খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ সৌমেন চট্টোপাধ্যায়






রিক্ততার স্বীকৃতি



Once Upon a time and a very good time it was…

He turned to the flyleaf of the geography and read what he had written
There: himself, his name and where he was.
Stephen Dedalus
Class of Elements
Clongowes Wood  College
Sallins
Country  Kildare
Ireland
Europe
The World
The Universe

এই বিশাল ব্রহ্মান্ডের মধ্যে আমরা ক্ষুদ্র জীব মাত্র। অতি নগন্য, ক্ষুদ্র আর একেবারেই তুচ্ছ। খোলা মাঠের মধ্যে শুয়ে আকাশ দেখলে নিজেদের ক্ষুদ্রতার পরিচয় ক্রমশ প্রকাশ পায়।  বহু আলোকবর্ষ দূরে যে নক্ষত্রপুঞ্জ আছে তার মধ্যেও হয়তো আমাদের সৌরমন্ডলের মতই কোনও পৃথিবী লুকিয়ে আছে যেখানে প্রাণ আছে প্রাচুর্য আছে অথচ আমরা তার খোঁজ পাইনি বা আমাদের খোঁজ তারা পায়নি।  একক মানুষ হিসেবে এই পৃথিবীর সার্বিক জন সংখ্যার নিরিখে একেক জন যে কত ক্ষুদ্র তা একটা বিশাল জমায়েতের ছবি দেখলেই বোঝা যায়। এইমাত্র যে পিঁপড়েটা আমাদের কারোর পায়ের তলায় চাপা পড়ে মারা গেল তার অস্তিত্ব যেমন একেবারেই তুচ্ছ তেমনই বিপুল জন সংখ্যার এই পৃথিবী নামের গ্রহে একজন মানুষ নেহাতই একটা সংখ্যা। তার চারিপাশের বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় পরিজনদের কাছে তার যেটুকু অস্তিত্ব সেইটুকুই তার ব্যপ্তি। এর বেশি কিছু নয়। মরে যাওয়ার পর কেবল সামান্য কয়েক জনের কাছে তার স্মৃতিটুকু থাকে আর বাকিদের কাছে নেহাতই আমজনতা। আছে তো আছে নেই মানে নেই । কা তব কান্তা কস্তে পুত্র... ঠিক তেমনই এই বিশাল শূন্যে যে সৌরমন্ডল পাক খাচ্ছে তার অস্তিত্বই বা কতটুকু? কিছুই না। তবুও আমরা লড়াই করছি। পৃথিবী নিয়ম মেনে ঘুরে চলেছে , আমরা ঘুম থেকে উঠছি খাচ্ছি মেলে দিচ্ছি নিজেদেরকে।  দিনের শেষে রুটি কাপড়া অউর মকানের ধান্দা মিটে গেলে বসতে ইচ্ছে করে একটা খোলা আকাশের নীচে। নিজেকে মেলে দিতে ইচ্ছে করে এক কোষ থেকে বহু কোষে। দূর আকাশে বহু আলোকবর্ষ দূরে যে নক্ষত্রটি এখনও আলো দিয়ে চলেছে সে কিন্তু মৃত । মরে যাওয়ার দিনে শেষবারের মত বিচ্ছুরিত আলো এখনও পৃথিবীতে এসে পৌঁছায়নি বলেই তাকে আমরা জীবিত দেখছি। এই নিজেকে টিকিয়ে রাখার বিদ্যা ঐ নক্ষত্রটি আয়ত্ত করতে পেরেছে বলেই আজোও সে উজ্জ্বল হয়ে টিকে রয়েছে  আমাদের কাছে। নিজেকে এই টিকিয়ে রাখার বিদ্যা নিজেকে মেলে ধরার কৌশল রপ্ত করার ইচ্ছা প্রত্যেকের মধ্যেই আছে। টিকে থাকার রহস্য সন্ধানে আমরা নিজেদেরকে প্রতিনিয়ত চাবুক মেরে চলেছি। আর শুধু টিকে থাকাই নয় টিকে থাকাকে মর্যাদা দিতে আমরা চেয়ে এসেছি একটুখানি স্বীকৃতির।  সে স্বীকৃতি ব্যক্তির দেওয়া হতে পারে বা প্রতিষ্ঠানের দেওয়াও হতে পারেকিন্তু আমরা আমাদের কাজের স্বীকৃতি চাই, ব্যক্তিগত প্রতিষ্টার স্বীকৃতি চাই। একটা মোহরের ছাপ বা টীকা দরকার পড়ে আমাদের। কিন্তু কেন? কিসের জন্য আমাদের এই স্বীকৃতির আকুতিকবি চান তার লেখার স্বীকৃতি, শিল্পী চান তার আঁকা চিত্রে বা ভাস্কর্যের স্বীকৃতি, প্রেম চায় পরিণতি লাভের স্বীকৃতি। এমনকি একটি শিশুও তার বড় হয়ে ওঠার পরিবেশগত স্বীকৃতি পেতে আগ্রহী হয়।
