খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ -প্রসূন মজুমদার


ক্রোড়পত্র



 স্বীকৃতি -কবিখ্যাতি- শূন্যতা

প্রায় একইসঙ্গে দুটো বড় কাগজে একই যুগল কবির সাক্ষাৎকার বা আড্ডা ছাপা হচ্ছে দেখে আমার ভিতরে বহুদিনের প্রশ্নটা আবার চাগাড় দিয়ে উঠলো।প্রাচীন আর মধ্যযুগের ভারতে রাজকবি হওয়ার যোগ্যতা কী ছিল? মোটামুটি পড়াশোনা করে যা দেখেছি, রাজকবি হতে গেলে কবিতার স্কিল চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে জানতে হত। ছন্দ এবং অলঙ্কার পাঞ্চ করে এমন চটুল আর আপাত সরল কবিতা লেখার দক্ষতা অর্জন করতে হতো যাতে একছটাক দুঃখ গুঁড়োর সঙ্গে পাঁচ ছটাক আদিরস মিশ খেয়ে সম্পূর্ণ আনপড় পাঠকের মুখ দিয়েও একটা বাঃ বলিয়ে নেওয়া যেত। সম্ভবত এই বিশেষ গুণ ছিল বলেই বিদ্যাপতি '
কুলিশ শত শত
   পাত মোদিত
           ময়ূর নাচত মাতিয়
    কান্ত পাহুন        কাম দারুণ
           ফাটি যায়ত ছাতিয়া।'
লিখে প্রচুর হাততালি ও পাবলিসিটি সহ রাজকবির আসনটি জয় করেছিলেন। আর 'বসিয়া বিরলে থাকয়ে একলে' লিখে চণ্ডীদাস একলা, লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গিয়েছিলেন।একই পরিণতি দেখতে পাবেন গোবিন্দদাস আর জ্ঞানদাসের ক্ষেত্রে।জ্ঞানদাস যেহেতু ভাবগাম্ভীর্যকে কবিতায় বজায় রাখতে চেয়েছেন,তাই তিনি সমসময়ে গোবিন্দদাসের থেকে ব্যাকফুটে।জ্ঞানদাসের পক্ষে কী একটা 'নন্দ - নন্দন চন্দ-চন্দন গন্ধ- নিন্দিত অঙ্গ' লেখা অসম্ভব ছিল? তাহলে? কিম্বা ধরুন কৃত্তিবাস। কেন তিনি রাজকবি? তিনি লিখেছেন কী! রামায়ণের অনুবাদ।সেই অনুবাদে পাঞ্চ করেছেন লোকমান্য গল্প।বাঙালির পেটে তত্ত্বকথা সইবে না অনুমান করে তিনি রাম-রাবণ-সীতাকে ভ্যাদভেদে বাঙালিত্ব দিয়েছেন।সাধারণ লোকের বিনোদনের জন্য লিখেছেন,
' মনে মনে হাসে তবে পবনকুমারে
প্রস্রাব করিয়া দিল স্কন্ধের উপরে'
এটাকেই মাথায় তুলে রাজসভা কৃত্তিবাসকে সার্টিফিকেট দিয়েছে। আরও এগিয়ে চলুন।দেখুন এবারে রাজকবি কে? সৈয়দ আলাওল। কী লিখলেন? তোহফা।সয়ফয়-উল-মূলক- বদিউজ্জামাল।প্রথমটা তত্ত্বধর্মী। জনমন-মোহনে ডাহা ফেল।দ্বিতীয়টা প্রেমের গল্প।ছন্দে দুলিয়ে অলংকারে সাজিয়ে তোলা।রাজানুগ্রহ পেয়ে গেলেন।কিন্তু জনমন পেলেন না।কারণ? সয়ফয়-উল-মূলককে আরাকানের মানুষ রিলেট করতে পারছে না।এবার? মাস্টারস্ট্রোক পদ্মাবতী। সাধারণের প্লেটে সাজিয়ে দেওয়ার মতো গল্প।প্রেম,যৌন - ঈর্ষা, যুদ্ধ। একেবারে জমে ক্ষীর।সফল রাজকবি আলাওল। আরো পরে রায়গুণাকর।আহা।রাজকবি হবার জন্যই তার লেখা।রাজার চেয়ার রুমাল দিয়ে মুছে দেন নি বটে কিন্তু 'কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়' লিখে একেবারে রাজকবির যোগ্য প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছেন।আর সেক্স।সে তো উপচিয়ে পড়েছে বিদ্যাসুন্দরে। ফলে জনমোহনীয় হয়ে হাততালি পেয়েছেন বিস্তর। এদিকে একইসময়ে বর্তমান রামপ্রসাদ লিখছেন' চাই না মা গো রাজা হতে। ' কী চান তিনি?
  মায়ের পায়ের জবার মতো মনকে ফুটিয়ে তুলতে। এই কবি কিভাবেই বা রাজকবি হবেন।মাস-এপিল তাঁর ছিল। এখন তাঁর লেখা গান বাঙালি যা জানে তাও লিরিকে কালি নাম থাকায় আর সুরের কারণে।কিন্তু সুরহীন কবিতাকে পাবলিকের মনে ধরাতে তিনি পারতেন না।তার জন্য দরকার ছিল ভারতচন্দ্রের তোটক বা তূণক ছন্দ। যেখানে তিনি লিখবেন -

