স্বীকৃতির কণ্ঠরোধ, কণ্ঠরোধের স্বীকৃতি
“To go wrong in one's own way is better than to go right in someone else's.”
- Fyodor Dostoevsky/ Crime and Punishment
অভিজ্ঞতা
সবাই জানে আমাকে পুরস্কার পাইয়ে দিয়েছেন দুই
দাদা। শুধু আমি জানি না।
তবে আমার না জানাটা গৌণ। কারণ বাজারহীন, তীব্র বিরোধাভাসাক্রান্ত শব্দ ‘বাংলাবাজারে’ কান পাতলেই সে কথা শোনা যায়। এই ব্যাপারে
অনেকেই একমত।
আরেকটা অভিযোগও চলে পাশাপাশি। আমি আমার
পুরস্কার নিয়ে খুব মাতামাতি করি। আত্মপ্রচার করি। লেখকের আত্মপ্রচার করাটা অন্যায়।
তাছাড়া পুরস্কারগুলো এমন কিছু বড় পুরস্কারও নয়। আমি সেগুলো নিয়ে এত ফলাও করে
প্রচার করি কেন?
এসআরএফটিআই-তে আমার শর্টফিল্মটা দেখানো
হয়েছিল। ওই ফিল্ম ইন্সটিটিউটের এক ছাত্র প্রথমে ছবিটার ও তার নির্দেশক হিসেবে আমায়
পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় বলেছিল, নির্দেশক সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কার
পেয়েছেন।
সামনের সারিতে বসা এক বয়স্ক লেখক আপত্তি
করলেন। না, ওটা সাহিত্য
অকাদেমি নয়। ওটা যুব সাহিত্য অকাদেমি। তাঁর জোর গলায় ঘোষণার প্রবল কনফিডেন্সে
ছাত্র-ঘোষকটা একটু ঘাবড়ে গেল। নিজেকে ঠিক প্রমাণ করার মরিয়া চেষ্টায় সে বলে উঠল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, যুব সাহিত্য অকাদেমি।
অথচ ভারতবর্ষে কোনও যুব সাহিত্য অকাদেমি নেই।
সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কার আছে। পঁয়ত্রিশ অনূর্ধ্ব লেখকদের সেটা দেওয়া হয়। কিন্তু যুব সাহিত্য
অকাদেমি শব্দটা এত জোর দিয়ে বললেন কেন ওই লেখক? এটা কি শুধুই তাঁর অশিক্ষার প্রকাশ? না, আসলে তিনি সাহিত্য অকাদেমির থেকে পুরস্কারটা
বিযুক্ত করতে চাইছিলেন। পুরস্কারের ধার ও ভার কমাতে।
অথচ পুরস্কারটার ধার ও ভার যাই হোক, সেটা সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কারের সঙ্গে
তুলনীয় হোক বা না হোক, তাঁর নাম
সাহিত্য অকাদেমি যুব পুরস্কারই।
এই পুরস্কার নিয়ে এই ধরনের একটা মত প্রচার
করেন লেখকদের অনেকেই। ওটা তো সাহিত্য অকাদেমি নয়। ওটা বাচ্চাদের উৎসাহ দিতে দেওয়া
হয়। প্রথমে যে দু’জন দাদা লেখকের কথা বলেছিলাম, তাঁদের একজন আমার ফোন তোলেন না আর।
শুনতে পাই, তিনি আমার ওপর খুব বিরক্ত।
কিন্তু অনেক ভেবেও আজ অবধি আমি বুঝতে পারিনি আমার দোষটা ঠিক কী?
এর কিছুদিন পর আরেকটা পুরস্কার পেলাম আমি।
বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ইলা চন্দ স্মৃতি পুরস্কার। এইবার এক পরিচিত জন ফেসবুকে
স্টেটাস দিয়ে বসলেন, ‘কী সুসময়, লেখকের বইয়ের সংখ্যার থেকে পুরস্কারের সংখ্যা
বেশি। এসো সুসময় এসো।’ বুঝলাম আমাকে
খোঁচা মারতে চেয়েছেন তিনি।
পুরস্কার পাওয়ার প্রায় মাস ছয়েক পরে এক অগ্রজ
কথা সাহিত্যিক ফোনে বললেন, তোর দোষ আছে।
তুই ফেসবুকে লাফিয়েছিস কেন?একটা পুরস্কার তো উৎসাহ দিতে দেওয়া হয়।
আরেকটাতে তো মোটে দু’হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ওটা কি আদৌ কোনও
পুরস্কার?
