খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

গ্রন্থ আলোচনা- সঞ্চিতা চক্রবর্তী










“ ঘুম আর স্বপ্নের মধ্যে ধুসর অঞ্চল.........

মাথা ঝুঁকে আসুক আরেকবার”    -

একটি ড্রপ খাওয়া বেওয়ারিশ ক্যাম্বিস বল,বৃষ্টির চাদরে মোড়া কলকাতায় বর্ষাতি ছাড়া হাঁটার একদিন, পুরনো লাইব্রেরির অন্ধকার সিঁড়ি, লংশটে শপিং মলের জানলায় বয়ে যাওয়া শ্রাবণ, যানজট, শেয়ার ট্যাক্সি, নিঃসঙ্গ হোয়াটস অ্যাপ, দু-হাট খোলা বুকশেলফ, ক্রশপাজলের মতো এই শহর...২০ জুনের ডায়রি’র চুয়ান্নটি কবিতায় রাখা আছে এমনই আশ্চর্যতম স্বপ্নকল্প অভিজ্ঞান।  এ এমন এক নষ্ট আত্মার আত্মকথন যা বিরলতম এক স্বপ্নের ব্যর্থতাকে লিখে গেছে। প্রতিষ্ঠা, অবস্থান, অস্তিত্ব ডুবে যেতে পারে, এই আশংকা করে নি।
“ শরীরে লতিয়ে উঠেছে বিষগাছ, আহ ! বিষ কী
       নিয়তি, পাতাল থেকে ডেকে চলেছে তোমায়

      ফেরার পথ বন্ধ, চলা থেমে গেলেই গুলি ছুটবে,
       এখানে রাইফেলই নিয়ামক, শিবিরে পাচার হয়
ট্রাকভর্তি বন্দি ক্রীতদাস

