খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ- পম্পা দেব



নতুন সূর্যের অপেক্ষায়


শোন সব্বাই খনার কাহিনী এবারে
মধ্যযুগের বঙ্গভূমিতে
এক ছিল মেয়ে, তার নাম খনা
প্রথম মহিলা কবি বাংলার
তার জিব কেটে নিলো পাঁচজনা
জিব কেটে নেওয়া খনার বচন
সাগরে পাহাড়ে আকাশে ছড়িয়ে পড়ল।
খনা নামের সেই মেয়েটিই শুধু
রক্তক্ষরণে মরলো।
(মল্লিকা সেনগুপ্ত, খনার গান)
খনাকে তার সত্যবাদিতার মূল্য চোকাতে হয়েছিল । প্রাণের বিনিময়ে । সে জানতো  শস্য ফলনের ব্যাকরণ, মেঘ বৃষ্টির আসা যাওয়ার গতিপথ এঁকে দিতে পারতো , কৃষির কারুকাজ জানতো সে। জানতো নক্ষত্র তিথী, আকাশের বিষাদ ও উল্লাস ।
মাটির সাথে,
  জলের সাথে, মেঘের সাথে তার দেখা হতো কথা হতো। আর এই রহস্যঘন মন ও মেধার জাতিশত্রু হয়ে উঠেছিল তার আপন শ্বশুরালয়। তার জীবন সঙ্গী । বিক্রমাদিত্যের রাজসভার দশমরত্ন খনাকে হত্যা করা  হয়েছিল মধ্যযুগীয় বর্বরতায়। 
ইতিহাস ডুকরে উঠেছিল
  সেদিন   সত্যকে অস্বীকার করার হত্যাকারী এই অধ্যায়ে। কিন্তু যুগে যুগে লোকজ ইতিহাস হয়ে রইলেন বিদুষী, নির্ভীক, সত্যানুসন্ধানী এই রহস্য সুন্দর নারী। সাধারণ মানুষের মনে। 
সময়ের স্রোতধারা ক্রমে ক্রমে পার হয় সভ্যতার
 
কর্কটরেখা। আদৌ কি আমাদের রক্তে,
  সভ্যতার যৌথ খামারে আবছা হয়েছে বিষ। হিংসার উন্মাদনা , 
হত্যাকারীর চরিত্র কি বদলাতে পারে?
 
সময় এগোয় আর গুগল, ইন্টারনেটে চলে গভীর ষড়যন্ত্রের ছক। মৌলবাদী হানা তছনছ করে দিচ্ছে
 
গ্রাম,
  ও নগরজীবনের আপাত স্হিতি। আপাত কারণ মুখোশের নীচে চোখ দুটো কখন জ্বলে উঠবে আগুনে,  ধ্বংসলীলায় , আর ছিন্নভিন্ন করে দেবে প্রকৃত উন্নয়নকামী মানুষের শরীর । অতঃপর? 
পরিসংখ্যান অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন কত নারী ও শিশু নির্যাতন চলে। কত আনাচে কানাচে সংগঠিত হয় অপরাধ চক্র। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো ক্রমশ ফণা তুলছে ছড়াচ্ছে বিষ। এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যেখানে মৌলবাদী সংগঠনগুলির প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি নিমেষে স্তব্ধ করে দিতে পারে মানবাধিকার । কোনটা মুখ আর কোনটাই বা মুখোশ, আমরা আলাদা করতে পারিনা। গণতন্ত্রের গায়ে লাগে
 
চিহ্নিতকরণের নির্লজ্জ ছাপ। আপনি কি অহিন্দু সূচক?
 
