খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

গ্রন্থ আলোচনা- অমিত সরকার






সুব্রত সরকারের কবিতাসংগ্রহ
একটি নেশাগ্রস্ত পুনঃপাঠ –প্রতিক্রিয়া 

'যে কোন লেখাই হল আসলে এক ত্রিভুজ। লেখক, পাঠক ও লেখাটি এর তিন বাহু। কিন্তু রচনা সম্পূর্ণ হওয়ার পর এই ত্রিভুজ থেকে লেখকের বাহুটি প্রথমে খসে পড়ে। অন্য দুই বাহু এবার যাত্রা শুরু করবে সময় থেকে মহাসময়ের দিকে।' -  ফারেনহাইট ফোর ফিফটি ওয়ান ডিগ্রি / সুব্রত সরকার
সাহিত্য, ভাষার ইতিহাসের এক বহমান উপাদানকে নির্দেশ করে যে উপাদান আসলে দাঁড়িয়ে থাকে আমাদের সময় ও স্থানিক এক কোঅর্ডিনেট নির্ভরতার ওপর। কোনো কবিকে যদি এই কোঅর্ডিনেট নির্ভরতা থেকে বিচ্ছিন্ন করে অন্য একটি    হাইপার স্পেসে স্থাপন করলে, তখনও তাঁর কবিতা সমকালীন থেকে যায়, তাঁকেই আমরা বলে সময়উত্তীর্ণ। অনুভূতির    চিরকালীনতা সত্ত্বেও, আমরা তো একজন কবির কবিতায় আসলে নিজস্ব সমকালীন টপোগ্রাফিকেই খুঁজে থাকি।   
সত্তরের দশকে যখন নকশাল আন্দোলন এবং গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার স্বপ্ন উথালিপাতালি। যখন রাণাঘাটে জয় গোস্বামী, কৃষ্ণনগরে দেবদাস আচার্য, শান্তিপুরে অরুণ বসু, সুতাহাটায় শ্যামলকান্তি দাশ, মেদিনীপুরে বীতশোক ভট্টাচার্য, ডায়মন্ড হারবারে তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, মুর্শিদাবাদে জমিল সৈয়দ, শ্রীরামপুরে মৃদুল দাশগুপ্ত, হাওড়ায় গৌতম চৌধুরি, পুরুলিয়ায় নির্মল হালদার,  এমনকী সুদূর বিহারের জামশেদপুরে থেকে কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষালরা কলকাতার কবিতার জগতটিকে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলছিলেন। তখন, সত্তরের মাঝামাঝি শুরু করা একজন শীর্ণকায় কস্ট অ্যাকাউন্টান্ট একটা  দ্বিধান্বিত ভঙ্গীতে নিজস্ব কবিতার ডিকশন খুঁজছিলেন। সেটাই তাঁর সেই মুহূর্তের ‘ওয়ান হর্স ফর কিংডম
এবং তাঁর  সেই মুহূর্তের ডিসকোর্স অনিবার্য ভাবে খুঁজে নেয় এক নিজস্ব “দেবদারু কলোনি”। যেখানে ‘ভরা বয়েসের সন্তানহারা মেয়েলি বাড়িকে গায়ে পড়ে হুমহাম করছে অসহ্য না-হলুদ রোদ’। কি অসীম বাঙালি এই উচ্চারণ তাঁর কবিতায়, ‘হে ঠাকুর, আর  রাক্ষসীর মতো মারকুটে হয়ে ছিন্নভিন্ন করো না...’ (শোকের বাড়ি)। আপনি যদি সত্তর বা আশীর দশকের পাড়া কালচারময় কোলকাতা বা কাছাকাছি মফঃস্বলের কোথাও বড় হয়ে থাকেন। এই বইয়ের প্রতিটি কবিতা স্পর্শ করলে  আপনার আঙুলের তলায় দপদপ করবে সেই জীবন। মনে পড়ে যাবে দুপুরের কুয়োতলায় কে যেন প্রশ্ন করছিল, ‘কে ছায়াবউদি, কই ঘোমটা খুলে ফেল তো দেখি/ কে  বেশী রূপসী ?’ (ছায়াবউদি)         
সুব্রত সরকার একবার কোথাও লিখেছিলেন ‘ছোটোবেলার স্মৃতির ভিতর কি পায়েসের সুবাস লেগে থাকে অথবা স্মৃতির ভিতর রোপিত কেয়া ফুলের গন্ধ কি মনকে পাহারা দেয় বৃদ্ধ হয়ে গেলেও ? ঠিক বলতে পারবো না। কিন্তু আজও আমার লেখায় কুকুর ডেকে ওঠে, পুকুরে ভেসে থাকা চাঁদ, পাঁচফোড়োনের গন্ধের ভেতর দিয়ে আমার লেখারা কি মহাজীবনকে  স্পর্শ করতে চেষ্টা করে? হয়তো, হয়তো বা তা নয়। তারা যেমন হতে চেয়েছিলো বা যেমন হতে পারতো আমার দোষে নষ্ট হয়ে গেছে সব আয়োজন