'ভূতনাথ ভূতসাথ
   দক্ষযজ্ঞ নাশিছে
  যক্ষ - রক্ষ         লক্ষ লক্ষ
           অট্ট অট্ট হাসিছে।'
কেবল ছন্দের দোলায় জনমন কবিতা শুনে হাততালি দেবে।আর কে না জানে প্রজার জন্যেই রাজা।যে কবিতা প্রজা-হৃদয় জয় করতে পারবে না,সে কবিতার কবিকে রাজা কেন রাজকবি হিসেবে পুষবেন!

এতক্ষণ ধরে মধ্যযুগের কবিদের নিয়ে এত ভ্যান্তাড়া করলাম কেন? তথ্য দেবার জন্য নয়।জনমান্য অধ্যাপক-সুলভ তথ্যপ্লুত প্রবন্ধ রচনার দায় আমার নেই।আমার কাছে খুব বেশি তথ্যও নেই। আমার মনে হয় গুগলের যুগে এসে প্রবন্ধে তথ্যের পসরা সাজানো বেশ অশ্লীল। এ - প্রসঙ্গে বলে নেওয়া ভালো যে,সাহিত্যে যা কিছু অধিকন্তু তাকেই আমি অন্তত অশ্লীল বলে মানি। যাই হোক আমার কথাটা হল বাংলা কবিতা আজ এই ২০১৮ তে দাঁড়িয়েও যদি রাজকবি - ভাবনা থেকে বেরোতে না পারে তবে তার দায় কি শুধু রাজার জায়গায় বসা বেনেকূলের? বেনেরা তো ব্যবসা করবেই।বেওসা - বৃদ্ধির জন্যে তারা ধুম মচাতেই পারে,কিন্তু বাংলা - সাহিত্যের পাঠকরা সেই ধুমে উছলে উঠবে? উচ্ছল - জলধি - তরঙ্গ থেকে তারা কি এখনও বেরোবে না? একদল বলতে চাইছে বেরিয়েছে তো! বাজারি এক কাগজে কবি অংশুমান কর বলেছেন,তাঁর পরে লিখতে আসা কবিদের একটা বড় অংশ কবিতার জনপ্রিয়তার তত্ত্বকেই অগ্রাহ্য করে।আমি অংশুমানদার সঙ্গে একমত আবার কিছুটা ডিফারও করছি।আমার মতে এই প্রজন্মের বড় অংশের কবি বলতে অংশুমানদা যাদের ইঙ্গিত করেছে, তারা, আমার মতে,বাজারি কবিতা ব্যাপারে একটু বীতরাগ পোষণ করে।তার মানে এই নয় যে,তারা জনপ্রিয়তা চায় না,বা প্রচলিত পথ থেকে পুরো বেরিয়ে এসে নতুন কাঁটাঝোপ-পূর্ণ অন্ধকার পথে হেঁটে যেতে চায়।তাদের ভাবসাব দেখে বিভ্রান্ত হলে চলবে না।তাদের কবিতা পড়তে হবে।মন দিয়ে পড়লে এবং ভাবতে চাইলে দেখা যাবে এই কবিদের সিংহভাগ আসলে সেই পুরোনো মালকেই এদিক-ওদিক করে চালাচ্ছে।আর সত্যি বলতে কি এরা জনপ্রিয়তা-পাবার জন্যেই জনপ্রিয়তার বিপরীতে যাওয়ার
 