       শিকলের চোখে কোনও জল নেই ”
আক্রান্ত অস্তিত্ব, অতর্কিত গুপ্তহত্যা, সকাল – সন্ধ্যা – রাত্রিময় বয়ে চলা সন্ত্রাস– বরাবরই অর্ণব সাহার কবিতার অবিচ্ছিন্ন বৈশিষ্ট্য।২০০২ এ প্রকাশিত প্রথম কবিতাবই ‘ধর্ম নেই কোকাকোলা নেই’ তেই ইতিহাস ও বর্তমানকে অপূর্ব দক্ষতায় অর্ণব তাঁর কবিতার অন্তঃস্থিত চেতনায় ধরতে পেরেছিলেন। লিরিকধর্মী সহজ তরল সুমিষ্ট মায়ামন্ত্রকে উপেক্ষা করে অর্ণবের কবিতায় হয়তো বা চিরদিনের জন্যই রূপায়িত হয়েছে নৈরাজ্য ও বধ্যভূমি-এসেছে গণহত্যা, রাষ্ট্রের ভ্রষ্টাচার এবং ক্ষমতার কদর্যকেলির সুত্রগুলি- তাঁর কবিতায় সত্তার রগের কাছে সবসময়েই যেন ধরা থাকে অদৃশ্য আততায়ীর ট্রিগার – যে কোনো সময়ে তা নিঃশব্দ এক মৃত্যুকে রূপ দিতে পারে।
সময়কে, ইতিহাসকে এমনভাবে কবিতার সহচারী করে ফেলা যে কোনো কবির কাছেই ঈর্ষনীয়।অর্ণব বড় সহজেই তা করে ফেলতে পারেন। তা সত্ত্বেও সাম্প্রতিক বইমেলায় প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘ ২০জুনের ডায়েরি’ অন্য সব লেখার চেয়ে আলাদা। ‘ ২০জুনের ডায়েরি’র চুয়ান্নটি কবিতাই প্রেমের। প্রেমই এই কাব্যগ্রন্থের বিষয়, সঞ্চারী শক্তি, ম্যাজিক। বাংলা কবিতায় প্রেম... বহু ব্যবহৃত এক শব্দ। বাস্তব বা ভার্চুয়াল জীবনে প্রেম আর তেমন আলোড়িত করে না। বাংলা কবিতাতেও শুধুমাত্র প্রেম গোটা একটি কবিতাবইয়ের বিষয় হয়ে ওঠেনি বহুদিন। অর্ণব নিজেও কি কখনও লিখেছেন এমন অবিরল প্রেমের কবিতা... ‘২০ জুনের ডায়েরি’তে এক এক রাতে লেখা ৫/৬ টি কবিতাও রয়েছে। আদর, মুগ্ধতা, ছিন্ন হওয়ার ক্রোধ, ভয়, অভিমান,বিপুল যন্ত্রণার আলোড়নকে আবহমানের সকল বিরল অভিজ্ঞতা সমেত অর্ণব এক অপরূপ যাদুবৃন্তে ফুটিয়ে তুলেছেন-
    “ আমার বুকের কলজে ঘুমন্ত যখন আমি তাকে
ছেড়ে আসি !
      সে ধরা দেয় না, তার চোখে নরকঙ্কালের মায়া
ভয় দেখায়, পশমের গোলা ছিঁড়ে ফেলে
সেও খুব কুঁকড়ে যায় কম্বলের নীচে ভ্রূণ হয়ে
বুকের ভিতর থেকে ওম নিয়ে তাকে ঢেকে রাখি
উত্তরের হাওয়া যাতে তাকে না ছোঁয়াচ দিতে পারে...”
প্রেমের কবিতা তখনই শ্রেষ্ঠ হতে পারে যখন তা যাপনের সবচেয়ে কঠিন যন্ত্রণার কাঞ্চনশিখরকে ছুঁয়েযায়। যখন আমার বুকের মধ্যে বেড়ে উঠে আমারই ব্যবহারিক জীবনকে চ্যালেঞ্জ করে। প্রাত্যহিক বৃত্তকে ভেঙে ফেলে আমাকে মুক্ত মহাকাশচারী করে তোলে।
      “ মেয়েটার নাম কাউকে বলিনি
ও এক খণ্ডমুহূর্তের থেকে উঠে এসে
মিলিয়ে গেছেব্ল্যাকহোলের ভেতরে ”
সাজানো জীবনের পাশে যখন একটি মায়াবী তৃতীয় হাত এসে পড়ে, যখন তার সুদক্ষিণা বাহুটি হয়ে ওঠে আশ্রয়ের আলোকলতা, স্বগত জীবনের প্রতিস্পর্ধা;তখন আমাদের কুব্জ,ন্যুব্জ জীবনের শিরদাঁড়া সহজ হয়ে উঠতে চায়। কী বিপুল সম্ভাবনা ছিল, কী বিপুল আলোড়ন ঘটতে পারতো, অনুভব করতে করতে প্রাত্যহিকতার ভরকেন্দ্র টলে যায়-
    “স্বপ্নের ভেতরে উড়ে এসেছিল বাদামি পালক
     পরিযায়ী পাখিদের কথকতা, দূর সমুদ্রে
      মাছ ধরতে যাবে যারা নুলিয়া ছাড়াই, তাদের
      নৌকোয় রবার-টিউব, ছেঁড়া মাস্তুলের কাপড়ে
 স্বস্তিকা-চিহ্ন”
এবং শেষ পর্যন্ত বন্ধ্যা উষর সময়ে আমাদের অন্য সব সতেজ সবুজ আকাঙ্ক্ষার মতো প্রেমও চলে যায়। নিভে যাওয়া বিপ্লবের ছাই, পোড়া শরীরে দগদগে ঘায়ের সে রুদ্ধশ্বাস গন্ধ শুধুই প্রেমেই কেন, ইতিহাসেও লেগে থাকে।
১. ইরেজার দিয়ে মুছে দিলে। যেটুকু সর্বস্ব, পিছুটান
 লেখা ছিল শ্লেট পাথরের গায়ে। ছিল যে আচ্ছন্ন খিদে
খালি পেটে মদের মতো যা কেবল নিজেকেই খায়...

অরক্ষিত। পিষে যাওয়া পেনসিল হিলের নীরবতা। এই মাঠে
কোনো শোকপালনের রেওয়াজ নেই। পয়েন্ট ব্যাংক
রেঞ্জ থেকে গুলি চালানোর জন্য দুই ভ্রু-র মাঝখানের শূন্যতাই
 একমাত্র চাঁদমারি, সূর্যাস্তের পর বুলেটের আওয়াজ
শোনে দূরের গ্রামবাসী!
২।অন্যপৃথিবীতে,যারস্পর্শ-গন্ধএতদিনপর  ফিকে হয়ে গেছে, অন্য যুগের বন্ধুর ঠোঁটে আজ
 সে আর রাখে না ঠোঁট, অন্ধকার ভারী হয়ে এলে
মাথা নীচু ঘরে ফেরে, পতাকা অর্ধনমিত, আর
 সময়ের ক্যাপসুলে মুখ লুকিয়ে পিছু হঠবার
মুহূর্ত এসেছে, একে অসহায় মেনে নিতে হবে।
জলকামানে ছত্রভঙ্গ কয়েকহাজার উদ্ভিন্ন জনতা
 ছেঁড়া স্ট্র্যাপ হাতে নিয়ে ডিভাইডার পেরোয়, টের পায়
 ২০০৩ সালের বোকা ছেলেদের মিথ্যা দাবি...
৩. প্রাক্তন গেরিলারা সব একে একে ঘরে ফিরে আসে
 নামিয়ে রাখে কালাশনিকভ, হাওয়াবন্দুক
 হাত-উড়ে-যাওয়া কাটা আস্তিন দোল খায়
 বগলে ক্র্যাচ, গোড়ালিবিহীন পায়ের ছায়া পড়ে না

