খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ- অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়






স্বীকৃতি সম্পর্কে ৯৯৯ শব্দ


‘... সেই নৌকো পুড়িয়ে দাও - যা শুধু ওপারে নিয়ে যায়।… বরং সেখানে চলে যাও যেখানে জীবিত ও মৃত সম-আদরে গৃহীত হয়।’

(১২.০৫.১৯৯৫ তারিখে কমল চক্রবর্তীকে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠির অংশ।)



বিশ্বাস এক বড্ড গোলমেলে শব্দ এবং বিপজ্জনক ক্রিয়াপদ। একপ্রকার অন্ধত্বই তার দাবি। কিন্তু যখন এই শব্দটির আগে ‘অন্তিম’ শব্দটি বসে, তখন সেই অন্ধত্বের পায়ে আমার দুঃখদিনের রক্তকমল রাখা হোক। ‘একজন লেখক শুধুমাত্র সেইসব অর্থবহতার প্রতিই তাঁর অন্তিম বিশ্বাস রাখতে পারেন যা তাঁর লিখিত শব্দ।’ ১৯৬৪ সালে নোবেল পুরস্কার ঘোষণার পরদিন তা প্রত্যাখ্যান করে সুইডিশ প্রেস-প্রতিনিধির কাছে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সার্ত্র এই বাক্যটি উচ্চারণ করেন।
স্বীকৃতি, পুরস্কার সম্পর্কে এ দেশে এবং অন্য দেশেও অনেকজন নানারকম কথা বলেছেন। তার মধ্যে বেশ কয়েকটা তো, যাকে বলে কোটেবল কোট। সেরা কথাটি বলেছিলেন বোধয়, কালিদাস। মেঘদূতে। ‘গুণীরে অনুনয় বিফলে সেও ভালো, অধমে বর দিলে নিতে নেই।’ ঋতুপর্ণর ‘ফার্স্ট পার্সন’-এ একটা ভারি মজার ঘটনার উল্লেখ ছিল। ঋতুপর্ণর একবার নৈশভোজের নেমন্তন্ন শ্যাম বেনেগালের বাড়ি। সান্ধ্য আড্ডার পর রাতের দিকে ওঁরা, মানে শ্যামবাবু, শ্যামবাবুর স্ত্রী আর ঋতুপর্ণ খেতে বসেছেন। দেখা গেল শ্যামবাবুর স্ত্রী রুপোর থালায় খেতে দিচ্ছেন সবাইকে। ঋতুপর্ণ একটু অবাক। ওঁদের বাড়ি, ঘরদোর, আসবাবপত্রের সঙ্গে রুপোর থালাটা খুব বেমানান। মুখে কিছু না বললেও ঋতুপর্ণর অভিব্যক্তিতে সেই অবাক হওয়া প্রকাশ পেয়ে গেছিল, যা দেখে ফেলেছিলেন শ্যামবাবুর স্ত্রী। উনি নাকি তখন বললেন, আসলে ও তো অনেকগুলো রজতকমল (রৌপ্য পদক) পেয়েছে। তো, একদিন বলল এতসব বাড়িতে জমিয়ে রেখে কী আর হবে, বরং গলিয়ে নিয়ে খাবার থালা বানিয়ে নেওয়া হোক।  ফার্স্ট পার্সনে এই ঘটনাটার উল্লেখ করে ঋতুপর্ণ লিখেছিলেন, পুরস্কারের নিষ্ফলা সাফল্যকে এভাবেই বোধহয় সবার সঙ্গে ভাগ করে নেয়া যায়। ঠিক এরকমই না হলেও, একটু অন্যভাবে সন্দীপন লিখেছিলেন পুরস্কারের কত ঝামেলা। একে তো সময়ে সময়ে মেডেলটাকে দোকানে পাঠাও পালিশ করানোর জন্য। সেখানে শুধু তো আমার মেডেলটাই আসছে তা নয়। এলাকার আরও যারা মেডেল পেয়েছে তাদেরটাও এখানেই আসবে পালিশ হতে। দেখা গেল হয়তো পালিশ হয়ে কোনও ফুটবলারের শিল্ড চলে এল আমার বাড়ি, আর আমার উপন্যাসের মেডেল গেল ফুটবলারের কাছে। তারপর সেই খেলোয়াড়কে খুঁজেপেতে বের করো, মেডেল অদল-বদল করো। কম হ্যাপা?