কথা ভাবে। যদি না ভাবতো তাহলে কোন কবিসভায় ডাক পেলো না,কোন পুরস্কার ফস্কে গেল, এইসব নিয়ে হেদিয়ে মরতো না। মনে রাখবেন আমি কিন্তু সিংহভাগ লিখেছি,সবাই লিখি নি। এখন এই খ্যাতি- লোলুপতা নিয়েও আমি এই লেখায় কিছু ভাবতে চাই না,কারণ আমার মতে খ্যাতি-লোলুপ কোন কবি যদি কবিতায় শ্রেষ্ঠত্ব ছুঁয়ে দিতে পারেন সেক্ষেত্রে আমার কাছে অন্তত তার খ্যাতি-হ্যাংলামোয় কোন অসুবিধা নেই।আমার কাছে শেষাবধি কবিতাই বিচার্য, কবি নয়।পাবলো পিকাসো জীবনের শেষদিকে এসে একজন ব্যক্তিগত সচিব রেখেছিলেন যার কাজটাই ছিল পিকাসো সম্পর্কে যে - সমস্ত পত্রিকা প্রশংসা - বচন লিখেছে সেই পত্রিকা সংগ্রহ করে প্রশংসাগুলো পিকাসোকে পড়ে শোনানো।এইগুলো তাঁকে নতুন কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করতো।সুতরাং, আমার বলার বিষয় এটা নয় যে কবিদের সন্ন্যাসী  হতে হবে,বরং আমি এটা বলতে চাইছি যে,কবিদের ভূয়োদর্শিতা থাকতে হবে।এটা আমার কথা না। কথাটা র‍্যাঁবোর।সত্যি ভাবুন তো, আমাদের এই বাংলায় একটা র‍্যাবোঁ,একটা ভের্লেন,একটা জ্যঁ জেনে কিম্বা একটা বোদল্যেয়র জন্মালো না কেন? আমরা আসলে বড় বেশি প্রাতিষ্ঠানিক। আমাদের আধুনিক কবি মাইকেল। অসাধারণ প্রতিভা তাঁর।ভেঙেচুরে দিয়েছেন সমসময়ের কবিওয়ালাদের সব কৃৎকৌশলের ভ্রান্ত কারিকুরি। আধুনিক কবিতার পথ একার হাতে কেটে দিয়ে গিয়েছেন।কিন্তু তাঁর কবিতা ভীষণ সম্ভ্রান্ত।তাঁর স্কুলিং ডিরোজিওর বিপরীতে।  ইংরেজ আর পাশ্চাত্য অনুকরণের পক্ষে।বিশেষ করে বলতে গেলে তিনি ভিক্টোরিয়ান মর‍্যালিটি দিয়েই মর‍্যালিটির সমস্যাগুলোকে বিদ্ধ করতে চেয়েছেন। নতুন কোনো জীবনবোধ তাঁর নিজস্ব চলায় ছিল কিন্তু সমাজবোধকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়েও তিনি সম্ভ্রান্ত ভাববিশ্বের বাইরে পা রাখতে পারলেন কোথায়?  তারপরে রবীন্দ্রনাথ। বাংলার নয়নের মণি।সংস্কৃতির গুরু ঠাকুর।দু- একবার তিনি ভব্যতার গণ্ডি মাঝে শান্তি নাহি মানি' টাইপের কথা বলেছেন বটে কিন্তু সত্যিই কি তিনি লেখায় ভব্যতার গণ্ডি ভাঙতে পেরেছিলেন বা আদৌ চেয়েছিলেন? জীবনের অন্ধকার দিকটা, যাকে বলে ওয়ারশার পার্ট অফ লাইফ সেটা তাঁর কবিতায় নেই।নিঃসন্দেহে তিনি মহৎ কবি, তিনি ভারতীয় দর্শনকে কবিতায় নিখুঁতভাবে ধরে ফেলেছিলেন।কিন্তু নিজস্ব দর্শন! জীবনের ওপারে তিনি খোঁজ চালিয়েছেন।সীমার মাঝে অসীমের খোঁজ করেছেন।সন্দেহ নেই,এই খোঁজ তাঁকে মহত্বের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে।কিন্তু সীমা শব্দটা তিনি যখন ব্যবহার করছেন তখন তিনি তো আসলে দুটো লিমিটের মধ্যে সীমাকে রাখছেন।সেই সীমার ওপারে যদি স্বর্গ হয়।যেখানে আমার মাঝে তোমার মানে রবীন্দ্রকল্পিত ঈশ্বরের প্রকাশচিন্তায় পাঠক অভিভূত, তবে সেই সীমারই বিপরীত ক্রান্তিরেখার ওপারে তো থাকবে নরক।রবীন্দ্রনাথ সেই নরকে এক ঋতু কেন একটা মিনিটও কাটান নি তাঁর কবিতায়।এমনকি তিনি বোদলেয়ারকে 'আসবাবের কবি' বলেছেন। জানিয়েছেন বোদলেয়ারের কবিতা তাঁর ভালো লাগে না।তাতে বোদলেয়ারের কিছু যায় আসে নি।কিন্তু তিনি যদি কোন বাঙালি কবিকে এমন বলতেন তবে সেই বাঙালি কবির কাব্য-স্বীকৃতিতে ঘোর অমাবস্যা নেমে আসার উপক্রম হত না কি? এখন বুঝতে পারছি আমার লেখাটা স্বীকৃতি নামের বিষয়টার ওপর একটু বেশি মনোনিবেশ করতে চাইছে।