কোনটা শিক্ষা আর কোনটা নয় আপনি
  কি তার দিকে আঙুল তুলেছেন? অথবা লিঙ্গগত ভাবে প্রান্তিক ? আর সেই প্রান্তিকতার স্বীকৃতিতে আনন্দ উৎসবে মেতেছেন? কিন্তু এই উপমহাদেশে, এই এশিয়া ভূখণ্ডে সেই অধিকার আদৌকি আছে আপনার?  কেউ ভাবছেন তিনি প্রগতিশীল, অধ্যাপক, প্রকাশক, সাংবাদিক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, অভিনেতা । নাগরিক অধিকার সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে সুদীর্ঘ বক্তৃতা দিতে দিতে তিনি ক্লান্ত, ক্লিষ্ট হয়ে পড়বেন।  'মাষ্টারমশাই  আপনি কিছুই দেখেননি '........কী জানেন, কী দেখেছেন হ্যাঁ। ধর্ষণ, নির্যাতন, মার্ডার, তোলাবাজি, দাদাগিরি। কিচ্ছু দেখেননি। আপনার মস্তিষ্ক বিভ্রাট । বাড়িতে বউ, বাচ্চা, বাপ মা আছে তো। কনিষ্ঠ ভ্রাতা , অনূঢ়া সহোদরা, পিতা মাতা সম্বলিত সংসার । কখন কি হবে কিচ্ছু বুঝতে পারবেননা। আপনার চোখের সামনে এক এক করে ঝরে পড়বে মান সম্মান, প্রতিবাদের মূল্য,  বয়ে বেড়াতে হবে সারাজীবন ব্যপী।
গত চোদ্দই জুন শ্রীনগরে নিজের বাসভবনের সামনে হত্যা করা হয় ' রাইজিং কাশ্মীর ' এর সম্পাদক সুজাত বুখারিকে।
  তিনজন আততায়ী তাঁকে হত্যা করে ধৃত । তামাম ভারতবর্ষ জুড়ে উত্তাল হয়ে ওঠে মিডিয়া থেকে জনজীবন । নড়েচড়ে বসে রাজনীতির কারবারিরা। এবং গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তকারী অফিসারেরা । আসলে সুজাত বুখারীর মতো দুঁদে সাংবাদিককে হত্যা করা মানে তাবৎ সাংবাদিকতার দায়িত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো। সিস্টেমকে হাস্যাস্পদ করে তোলা। গণমাধ্যমকে বেআব্রু করা। ভারত -পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে এই সুজাত বুখারির শীর্ষ স্থানীয় উপস্থিতি টের পাওয়া যেত। জঙ্গি সংগঠনগুলির সামনে উন্নত শির সুজাত বারবার চ্যালেঞ্জ জানিয়ে গিয়েছেন দিল্লিকে।
এই উপমহাদেশে এই এশিয়া ভূখণ্ডে সেই হত্যালীলা অব্যহত রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ দেখেছে, সারা পৃথিবী দেখেছে কীভাবে একের পর এক ব্লগার, প্রকাশক, সাংবাদিক, লেখক হিসেবে নিগৃহীত হতে হয়েছে সেখানে । অভিজিত রায় থেকে রাজীব হায়দার জামাত শিবিরের হাতে নিহত ।
 
তাহলে কি স্বাধীন চিন্তা ভাবনার মানুষের জীবনের মূল্য সাম্প্রদায়িক শক্তির হস্তেই নিহিত রয়েছে ।
 
দু’হাজার তেরো সালের অগস্টে হত্যা করা হয় নরেন্দ্র দাভোলকরকে। 'অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি '(এ এন এস) এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তিনি । অন্ধ বিশ্বাস ও যুক্তিবাদী আন্দোলনের নেতা মিঃ নরেন্দ্র দাভোলকর ছিলেন মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা । হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে
  কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো বা সি বি আই এই ঘটনার তিন বছর পর হিন্দু জনজাগরণ সমিতি নামক একটি সংগঠনের নেতা বীরেন্দ্র তাবড়েকে গ্রেফতার
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সক্রিয়তার জন্য গোবিন্দ পানসারেকেও হত্যা করা হয়। দু’হাজার পনেরো সালে। নিহত হবার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে প্রচার ও প্রতিষ্ঠায় মহিমান্বিত করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন তিনি। সমীর গায়কোয়াড় নামে একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগডনের নেতা ঐ হত্যাকাণ্ডেজড়িতএই সন্দেহে
  গ্রেফতার করা হয়েছিল ।
পানসারের অপরাধ ছিল সাধারণ মানুষের মন থেকে অবৈজ্ঞানিক ধ্যানধারণা, কুসংস্কার জনিত আচার আচরণ, অনুষ্ঠানকে চিরতরে বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি । ধর্মের নামে ঈশ্বরের নামে বুজরুকি, ভাওতাবাজির মুখোশ খুলে দিতে চেয়েছিলেন । একদিনে হয়নি, দীর্ঘদিন ধরে এই আন্দোলন চালানোর পরিণাম স্বরুপ জীবনের মহার্ঘ দিতে হলো তাঁকে।
তবে যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে, দক্ষিণপন্থীদের বিরুদ্ধে সরব হয়ে নিহত হওয়ার সর্বাধিক
  আলোচিত নাম এম এম কুলবর্গী। যুক্তিবাদী নেতা ও লেখক কুলবর্গীকে কর্ণাটকে তার বাড়ির সামনেই হত্যা করা হয়েছিল ।
ঠিক যেরকম সবচেয়ে সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ডটি ঘটে দু’হাজার সতেরোর পাঁচ'ই সেপ্টেম্বর , বেঙ্গালুরুতে রাজরাজেশ্বরী নগরে তাঁর বাড়ির সামনেই ।
 