কিন্তু সময় ডানা ঝাপটায় ক্রমশ এবং ক্রমাগত। তাই ১৯৯১ তে ‘সহ্য করো, বাংলাভাষা’র প্রবেশকে লেখা হয়
‘যদি বলি খোলা চুলে বই পড়তে এসো না,
তোমাকে একলা পেয়ে আমার মনে কু-ডাকে-
তুমি ঠিক বুঝবে না, লাইব্রেরী-রুমে
কম পাওয়ারের আলোয় কী হবে আমার মনে ?
কোন কীটনাশকের সাধ্য নেই আমাকে শাসনে রাখে 
তোমার হাতের ঘাম যদি লেগে যায়,আমি বই
হয়ে কী করব, শরীরের ডাকে সাড়া দিতে হলে’ 
আমি বুঝতে পারি, তাঁর লেখার জন্মসূত্র সেই জীবন, যেখান থেকে বিষের জঙ্গলের শুরু। আমার মাথার ভেতরে যখন চলকাচ্ছে গতকালকের নেশা, বিশ্বাস করুন তীব্র হ্যাংওভারের মাথার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পেতে আমি আজ ভোরবেলা র‍্যাক থেকে টেনে নিয়েছিলাম এই বইটি। তারপর টানা পাঁচঘণ্টা তাঁকে আবার পড়েছি। আমি কি ভেবেছিলাম, ‘হামে কুছ রোশনি চাহিয়ে’ ? ঠিক জানি না। অদ্ভুত আঁধার আজ যখন ঘিরে ফেলছে আমাদের জীবন,  টারগেট, প্রেশার,  ফেসবুক, ব্রেকআপ, সেলিব্রেশন, কবিতাউৎসবে ডাক না পাওয়া, আমার কাছে বাড়ি ফিরে মেয়ের বাড়িয়ে দেওয়া একগ্লাস ঠাণ্ডা জলের মত লাগছে এই কবিতাবই।   
আপনি সুব্রতদার কবিতায় ফর্ম ভাঙা খুঁজে পাবেন না । তাঁর কবিতায় সমসাময়িক অতিচেতনার গল্প নেই। বরং তাঁর লেখায় আমি পাই, খুব আকর্ষণীয় একটা কেন্দ্রীয় চেতনার বদলে একগুচ্ছ কেন্দ্রাভিগ বা সেন্ট্রিফুগাল চিন্তা চেতনার  লিপিকরণ। অনেকটা জাম্প কাট করে করে এগোনো গোদারের ছবির মতো। তাঁর কবিতায় কোন বিশেষ দর্শনের প্রচার  নেই, এবং তিনি একদমই  স্টেটমেন্টাল নন। বরং অলঙ্কার, রূপক, প্রতীক, উপমা, প্রাতিকৃতিকল্প ইত্যাদি  টুলকে সচেতন ভাবে সরিয়ে রেখে এই কবিতাগুলি দেয় একটা জলের মত প্রবহমানতা যা আমাদের মেধা ও চিন্তাকে আক্রমণ করবে। একটা স্তর ফেলে দেবে।  সুব্রতদার কোন লেখাতেই কোন গিমিক নেই, গল্পও নেই। টেকনোলজিকাল ডিটারমিনেশন নেই। কিন্তু তাঁর কবিতার চোরা আক্রমণ আছে। তাঁর ‘ফারেনহাইট ফোর ফিফটি ওয়ান ডিগ্রি’ পুনঃপাঠ করতে গিয়ে আমি সেই আক্রমণ টের পাই। হাজারগণ্ডা উদাহরণ তাঁর কবিতা থেকে তুলে এনেও আমি এই ভাইরাসের কামড় আপনাকে বোঝাতে পারবো না। তবে আমি চাইবো ‘রাবণ’  থেকে অসম্ভব যত্ন নিয়ে প্রকাশিত সুব্রত সরকারের এই কবিতাসংগ্রহ যাতে আছে ২০১৬ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর এগারোটি বই, আপনি প্লিজ পড়ুন। যার সামনে সময় নতজানু হয়ে থাকে। 

গ্রন্থ- সুব্রত সরকার-এর কবিতাসংগ্রহ
প্রকাশক- রাবণ
প্রচ্ছদ- দেবর্ষি সরকার
মূল্য- ৩৫০/-
       

1 comment:

  1. সুব্রত সরকারকে আত্মস্থ করতে পারলে, জীবন এক থাকে না।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...