বক্তব্য
আমি চুপ করে গেলাম। আমি কোথাও বলিনি আমি
সাহিত্য অকাদেমি পেয়েছি। কিন্তু দীর্ঘ চার বছর চাকরিবাকরি ছেড়ে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে তুলে, ইতালিয়ান লেদারের (আমি খুব আত্মপ্রচারের সুরেই বলছি, সেই জুতো কেনার সাধ্য আমার চাকরি জীবনে
ছিল) ছেঁড়া জুতো সেলোটেপ দিয়ে জুড়ে পরে পরে, গুষ্টিসুদ্ধু লোককে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার
নির্বুদ্ধিতার প্রমাণ দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে দু’দুটো পুরস্কার পেয়ে আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।
পুরস্কার পেলে কে না খুশি হয়? তাও বাজারহীন বাংলা বাজারে যেখানে লেখালেখিটা
শুধুই অর্থহীন ব্যক্তিগত সময় অপচয় করার শখে পর্যবসিত।
আচ্ছা এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি যদি নিজের
পুরস্কার প্রাপ্তি নিয়ে আত্মপ্রচারের জয়ঢাক বাজাই, তাহলে কী-ই বা হয়? বই বিক্রি হতে পারে। কিন্তু তাতে আমার বিশেষ
লাভ নেই। কারণ বইয়ের রয়্যালটি বাবদ টাকা পাওয়ার তো কোনও কথাও ছিল না। আমি
তো নেহাতই শখ মেটাতে নিজের পয়সায় একটা বই করতে চেয়েছিলাম। প্রবল অর্থাভাবের মধ্যেও
ধারকর্জ করে। তবে হ্যাঁ, আমার প্রকাশক বইটা বিক্রির
প্রবল চেষ্টা করেছেন। নিজের পয়সায় বিজ্ঞাপন দিয়েছেন।
কেন? না আবার অর্থনৈতিক ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে গেলে, যদি বিদেশে কোনও ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাই, বা ভারতীয় কোনও নামি এমবিএ ইন্সটিটিউটে, তাহলে একটা পাব্লিশড বই, আমাকে কিছুটা সাহায্য করতে পারে।
পুরস্কার তার থেকেও বেশি কিছু পারে।
স্কলারশিপ হয়ত। পুরস্কার প্রাপ্তিতে আমার আনন্দ হবে না তো কার আনন্দ হবে?
বিশ্লেষণ
কোনও বড় কমার্শিয়াল পত্রিকায় বইটার আলোচনা
হয়নি আজ অবধি। তবু শত্তুরের মুখে ছাই দিয়ে বইটা বেশ বিক্রি হয়। দ্বিতীয় সংস্করণ অবশ্য প্রকাশক নিজেই
ছাপিয়েছেন।
তাহলে হঠাৎ বইয়ের বা গল্পের মান নিয়ে আলোচনা
না করে শুধু পুরস্কার ধরে ধরে আমাকে আক্রমণ, বোঝানো, আলোচনা, পর্যালোচনা,গসিপ হল কেন?
কারণ পুরস্কারকে সবাই প্রবল স্বীকৃতি দেয়।
সবাই। সেটা আমি বেশ বুঝে গেলাম। দেখুন পুরস্কার ব্যাপারটা যদি দাদা ধরেই পাওয়া যেত,কিংবা পুরস্কারের আসলে তেমন মূল্য না থাকত, তাহলে কিন্তু আমার পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া
নিয়ে, কিংবা সেই
পুরস্কারের গ্রহণযোগ্যতা কিংবা বিবর্জনের অপরিহার্যতা নিয়ে এত কথা আলোচনার কোনও
কারণ থাকত না।
যার কোনও মূল্য নেই, তা আমার হাজারও অর্থনীতিহীন বিজ্ঞাপনেও
মুল্যবান হত না। হতে পারে না।
এর আরও একটা কারণ আছে। বাংলা বাজারের যেটুকু
বাজার, অর্থাৎ বড় কমার্শিয়াল পত্রিকাগুলো, সেখানে লেখালেখির জন্য প্রবল কম্পিটিশন।
সেখানে আমরা সবাই কাঁকড়া। যেমন করেই হোক, যে করেই হোক পা ধরে টেনে নামাতেই হবে। আরও
সহজ করে বলতে গেলে, ছোট মাঠে
নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের সবাইকে ক্যানিবাল হতে হবে। তাই আমরা সবাই সবাইকে
খাচ্ছি গিলছি, চুষছি, কিন্তু ওগরাচ্ছি না।