আবহমান কালের ইতিহাসের পরতে পরতে ছেয়ে যাকে যে সন্ত্রাস তাকে জীবিত করে তোলে এক ক্ষণস্থায়ী, দিকচিহ্নহীন গল্প।তারই অনুষঙ্গে আসে কর্ণেলকে কেউ চিঠি লেখে না, নিঃসঙ্গতার একশ বছর, স্বপনকুমারের ড্রাগন,বিফল অনেক যুদ্ধের গল্প, হোক কলরবের টুকরো। স্বপ্ন মরে গেছে, রূপকথার দিন শেষ, মরা বারুদের ওপর স্বাধীনতার ইচ্ছের হীন অবশেষ, বুনো স্ট্রবেরির রক্তে ভেসে যাওয়া দিগন্তও উধাও যখন তখন শস্যবান হয়ে উঠতে না পারা প্রেমই জানিয়ে যায় পৃথিবীতে কত অকালমৃত্যু হয়েছে, কত অকালমৃত্যুর এখনও বাকি। ‘২০ জুনের ডায়েরি’ তে আবিষ্কার করা যায় কতদিন ধরে বিচ্ছেদ আর ব্যর্থতার মধ্যেই বেঁচে আছি আমরা, বিফলতাই ইতিহাসের একমাত্র সত্য। আর আবিষ্কার করা যায় প্রেম প্রকৃতিগত, জৈবগত, নারীগত, পুরুষগত কোনো সামাজিক বা তাত্ত্বিক অভিপ্রায় নয়, তা এক বিপুল আত্মশক্তির প্রকাশ যা স্বয়ং স্বাধীন ও স্বরাট, কোন কিছুরই নিয়ণ্ত্রনাধীন নয়। সেই বিপুল আলোড়নকে অর্ণব সীমাহীন দক্ষতায় কতগুলি অলোকসম্ভব পঙক্তিতে ধরে রেখেছেন-
“ ওই নক্ষত্র
ওই বাতিল গ্রহাণু
তোমার হাত আঁকড়ে  ধরে
পাড়ি দেবে গ্রহান্তেরর পথে
মরপৃথিবীর লোকেরা দেখবে
শরীরে মিশে যাওয়া দুটো আগুনপোকা
অনন্তের কার্নিশ টপকাচ্ছে
মগজের জং ধরা তার
আর বাতিল লোহালক্কড় খসিয়ে
দুটো পুড়ে যাওয়া ট্রান্সমিটার
অবশিষ্ট ছাই রেখে গেছে আরেকবার
যেন জেটপ্লেন ধোঁয়ার রেখায়
কাঁটাতার পুড়িয়ে দিচ্ছে বধ্যভূমি জুড়ে”...
সম্ভবত ‘২০ জুনের ডায়েরি’র সবচে বিধ্বংসী কবিতা এটি, জড়জগতের মধ্যে কী অনায়াসদক্ষতায় অর্ণব তাঁর আত্মনকে সঞ্চারিত করেছেন, নির্মাণ ও শৈলীর চমৎকারিত্ব এই বইয়ের প্রতিটি কবিতাতেই পাঠককে বিস্ময় তাড়িত করবে। রূপকল্প চেনাবৃত্তের কবিতাপ্রয়াসকে কতদূর অতিক্রম করতে পারে ‘২০ জুনের ডায়েরি’র কটি লাইন তার প্রমান-
১. সম্পর্ক গাছের গায়ে হিসি করে দিলে
 গড়িয়ে পড়ল অ্যামোনিয়া, ছাইগাদার ফুটন্ত গোলাপ
 গল্পের আড়ালে থাকা বিশ্বাসভঙ্গের কথা বলে
২. ঘুম আর স্বপ্নের মধ্যে ধূসর অঞ্চল এক
 নিঃসঙ্গ জিপসি সেই কাঁটাতারের বর্ডার পেরোয়
 দানবের মতো সাইনবোর্ড মুখ ভ্যাঙাচ্ছে আর
 দিগন্তের ওপারে ঠায় দাঁড়িয়ে তার ন্যুব্জ, ক্লান্ত ঘোড়া
৩. যা ছিল আগুন, তাকে পোড়া ছাই হয়ে যেতে দেখে
 নিভে যাওয়া মানুষের ক্ষতস্থানে রক্ত ঝরে পড়ে!
৪. রাতের পর রাত ঘুমোইনি, ইনবক্সে
 ৩৭০ টা মেসেজের চোরাটান অ্যালজোলামের চেয়েও দামি
৫. তোমার চোখে অন্যের সূর্যাস্ত অভ্যেস হয়ে যাবে
৬. নিজের অজান্তেই তুমি বিষকৌটো যার ঢাকনা একবার খুললে/ কিছুতেই আটকানো যায় না আর