নির্ভীক সাংবাদিক গৌরী
   লঙ্কেশকে আততায়ীদেরহাতে খুন হতে হয় হিন্দু চরমপন্থীদের কট্টর সমালোচনা করার জন্য । কিছুতেই মাথা নোয়াতে নারাজ যাঁরা, তাঁদের জন্য এই উপমহাদেশে এই এশিয়া ভূখণ্ডের শ্রেষ্ঠ উপহার মৃত্যুই। আততায়ীর হাতে নির্মম মৃত্যু । হত্যা। 
ধর্ষণ যখন প্রভুত্ব কায়েমের নির্দিষ্ট হাতিয়ার হয়ে ওঠে, কী বর্বর, ঘৃণ্য উপায়ে নারীকে শারীরিক ভাবে দখলনামার পূঁজরক্ত জর্জরিত অন্ধকার দস্তাবেজ লিখে চলে সময়ের বিক্রিত আত্মা , তখনই কি বিপন্নতার বিষন্নতার ভেতরে ঢুকে পড়ে গ্যালাক্সির শোকগাথা । শিশুমুখ অভিশপ্ত হয় । এখানে সবাই হাতিয়ার । চিন্তাশীল, মুক্তমনা, সাহসী, নির্ভীক উচ্চারণের জন্য প্রস্তুত হতে থাকে এভাবেই শতাব্দীর
 
অন্ধকারাচ্ছন্ন নাগরিক ত্রাস । ডিজিটাল ফ্ল্যাশে বন্দি
ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ, কষ্ট, আনন্দের সিসিটিভি ফুটেজ । জানতেও পারিনা দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে আততায়ীর মৃত্যুঘন ছায়া। নিমেষে ফালাফালা করে দেবে হৃৎপিণ্ডের যাবতীয় প্রণালী
  । মস্তিষ্কের সুচারু গঠনশৈলী।
আমরা দেখেছি কীভাবে বন্ধ হয়ে যায় কোনো দর্শক ও দর্শন ধন্য অর্থপূর্ণ থিয়েটার, রাষ্ট্রের শাসানি থামিয়ে দিতে চায় শিল্পের কোরাস। কীভাবে ধ্বংস হয় সাহিত্য চর্চার নিভৃত চারণভূমি । ছাপাখানা থেকে ভেসে আসে
 
স্বপ্নভঙ্গের হাহাকার ।
 
তীব্র এক অসহিষ্ণুতা, ফ্যাসিবাদে আক্রান্ত সময়ের নাগপাশ তার বিষাক্ত নিঃশ্বাস ছড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত । যেকোনওরকম মুক্তচিন্তার, গণতান্ত্রিক শক্তির শুভচিন্তকদের বধ্যভূমি ধীরে ধীরে তার শক্তি বৃদ্ধি করছে।
 
তাহলে এটাই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে রাষ্ট্র আর তার নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছেনা।
 
কিসের নিরাপত্তা
  ? মুক্তচিন্তার নিরাপত্তা,  মুক্তভাবনার নিরাপত্তা,  যৌনতার নিরাপত্তা,  ধর্মের প্রকৃত প্রস্তাবের নিরাপত্তা,   শিক্ষার নিরাপত্তা ,  স্বাধীনতার নিরাপত্তা  ,ধর্মিয় সঙ্কটে   যে উড্ডীয়মান চরমপন্থী ধ্বজাধারী মৌলবাদ তার  নিশ্চিহ্নকরণে , তার  নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত রাখার নিরাপত্তা ।  যে রাষ্ট্র কট্টর মৌলবাদী নিদান হাঁকে, জীবনের বিনিময়ে নিজের অন্ধত্বকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে কায়েম রাখতে চায়, যা আপাদমস্তক গণতন্ত্র বিরোধী, সেখানে অচলায়তনের হাওয়া এসে লাগে । মানুষের স্বাভাবিক চিন্তা শক্তির বিরুদ্ধে যখনই বারুদ প্রবণতা প্রকট ও প্রবল হয়ে ওঠে, তখনই ইতিহাসে মুখ ঢাকে কায়েমী স্বার্থের বিকৃত তথ্য । বিপন্নতায় আশ্চর্য এক রহস্য ছড়িয়ে পড়ে । তার নাম ছিল সত্য । উপমহাদেশের রক্তাক্ত পিচ্ছিল পথে পথে কলঙ্কিত হয় সভ্যতার দ্রাঘিমারেখা। এই হত্যাকারী, রক্তক্ষয়ী ভারতবর্ষই আমার দেশ । আমার জন্মভূমি । নতুন সূর্যের অপেক্ষায়।


2 comments:

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...