অনুষ্ঠান, আনুষ্ঠানিকতা, আলোচনা, সমালোচনা, রিভিউ, প্রচার, বিজ্ঞাপন, বিপণন, সম্মাননা, মানপত্র, উত্তরীয়, পুষ্প স্তবক, পদক, পুরস্কার,গ্র‍্যান্ট, এককথায় স্বীকৃতি — একজন লেখক হিসেবে এসব আমার কাছে অর্থহীন বললেও কিছুই বলা হয় না। একটা লেখার সামনে একজন লেখকের একা, নিঃসঙ্গ দাঁড়ানোর জন্য এগুলোর কোনওটাই প্রয়োজনীয় নয়। ‘উচ্চারণে আমি একা’। ঠিক একইভাবে, একটি শিল্পকর্ম বা বইয়ের সামনে একজন পাঠক যখন দাঁড়ায়, আমি চাইব, সেও একা, নিঃসঙ্গ হয়েই দাঁড়াবে। কোনও অনুষ্ঠান, আনুষ্ঠানিকতা, আলোচনা, সমালোচনা, রিভিউ, প্রচার, বিজ্ঞাপন, বিপণন, সম্মাননা, মানপত্র, উত্তরীয়, পুষ্প স্তবক, পদক, পুরস্কার, গ্র‍্যান্ট, এককথায় স্বীকৃতি — তাকে প্রভাবিত করবে না সেই শিল্পকর্ম বা বইটির সামনে মুখোমুখি দাঁড়াতে, একমাত্র তার ওই মুহূর্তের নৈসর্গিক নিঃসঙ্গতা ছাড়া। একজন পাঠক যখন একটা বই হাতে নেবে, সেখানে সে আর ওই বইটি ছাড়া দুজনের মাঝখানে অন্য কিছু নেই। তাদের পাশে বা পেছনেও কেউ নেই। আমার চাওয়ায় পৃথিবীর একটিও চুল বাঁকা না হলেও, আমি এমনটাই চাইব। ঘন গভীর জঙ্গলে একটা বুনো জন্তু বা বন্য জংলি ফুলের চোখের দিকে তাকিয়ে যেভাবে একা একটা মানুষ দাঁড়ায়, দাঁড়াতে পারে, সেভাবেই সে কলেজ স্ট্রিট বা বইমেলায় বা এরকমই কোনও বইয়ের দোকানে একটা বইয়ের সামনে দাঁড়াবে। নিজের তথাকথিত ‘আনুষ্ঠানিক সভ্যতা’র ব্লেজার খুলে, পারলে, ন্যাংটো হয়ে। যেভাবে বইটি তার সামনে দাঁড়িয়েছে, ন্যাংটো এবং একা। একজন লেখককে যদি জিগ্যেস করা হয়, আপনি কেন লেখেন, তার একমাত্র সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে, ‘আমি জানি না’। একজন পাঠককে যদি জিগ্যেস করা হয়, আপনি এই বইটি কেন পড়ছেন, তিনিও যেন বলতে পারেন ‘আমি জানি না’। কারণ, এ টেক্সট ইজ আ ফর্ম অফ পার্সোনাল স্যালভেশন। 
স্বীকৃতি, পুরস্কার সবসময় লেখক বা শিল্পীই গ্রহণ করেন বা প্রত্যাখ্যান করেন। বা গ্রহণ করার পর সময়মতো তা ফিরিয়েও দেন। শিল্পকর্মটি নিজে এসবের কোনও ধারই ধারে না। সে আদিম, বুনো, জংলি, অসভ্য এবং বর্বর। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছিলেন বা নিয়েছিলেন বলে আমরা ওঁর গানগুলো, সুরগুলো শুনে কাঁদি না। তারা নিজেরাই আমাদের কাঁদায়, আমাদের আত্মত্রাণ ঘটায়, তাই আমরা কাঁদি। নোবেল চুরি হয়ে গেলেও ওই সুর একইরকম ত্রাণক্ষম থাকে। কারণ সে বা জঙ্গলের ওই বুনো বাঘটা এই সভ্যতার, এই আনুষ্ঠানিকতার, এই সার্টিফিকেটের পরোয়া করে না। শিল্পী বা ফরেস্ট রেঞ্জার নিজে করেন কি করেন না দ্যাট ডাজ নট ম্যাটার।
তবে শিল্পবস্তুর না থাকলেও, মানুষের এই সামাজিকতার, এই আনুষ্ঠানিকতার, এই জাগতিকতার প্রয়োজন আছে। ঠিক যেমন তার প্রয়োজন আছে বাড়িতে একটি স্যানিটরি সিস্টেম রাখার। প্রয়োজন আছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের। প্রয়োজন জ্ঞানার্জনের। অর্থ উপার্জনের। সম্পর্ক স্থাপনের। আরও কতও কিছুর।
