমে থাকে মেল ট্রেনের মতো । গোটা একটা প্ল্যাটফর্ম কিনে নেয়। রঙ্গমঞ্চ বানিয়ে তারা রীতিমতো খেলা করে, নাচে, গোলাপি শুভেচ্ছা নেয় এবং দ্রুত লেভেলক্রসিং করে। তারপর স্কাইওয়াক করতে করতে দেখে কিছু ট্রেন ধরে ঝুলে থাকা একদল যুবক লোফারের মতো ঘন ঘন বিড়ি টানে। আর ৩ টাকায় শ্রীলক্ষী বাম্পার কিনে গুলতি হয়ে যায়।

২.
আর্তি

ফটকটা খুললেই এক চওড়া রক। বসে কথা বলা যাবে  খুলে। তাই খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম কোনও একটা গাড়ি। অন্তত এক টুকরো  আকাশ বা কোনও উত্তাল সমুদ্র। কিন্তু কী আশ্চর্য একটা পায়রাও  উড়তে দেখলাম না। এদিকে তখন জোর হাওয়া দিচ্ছে তলবের। সব জানালাগুলো খুলছে বন্ধ হচ্ছে। ফটকে দড়াম দড়াম ডাকছে খিল। কাঁটা হয়ে আসছি থেকে থেকে। ঘুরছি এ পথ সে পথ। মসজিদ গলি থেকে আনন্দবাজার আসতে আসতে কি আলোকবর্ষ পেরিয়ে যাবে? কেউ শুনতে পাচ্ছ তোমরা? আমাকে অন্তত একটা কাঠের টুকরো দিয়ে যাবে কেউ, ও দখিন বাতাস? ও নীল নদের তুমুল?
৩.
 ঝড় আসুক

যখন ঝড় উঠেছে দেখছো জানালা বন্ধ কোরো না।
ওকে আস্তে দাও ঘরের ভিতর।
আসন পেতে দাও। জড়িয়ে ধরো বুকে।
লাগুক না একটু ধুলোবালি, নিড়-ভাঙা খড়কুটো।
ঝরে যাওয়া শুকনো পাতা থেকে সদ্যফোটা মুকুলের ভেজা ভেজা আগুনযোগ
এসে পড়ুক বিছানার ওপর। একটু জল দাও ওকে।
দেখবে তোমার বাগানে, ঠিক ফুটে উঠছে প্রতিগল্প, সমস্ত প্রতিপৃথিবী।
৪.
বাতি

মাঝে মাঝে দ্বীপের মতোই জল ফুড়ে  জেগে ওঠো।
আমি ফুল হয়ে উড়ে যাই পাখিদের পিছু পিছু।
কত কিছু এসে ভারী  করে। শিকড়েরা মাথা তোলে।
শ্বাস নেয়। লাল লাল পিঁপড়েরা কত কথা বলে।
বাতিঘরে আলো ফোটে । জাহাজেরা নোঙর ফলায়।


৫.
 সাদা পাতা

লেখার টেবিল গুছিয়ে নিয়েছি অনেকক্ষণ। নতুন ফ্ল্যাটের চকচকে মেঝের দিকে তাকিয়ে বুক ফুলিয়ে বসেছি। মহানন্দে ল্যাপির দেওয়ালে নতুন ওয়ার্ড ডক লোড করেছি। স্পিচ টু টেক্সট অন করে বসেছি নতুন সফটওয়্যারে। A 4 পেজ রেডি। এবার চরচর করে বেরোবে কিলবিলিয়ে পোকার মতো ঝাঁকে ঝাঁকে সব গল্পগরু। আর অসমর্থ যুবকের উন্মত্ত যৌনতার বিচ্ছূরণ। কিন্তু কই? লেখা তো এল না। ঘড়ির চাকা বুলেট ট্রেন হয়ে স্পর্শ করেছে সুমেরু। দুহাতে মুখ ঢাকতেই ঘাম এল দরদর করে। ব্ল্যাংক পেজ জমা দিতে ইনভিজিলেটর বললেন 'সাবাস! এত কম সময়ে তুমি এত কিছু লিখে ফেলেছো? বেশ। বেশ। বুঝেছি তুমি কোনও সাইকেল মেরামতকারী  অথবা কোনও সোনার দোকানের কারিগর হবে। গ্ল্যাড টু সি ইয়ু সান।' টেনিসনের 'ইন মেমোরিয়াম'এর ছবিটা লুকিয়ে নিয়ে আমি দ্রুত হল থেকে বেরিয়ে এলাম কিছু না বলে।
৬.
 বীজধান