বিষ, ট্যাবলেট, তিক্ততা এই কাব্যগ্রন্থের অবিচ্ছিন্ন অনুষঙ্গ কিন্তু এক আশ্চর্য সৌন্দর্যে,  আবিরে, স্বপ্নে রঙিন হয়ে গেছে ডায়েরির পাতা, প্রায়শই-
১. অক্ষরের ফুল, তুমি বাতাসে দুলিয়ে দাও মাথা/ অদ্ভুত  হাওয়া দিচ্ছে, ডিসেম্বর, বৃষ্টি নেমে এল
২. বনাঞ্চলে আগুন-রঙা,মেঘ/তাঁবুর গায়ে কনে-দেখার আলো
৩. দুটো শরীর ভাপে সেদ্ধ হয়েছিল, কার্নিশে/গোলাপায়রার ডাক, এই সামান্য ছবিগুলোযেদিন/অকিঞ্চিৎকর হবে, শেষ বিকেলের আকাশে ছড়িয়ে পড়বে/চলকে ওঠা রং, স্বপ্নের সমাধি জুড়ে/বাজতে থাকবে তারসানাই। ইতিহাস ছন্নছাড়া হবে......
‘ ২০জুনের ডায়েরি’ শুরু হয়েছে ২১জুন ২০১৫, বিকেল ৫-০৫মিনিট থেকে। প্রতি কবিতার অবশেষে রয়েছে তারিখ ও সময়ের এই বিন্যাস, ডায়েরি চলেছে ৭ নভেম্বর ২০১৬, সকাল ০৬-৫২ মিনিট পর্যন্ত। মাঝে ২৭ আগস্ট ২০১৫-র  একটি কবিতা বইটির শিরোনামশূন্য উৎসর্গ পত্রে রয়েছে। মৃণাল শীলের প্রচ্ছদ দেখলে মনে হয় শুধু কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ নিয়েই কত ভালো গবেষণা বাংলা সাহিত্যের প্রেক্ষিতে হতে পারে। পতনশীল ছিন্নভিন্ন আত্মার ওপর রক্তক্ষরণ আর সংহত স্টিচ প্রচ্ছদকে অনন্য মাত্রা দিয়েছে।
         কবির আত্মমোক্ষণ অবধারিত ছুঁয়ে যাবে পাঠকের অন্তরকে। কোনোও দুর্বোধ্যতা নেই। যাদুবাস্তবের যে ভাষা, তাকে অর্ণব স্বয়ংক্রিয় ও সহজ করে তুলেছেন।আর নিজের অজান্তেই হয়তো বুনে দিয়েছেন প্রতিটি কবিতায় অনিঃশেষ আনন্দের বর্ণালি, জন্মদিনের মিষ্টি আগুন পাতা কেকের উপরে, প্রথাগত জীবনের ঠিক বিপ্রতীপে, আলোয় উদ্ভাসিত নভোমন্ডলে তৈরি হয় আমাদের আরেক জন্ম, তৃতীয় নয়নে ধরা পড়ে আমার ভিতরের চরম সাহসী, চিরকালের আপোসহীন সংগ্রামীসত্তার পরিচয়। যুগান্তর হয়।বাংলা কবিতা সেই আদরে, সেই পুলকে লাল হয়ে যাক-
         “আমরা গম্ভীর প্রতারক/ আমরা অস্ত্রসমর্পণকারী
          যখন চার্চের ঘণ্টা শোনা যায়/রক্ত ঝরে বাগানবাড়িতে
           কারা যেন ছোটাছুটি করে/কাটামুণ্ডু গড়ায় রাস্তায়
          দুহাতে পিস্তল আর টর্চ/অতিরিক্ত তৃতীয় হাত
          একটা তিন নম্বর হাত”
                         স্বাগত, ‘২০ জুনের ডায়েরি’।

গ্রন্থনাম: ২০ জুনের ডায়েরি/ কবি: অর্ণব সাহা
 প্রকাশক: কলিকাতা লেটারপ্রেস/ দাম: ১০০ টাকা।

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...