এই ছোট্ট বাজারে, আমাদের টিকে থাকার প্রবল চেষ্টা, অর্থহীন, সিরিয়াল স্টারের তুলনায় অতিনগন্য খ্যাতির লোভ, আমাদের আসল কাজটার প্রতিই অনাস্থা তৈরি
করেছে। আমরা কেউ মনে করিনা শুধু লিখে, ভালো লিখে আদৌ কিছু হয়। আমরা আসলে ভাবি লিখে
দাঁড়াতে গেলে অন্য অনেককিছু করতে হয়। দাদা ধরা। পাব্লিসিটি। বড় পত্রিকা। পুরস্কার।
আমরা এটাও ভাবি না আসলে এই মূর্তিমান
অর্থনীতিহীন, সামাজিক পরিসরে
মূল্যহীন লেখার কাজটা করে আসলে আদৌ কোথাও দাঁড়ানো যায় না। বাজারটাই এমন যে প্রবল
খ্যাতি পাওয়ার পরও, রয়্যালটি বাবদ
যে টাকাটা পাওয়া যায় তার থেকে মুম্বাই শহরে চুল কেটে বেশি রোজগার করা যায়।
তাছাড়া সাহিত্য আসলে একটা সংখ্যালঘুর শিল্প।
আসলে খুব স্বল্প সংখ্যক মানুষই প্রকৃত সাহিত্যের চর্চা করে থাকেন। ভোক্তা চিরকালই
খুবই কম। পপুলার বলে সম্পূর্ণ অন্য একটা জিনিস হয়, বিদেশের বইবাজারে বলে পপুলার ফিকশন যার কিছুটা হলেও ভোক্তা আছে। সিনেমা,সিরিয়ালের থেকে অনেক কম। তবু সেটা লিখতে পারলে বেশ কিছু
টাকা রোজগার হয়।
আমাদের এইখানে, আমাদের ভাষার যা হাল, তার অর্থনীতির যা হাল, তাতে বই লিখে সেটা সম্ভব নয়।
পরিশেষ
দস্তয়েভস্কির রাসকোলনিকভ নিজের অপরাধ জানত।
সে তাই সেই অপরাধের শাস্তি খুঁজেছিল। এটা হয়ত খুব ক্রিশ্চান একটা ধারণা। যেখানে
অনুশোচনার ক্রুশের ভার বয়ে নিয়ে যেতে হয় অপরাধীকেই।
কাফকার কে নিজের অপরাধ সম্পর্কে জানত না।
কিন্তু তাকে শাস্তি পেতে হয়েছিল। আর শাস্তি পেতে পেতে ক্রমশ সে ভাবতে শুরু করেছিল
উলটো পথে। শাস্তি যখন সে পাচ্ছে, তাহলে নিশ্চয় কিছু অপরাধ সে করেছে। না হলে
শাস্তি সে পাবে কেন?
আসলে অকারণ উদ্ভট শাস্তি পেতে পেতে ব্যাপারটা
এত অসহনীয় হয়ে ওঠে, যে একসময়
শাস্তিপ্রাপ্ত মানুষটা তার সেই শাস্তির ন্যায্যতা নিজেই খুঁজতে থাকে। শাস্তিই
অপরাধ খুঁজে নেয়।
আমিও আসলে এই পুরস্কার নামক স্বীকৃতি বা
অস্বীকৃতির শাস্তির ন্যায্যতা খুঁজতে বসেছি। নিশ্চয় আমারই কিছু ভুল ছিল নইলে
আমাকেই সবাই আক্রমণ করবেন কেন? কিংবা হয়ত সত্যিই আমি দাদা ধরেছিলাম। লবি
করেছিলাম। এখন আমার আর মনে পড়ছে না।
কিংবা হয়ত আসলে বই করার অন্য উদ্দেশ্য ছিল
আমার। আমি নিজেই সেটা আর স্বীকার করিনা।
এইসব ভাবতে ভাবতেই দিন কেটে যায় আমার। আগে
যাঁদের সঙ্গে বেশ পরিচয় ছিল, তাঁদের দেখলে অন্যদিকে ঘুরে যাই। মাঝখান থেকে
যে কণ্ঠটি হয়ত আমি নিজের লেখায় তৈরি করতে চেয়েছি সেটাই বন্ধ হয়ে গেল। ‘স্বীকৃতি’ হয়ত আসলে ‘কণ্ঠরোধ’এর নাম। ‘কণ্ঠরোধ’ই হয়ত‘স্বীকৃতি’র মূল।
চাবুক লেখা। খুব ভালো। আন্তরিক আর সৎ বলেই।
ReplyDeleteলেখাটা বেশ। কিন্তু এই লেখকের কাছ থেকে গল্প চাইছি। বিশ্বাস করছি, এগুলো সেই এখনও না-লেখা গল্পগুলির প্রস্তুতিপর্ব।
ReplyDeleteএসব ব্যাপার না, শমীক দা। তোমার দ্বিতীয় বইটির অপেক্ষায় আছি। কখনো কলকাতা এলে নিশ্চয়ই দেখা হবে। ভালবাসা জেনো।
ReplyDeleteশেষের লাইনদুটো পড়ে বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে -- কী ভয়ঙ্কর,ধ্রুব সমাজবাস্তব ! আহা এসব কথা যদি সব ভ্রান্ত হতো ,তবে বেশ হতো !
ReplyDeleteলেখাটা ভাবায় ,সেই ভাবনা আরও অতল থেকে অতলতর নিরাশার দিকে ঠেলে দেয় । মনখোলা,সুন্দর লেখা ।