অমলতাস, হাসনুহানা, ভালোই কাটছিল।
একশৃঙ্গ গন্ডার থেকে পেরিয়ার। টেবিলের এক কোনে উঠে থাকা এক আলপিন হঠাৎ হেসে উঠল। ওই পথেই হেঁটেছি বার বার। কিন্তু  এতদিন বাদে যেন তার ধর্ম রক্ষা পেলো। আমারও কালঘুম থেকে  ঝর ঝর করে বীজধান পড়ে গেল।
৭.
ফড়িং

যাকে ধরতে  চেয়েছি এতদিন জোর করে, যাকে হাতে নেব বলে এত খুঁজেছি মরুভূমি, পাহাড়, সমুদ্র নদীর জঙ্গল, সে যে এক ফড়িং তা বুঝতে পারিনি আগে। এতদিন সে শুয়ে ছিল নাকের ডগায় চশমার কাচের ঘাসে। একটু নড়তেই সে উড়ে গেল
বর্ষার ছৌনাচে। এইমাত্র সে স্থির হল চোখের পাথরে। এর পরের লাফটার জন্য আমি তৈরি হচ্ছি ঘন জাল নিয়ে।
৮.
কেমিস্ট্রি

প্রশস্ত রাস্তার কাছে যতবারই গেছি একগাল হাসি নিয়ে সে পাশবালিশে ঠেস দিয়ে বসন্ত  ছড়িয়েছে তার বিছানার চাদরে। তিন চামচ মৌরি মুখে নিয়ে তোতলামি করে কী সব কেমেস্ট্রি বুঝিয়েছে। আমিও হাঁ হয়ে তার সব কিছু শোনার পর এই ভর দুপুরে বেরিয়েছি কিছু খুচরোর সন্ধানে ।
৯.
থ্যাংকস ড্যানিয়েল
এক নির্জন দুপুরে খোলা আকাশের নিচে
বসে আমরা লুকো চুরি খেলি। ডুব দিই তরঙ্গ গভীরে। কোনও এক ঘাসফড়িং
তুলে আনে জল থেকে তোমাকে আমাকে।
বেশ কিছু পরে দেখা হয় আমার সাথে আমার তোমার সাথে তোমার।
আরও পরে মিলে যায় কোনও আমি কোনও সে তুমির সাথে হঠাৎ। ছেদ বিন্দু জুড়ে গড়ে ওঠে অসংখ্য
শহর, মরূদ্যান, কুমায়ুন থেকে হিমাচল। 'থ্যাংকস টু উনিশ নং কোর্টের ড্যানিয়েল'

১০.
দেখি নাই ফিরে
আগুন পাখির মতো
বসে থাকে নগ্ন চাঁদ। তুমিও জলরঙে তার সন্ধ্যা মুদ্রা আঁকো। ভ্রূ মধ্যে ধরে রাখো দিগম্বর। পাথরের মূর্তি থেকে ভগবান নেমে এসে ধুইয়ে দেন তোমার মুখ হাত। নিজের ঝোলা থেকে আধখাওয়া রুটি নিয়ে নিজেও খান আর তোমাকেও খাইয়ে প্রণাম করেন। 'দেখি নাই ফিরে' লিখে তিনি স্বর্গে চলে যান।
১১.
আঘাত

যে চেয়ারে যে টেবিলে বসে লিখি, যে বিছানায় শয্যার কথা ভাবি তারা হঠাৎ টলে ওঠে। টলে ওঠে জমির দলিল, শক্ত ভিতের কোয়েক প্রূফ বহুতল।আমি দৌড় লাগাই। আস্তে আস্তে অট্টালিকা, শহরের ল্যাম্পপোস্ট  নিয়ন আলো  ভেঙে পড়ে নিশ্চিহ্ন হতে থাকে। রাস্তার মুখগুলো ম্যানহোল হয়ে উঠে আসে। সব উড়ানগুলো ক্রাশ করে একে একে। মাঠ গুলো ভেঙে যেতে থাকে। আমি দৌড়াই। আমি দৌড়াই  কোস্টাল লাইন বরাবর। এতক্ষনে সব জঙ্গল সাফ হয়ে যায়। সমুদ্র  দখল নেয় পৃথিবীর। আমি দৌড়াতে থাকি। সব পুড়ে যেতে থাকে।
সাদা বামন থেকে কালো গর্তরা নক্ষত্রদের খেয়ে নিতে নিতে নিজেরাই ছোট হয়ে যায়। ক্রমে পৃথিবীর  মিথ ছোট হয়ে একটি পরমানুতে গিয়ে ঠেকে। আমিও উধাও হয়ে যাই। কপালের মাঝখানে আর একটি আঘাতের অপেক্ষায় থাকি।
১২.
বেড়াল