একেবারে সৃষ্টির গোড়াতে এককোষী প্রাণ কিভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে হতে বহুকোষী প্রাণের জন্ম দিল তা জীববিদ্যার চর্চা হলেও এর মধ্যে একটি ছন্দ আছে। একটি সাবলীল প্রবাহ  আছে।  স্বীকৃতি  পাওয়ার একটি গোপন ইচ্ছে জিন থেকে জিনে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। তাই বিবর্তনের পথে ক্রমশ উন্নততর জীবের আবির্ভাব হয়েছে । আর যে মুহূর্তে উন্নততর জীবের আবির্ভাব হয়েছে ঠিক সেই মুহূর্তেই সে তার অতীতকে ভুলে গেছে বা ভুলতে চেয়েছে। অথচ জীবনের কি অদ্ভুত দর্শন। প্রতিটি জীবকে তার শৈশব দশায় তার পূর্ববর্তী জীবের প্রাপ্ত বয়স্ক দশায় কিছুকাল অবস্থান করতে হয়। নিজেকে মেলে ধরতে গিয়ে যতই আমরা গুটি কেটে উড়ে যাই না কেন আমাদের সেই লার্ভা পিউপা দশার স্তরগুলি অতিক্রম করে তবেই রেশম মথের স্বীকৃতি মেলে। অথচ এই স্বীকৃতির শীর্ষ অবস্থানে থেকে লালায়িত মন যখন আরোও উঁচুতে উঠতে চায় তখনই সে তার অতীতকে ভুলতে শুরু করে যে পথে সে এই স্বীকৃতি পেল তাকে ভুলতে শুরু করে ছোটার নেশায় ক্রমশ হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
স্টিফেন নিজেকে খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছে । ক্রমশ একটার পর একটা জাল কেটে নিজেকে মুক্ত করতে শিখেছে ধীরে ধীরে। নিজেকে দেখতে পাওয়ার এক এপিফ্যানিক মোমেন্টে দাঁড়িয়ে তার মনে হয়েছে এ জীবন তুচ্ছ। তার জীবনের উদ্দেশ্য এত ক্ষুদ্র পার্থিব স্বীকৃতি নয়। জীবন থেকে আরোও অনেক কিছু পাওয়ার আছে । আমরা স্টিফেন হতে পারি না বলেই আমাদের চারিদিকে থাকা জালে আটকে পড়ি ক্রমশ। লোভ ভয় আর টপকে যাওয়ার আমৃত্য প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আমরা অবলীলায় অবহেলা করি আমাদের স্বর্গীয় উদ্দেশ্যকেআমরা কে কেন কিসের জন্য এসব প্রশ্ন করতে  ভুলে গিয়ে ক্রমশ আমি আমার ও একমাত্র এককের স্বীকৃতির সাধনার পাঁকে নিমজ্জিত হয়ে যাই। আর এই একক স্বীকৃতির মোহ আমাদেরকে ক্রমশ স্বৈরাচারী করে তোলে । তখন আর নিজের স্বীকৃতিতে মন খুশি হয় না । অন্যের অস্বীকৃতির খোঁজে , অন্যকে টেনে নামানোর কাজে নিজেকে ব্যপৃত রাখতে মন ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একমেবদ্বিতীয়ম হওয়ার কোহিনুর হিরের সন্ধানে মন শিকারী হয়ে ওঠে । অথচ নিজেকে মেলে ধরে স্বর্গীয় উচ্চতায় পৌঁছালে মনের মধ্যে নির্মোহ আবেগ তৈরি হওয়ার কথা। সুখে বিগতস্পৃহ দুখে অনুকদ্বিগ্নমনা  হওয়ার সাধনাই নিজেকে ব্যপৃত রাখার চেষ্টা কতজন করতে পারে?  উল্টে স্বীকৃতি লাভের নেশা থেকে স্বীকৃতি দানের নেশা তাকে ক্রমশ টেনে নিয়ে চলে ঘুর্নাবর্তের দিকে । প্রথমে প্রতিষ্ঠান বিরোধীতা পরে নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠা  আর স্বীকৃতি দানের শর্টকাট মেথডে নিজেকে মেলে ধরে এক ‘গড লাইক অ্যাপিয়ারেন্স’ তৈরি করে শেষে ভগবানকেই চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় । এই স্যাটানিক থিওরিকেই ক্রমশ আদি অন্ত ধরে এগিয়ে যেতে কখন যে ব্ল্যাক হোলে তলিয়ে যায় তা নিজেই বোঝে না । মাঝখান থেকে কিছু প্রতিভা কিছু নক্ষত্র হারিয়ে যায় এই মোহে পড়ে।