        স্বীকৃতি ব্যাপারটা মানুষ ছাড়া অন্য জীবের চাহিদায় আছে? কুকুর,ছাগল কোনোদিন তার কোন কাজের জন্যে স্বীকৃতি পাবার অপেক্ষা করে? কিম্বা গাছ? গাছ কখনো অক্সিজেন পাঠানোর জন্যে স্বীকৃতি চায়? মানুষ চায়।একটা সামান্য কাজের জন্যেও সে স্বীকৃতি দাবি করে বসে। বাঙালি কবিরা আবার স্বীকৃতি ব্যাপারটা একটু বেশিই চায়।কবিতা লিখে টাকা-পয়সা তেমন পাওয়া যায় না বলেই কী তারা স্বীকৃতি পেতে চায়! অবাক ব্যাপার হল একজন কবি স্বীকৃতির জন্যে কবিতা লিখছেন এটা আবার কবিত্বকে হেয় করে।রবীন্দ্রনাথের লেখা 'কবির স্ত্রী' কবিতাটি নিশ্চয় মনে আছে, সেখানেও কিন্তু অর্থ নয়,স্বীকৃতির প্রসঙ্গ পেড়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু একজন কবি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে লিখছেন এমনটা তো হবার কথা না,এমনকি লিখে ফেলার পরে স্বীকৃতি চাইছেন এমনটাও হবার কথা না।কবি তো অন্বেষক। তিনি তো দৃশ্যের ভিতরে দৃশ্য আর শব্দের ভিতরে শব্দের অনন্ত সম্ভবনাকে খুঁজছেন, তিনি তো  জ্ঞানের সমুদ্রের ঢেউ-এ লুটোপুটি খেতে অনন্ত সম্ভবনাময় জ্ঞানাতীত উপলব্ধির জগতে পৌঁছতে চাইছেন।একজন বিজ্ঞানী যখন তাঁর এক্সপেরিমেন্ট-এর মধ্যে ডুব দিয়ে দেন তখন তাঁর চারপাশের মরজগৎ থেকে তাঁর মন বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যতই তাঁর গবেষণা এগিয়ে চলে ততই তিনি তাঁর চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে চান।একজন কবিও তো এভাবেই নিজের চেতনার অনুভবে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হবেন।তখন তাঁর কাজকে সমাজ স্বীকৃতি দিক বা না দিক কিছুতেই তাঁর কিছু যায় আসবে না।এমনটাই হওয়ার কথা।মহৎ কবিদের ক্ষেত্রে তা-ই হয়।নাহলে জীবনানন্দ হওয়া যায় না।জেনে হওয়া যায় না। তবে উল্টোটাও হয়। স্বীকৃতি পাবার আকুলতা আছে এমন মহৎ কবিদেরও পাওয়া যায়। যেমন বোদলেয়ার,র‍্যাবোঁ, পেশোয়া।তবে এরা যে স্বীকৃতি চান সেটা পুরস্কার না,সেটা এদের কল্পস্বর্গকে সাধারণের মনে চারিয়ে দেওয়ার স্বীকৃতি।এরা চান কাজের স্বীকৃতি পাঠকের কাছ থেকে এই ছড়াতেই আজ আমাকে তোমার কাছে আনলো হাওয়া/সে-ই তো আমার পরম পুলক,সে-ই তো আমার পদক পাওয়া।'এটা লিখেছেন মৃদুল দাশগুপ্ত। এই তোমার মানে পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারাটুকুই কবির চরম স্বীকৃতি। কিন্তু মুস্কিল হল কবি আর পাঠকের মধ্যে একধরণের বেনিয়া মাধ্যম ইদানীং কাজ করে।আগে মাধ্যম ছিল রাজারা। রাজকবির পদ দিয়ে কবিদের তারা পাঠক-প্রিয়তা দিত।এখন এই কাজ করে বেনিয়ারা তারা কবিকে পাঠকের কাছে বেচে দিয়ে টু-পাইস রোজগার- সহ  নিজেদের সংস্কৃতিবান হিসেবে প্রোজেক্ট করার চেষ্টা করে।আর আছে রাষ্ট্র। তারাও বিপজ্জনক সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে নিজের শিরায় রক্তভাসানো কবির দার্ঢ্যকে ভয় করে।তাই তোষণ করে শান্ত রাখার, বশংবদ করে রাখার একটা প্রয়াস সে নিয়োজিত করে চলে।খ্যাতি-হ্যাংলা কবির একটা দল এই গর্তে পা দেয়।এবং স্বীকৃতি = সাফল্যের ভুল অঙ্কে জড়িয়ে পড়ে কবিত্বের অপমান ক্রমাগত করে চলে।এই অঙ্কে ভুল করা তুখোড় অঙ্ককষিয়ে সাফল্য - শিকারি কবিদের একদল বড় অঙ্কের পুরষ্কার পাওয়ার জন্যে লালায়িত। কোন বেনিয়া প্রতিষ্ঠান তাদের পয়সা দেয়। তাদের পুরস্কার দেয়।প্রচ্ছদে ছবি ছাপায়।এটাকেই তারা স্বীকৃতি মনে করে। বেনিয়াদের প্রচারে তাদের কবিতা বিক্রি হয়,পাঠক বা অপাঠক তাদের বই কেনে,সই নেয়।এতে তারা আপ্লুত।পাঠকের কাছে পৌঁছনোই তো কবির পরম পুলক।পদক পাওয়া।তাহলে অঙ্ক ভুল কোথায়? পুরস্কার>প্রচার>পাঠকবৃদ্ধি।কিন্তু এটা কবিতার সাফল্যের অঙ্ক না।ওই যে পাঠক, সে কবেকার পাঠক? এক বছরের।পরের বছর নতুন কবি। নতুন পুরস্কার।ব্যাস। 'পুরোনো সে নক্ষত্রের দিন শেষ হয় নতুনেরা আসিতেছে বলে'। তখন একদিন আম্মো পেয়েছিলামের কলার গলায় বেঁধে ঝোলানো ছাড়া উপায় নেই।যে এই একবছর না, ভবিষ্যৎ বছরগুলো পেরিয়ে যুগের ওপারে তার ভাবনাকে সঞ্চারিত করতে পারে সে-ই আসলে অধিক সংখ্যক পাঠক পায়। সে-ই শেষ দৌড়ে স্বীকৃতি জেতে।