আমার আদরের বেড়ালটি যখন তোমার কাছে চুপ্টি করে বসে, তোমার মাদুরে মাথা রাখে তখন কী যেন এক পেলব স্পর্শে আমার কলম থেকে সোনা ঝরে পড়ে। তুমি টেরও পাওনা কারন তুমি তখন নেই তোমার ভিতরে। আমার ব্রক্ষ্মতালুতে তুমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছ বারবার। নিস্তব্ধতা ঝরে পড়ছে তোমার ঠোঁট চোখ থেকে। আমি একে একে লিখে চলেছি তোমার ধৈবত, শুদ্ধ সারং। এলডেরোডো থেকে বারমুডা ঘুরে দেখছি। আর তুমি আমার বুকে হেলান দিয়ে আছো। তোমার আজানু লম্বিত কেশ আলোচিত হচ্ছে বিধানসভায়। সবার শোকের মধ্য দিয়ে তুমি হেটে যাচ্ছ পরিচিতির গভীর নিষাদ থেকে নীচে। বাঁশপাতার শেষ গ্রন্থটাও চলে গেল। আর কয়েকটা মিনিট বাকী। প্রদীপ দপ করে জ্বলে উঠল বলে।
\
১৩.
খেলোয়াড়
সে ই খেলোয়াড় যে অন্যের পায়ে বল ছুঁড়ে দিতে পারে।
আমি এই ফুটবল খেলা ভালবাসি না। ভালবাসি না একটি মাত্র বল নিয়ে কাড়াকাড়ি।  ভালবাসি না রেফারির চোখরাঙানি। ছোট্ট  মাঠ। হালকা বাজনার আসর। আমি অসংখ্য ফুটবল নিয়ে খেলি।  সেখানে রেফারি আমি, আমিই ফুটবল, আমি খেলোয়াড়। ঈশ্বররাও খেলে তাদের মতো করে।  অনেক ফুটবল জড়ো হলে সেগুলো গড়িয়ে দিই তাদের স্পাইকবিহীন পায়ে।




১৪.
গান্ধার

বহুদিন বহুভাবে খুঁজেছি গান্ধার। ল্যাবাইরিন্থে ঢুকেছি খুব সহজেই   জ্বলন্ত লাভা থেকে সুইট হোম,সুনামি থেকে শপিংমল। সামনে পেছনে দেয়াল। বালির পাহাড়। হঠাৎ সকালে আজ বাসন পড়ার শব্দে
এই প্রথম অস্বস্তি হলো।
১৫.

 নিজস্বী

স্পটলাইটের আলোয় চোখ ছোট হয়ে আসে। তখন আরও অনেক কিছু আমি দেখতে পাই।
হলুদ ইশারা শূনোচ্ছিষ্ট কাকমাংস মনে হয়। ভেসে আসে ফাটা পা, অস্পষ্ট সিঁড়ি, আলোকিত রথ।                     ভূমা কোথা থেকে এসে আমার মুখে খই ফোটায়। সবাইকে দেখায় বিশ্বরূপ।আমাকে দেখায়। দেখাতে সাহায্য করে ঘন ঘন ফ্ল্যাশ আমার গ্রন্থি, আমার প্রতিটি রোমকূপের খনি, আমার গুলতি, আমার রাবারস্ট্র‍্যাপে আঁটা নাল।
অয়দিপাউস কি ওরাক্যাল শুনেছিল?

১৬.
বেঁচে থাক লংকা

চারদিকে ছড়ান  যত ভাস্কর্য যত পেইন্টিং ভেসে আসে  ক্লাউডের খামে তার চেয়েও অনেক  দ্রুত নেমে আসা ছবি ফুটে ওঠে  ফুটপাতে, চালা, বস্তির শহরে।  আগুনগায়ে ওরা যত ঘেমে ওঠে তত চোখে নামে নরম রোদের স্নান।  ফুটে উঠে উড়ে চলে রঁদা পিকাসোর রথ। ওদের চিত্র গোগ্রাসে গিলে, জুতোর ফিতের মূল্যে যারা কিনে নেয় তারা কোনও চিত্রকর, কবি, পাপারাৎজি, বা কোনও উচ্চাকাক্ষী লেখক। বেঁচে থাক লংকা, পান্তা,জল। বিনিময় করি চলো চাবি, নিজেদের  ধারণা, কুশল।


No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...