Arise awake or be forever fallen…

নিজের দক্ষতা আর ক্ষমতা না থাকলে কেউ কাউকে টেনে তুলতে পারে না।
অথচ নিজেকে চিনতে পারার সকালে ক্রমশ একটা গোটা আকাশ নেমে আসে উঠোনে। নির্মোহ মন স্বীকৃতির খোলস ত্যাগ করে ক্রমশ রোদে এসে দাঁড়ায়। আকাশে আকাশে তখন শুধু নিজের উপস্থিতি । নিজের ক্ষুদ্রতাকে জয় করতে পারার আনন্দ আর বিশ্বব্রহ্মান্ডের সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করতে পারার গভীর অনুভবী মন তখন  শুধু নিজের কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করার স্বীকৃতিটুকুই  খোঁজে । এমন স্বীকৃতি যা কারোর দয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। যা কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।
নিজেকে চিনে ওঠার স্বীকৃতির দিনে তখন আবার ফিরে যেতে হয় সেই খোলা আকাশের নীচে।
দূরের নক্ষত্রের সঙ্গে তখন নিজের আত্মীয়তা খুঁজে পাওয়ার আনন্দ  চারিদিকে তখন আর কেবলমাত্র একটা নগন্য সংখ্যা নয়। একটা উপস্থিতি। একটা স্পেস দখল করে থাকার থাকার স্বীকৃতি। এমনকি ঐ মৃত নক্ষত্র যেমন নিজের আলোয় এখনও উজ্জ্বল তেমনই এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের মাঝে নিজের স্পেসটুকু অধিকারের স্বীকৃতি এক পরম তৃপ্তির।
এমনকি মৃত্যুর পরেও  একটাই মন্ত্র তখনও জাগরুক থাকে হৃদয়ে...
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে...

Away! Away!
The spell of arms and voices: the white arms of roads, their promise of close embraces and the black arms of tall ships that stands against the moon, their tale of distant nations. They are held out to say: We are alone-come. And the voices say with them: We are your kinsmen. And the air is thick with their company as they all to me, their kinsman, making ready to go, shaking the wings of their exultant and terrible youth.
( A  Portrait of the Artist as a Young Man)


বিশু।                                ফাগুলাল, নন্দিনী কোথায়?

…………………………………………….
ফাগুলাল।  সে গেছে সকলের আগে এগিয়ে।
বিশু।         কোথায়?
ফাগুলাল।  শেষ মুক্তিতে।–
……………………………………………..

ফাগুলাল। নন্দিনীর জয়!
বিশু।         নন্দিনীর জয়!
ফাগুলাল। আর, ঐ দেখো , ধুলায় লুটচ্ছে তার রক্তকরবীর কঙ্কন। ডান হাত থেকে কখন খসে পড়েছে। তার  হাতখানি আজ সে রিক্ত করে দিয়ে চলে গেল।
বিশু।         তাকে বলেছিলুম, তার হাত থেকে কিছু নেব না। এই নিতে হল, তার শেষ দান।




No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...