শিল্প হল জঙ্গলের ওই বুনো বাঘ, যার শুধু প্রয়োজন গরম রক্তে আর টাটকা মাংসে। বজ্র শিখায় এক পলকে যে শাদায় কালো মিলিয়ে দিচ্ছে, নোবেল কি কয়েৎবেল দুটোই তার কাছে সমান। তুমি তাকে প্রাইজ দিলে কি দিলে না, তাকে তুমি জানলে কি জানলে না, তাতে বাঘটার কী? মানুষ শিল্প-সাহিত্য দেখে-পড়ে-শোনে বলেই শিল্প তার বশবর্তী নয়। জঙ্গলে বা চিড়িয়াখানায় টিকিট কেটে মানুষ বাঘ দেখতে যায় বলে বাঘ কি মানুষের ইচ্ছের তোয়াক্কা করে? সে তো ‘উঠে দাঁড়ানোয় অপরাজিত’।
আমিও স্বীকৃতি তথা পুরস্কারের সঙ্গে বৈর সম্পর্ক রাখি না। তবে, পছন্দ করি নিজভৌমে শিবিরসন্নিবেশ। কারণ, মানুষ নিজ ব্যতিরেকে আর কাউকে নিজ অপেক্ষা মহান বলে স্বীকার করে না। আমিও করি না। অন্তত জ্ঞানত। অন্য কাউকে আমাকে পুরস্কৃত করার বা স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারটিকে আমি এই চোখে দেখি যে, আমার ব্লাড কিম্বা স্টুল স্যাম্পল আমি ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছি। এবার তারা সেসব শুঁকে, চেটে আমায় পুরস্কৃত করবেন। এ হয় না। লেখা, একজাতীয় বিষ নির্গতকরণ প্রক্রিয়া। বের না করলে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে। লেখা, একজাতীয় অন্ধকার নির্গতকরণ প্রক্রিয়া। যা কোথাও আলোর অস্তিত্ব স্বীকার করে।
ছেলেবেলা থেকে পুরস্কার আমি নিজেকে নিজে দিয়ে থাকি। সে অধিকার আমি নিজেকেই নিজে সসম্মানে অর্পণ করেছি। ‘মরণ অন্তরালে’ উপন্যাসটা লেখার পর যেমন ঠিক করেছিলাম নিজেকে পুরস্কার দেব। দিন পাঁচেক কাটিয়ে এলাম বন্ধু সংসর্গে ও প্রেমিকা সান্নিধ্যে। পুরস্কারের প্রয়োজন মানবজীবনে আমি স্বীকার করি। এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিস। কিন্তু মুশকিল হল কী পুরস্কার আমি চাইছি, কখন চাইছি, তা অন্য কারুর পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। মাঝরাতে হস্তমৈথুনের পুরস্কারটি কে বা কোন প্রতিষ্ঠান বাড়ি বয়ে এসে দিয়ে যাবে বলুন।
যেকোনও স্বীকৃতি এবং পুরস্কার দেওয়ার মধ্যে যে পলিটিক্স থাকে, যে পাটিগণিত ও আগু-পিছু হিসেব থাকে তার থেকে বহুদূরে বসেও আঁচ পাওয়া যায় ক্ষমতাকেন্দ্রের আগ্রাসী-রাজনীতিটাকে। ক্ষমতা হল সেই বিস্তৃত হাতরূপী জিভ যা নিজের কেন্দ্রের সঙ্গে আরও শাখাজিভ বানিয়ে নেয়। ফলে, যেকোনও কারুর যেকোনও পুরস্কারকে আমি সেই পলিটিক্সের ঊর্ণজালের ট্র্যাপেই দেখব। পুরো ব্যবস্থাটা যেখানে কয়েকশো বা হাজার-দেড়েক পাঠকের একজন লেখককেও ব্যবস্থার দড়ি টানা শক্তির নীচে নিয়ে আসতে চায়। যাঁরা ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’র রায়বাহাদুরের মতো তাঁর খেতাবের জন্য নুনদাতার গুণ গেয়ে যাবেন।


2 comments:

  1. আজ সকালেই "ডি মেজর" বইটা পড়ে শেষ করেছি। তারপরই তুমি এই লেখা পাঠালে। মন্তব্য করার মত কোনো শব্দ আমি লিখতে পারিনা "ভালো লাগা" এবং চুপ করে কিছুক্ষণ লেখাটির দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...