       এই সহজ গল্পের বাইরে আর একদল কবি আছে যারা সরাসরি রাষ্ট্রের দেওয়া পুরস্কার পায়।নেয়।এবং গর্বিত বোধ করে।এদের দেখলে আমার আরো গুলিয়ে যায় সব।কবি তো মুখোশহীন সময়ের দিকে আপোষহীন এগিয়ে যাবে বলেই জানি।রাষ্ট্র - নির্বাচিত হয়ে সেই রাজকবিরা কিভাবে নিজেদের কবি হিসেবে দাবি করতে পারে তা ভাবলে হাসি পেয়ে যায়। মনে হয় কবি-মুখোশ - পরা কেউ নিজের মুখোশটা প্রাণপণে চেপে ধরে অন্যের মুখোশ নিয়ে টানাটানি করছে। ল্যাংটা যদি অন্যকে ল্যাংটা বলে ব্যাঙ্গ করে তবে ব্যাঙেও হাসবে। সুতরাং স্বীকৃতির জন্যে আকুলি-বিকুলি না করে একটু গাছ হতে চাইলে,পাখি হতে চাইলে হয়তো শুধু একটা গভীর উড়ানের আনন্দ পাবার জন্যেই ওড়ার ইচ্ছে করা যাবে। হয়তো সেই ডানা-নাড়ার শব্দ অনেক পরের কোন ভিজে দুপুরে উদাসী  কিশোরীর স্বপ্নে নেমে আসবে।সেটাই কি হবে না কবির সবচেয়ে বড় স্বীকৃতি? 


1 comment:

  1. স্বপ্ন উড়ানের স্বীকৃতি ... অনবদ্য

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...