খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

9.7.18

বিষয় স্বীকৃতি ও কণ্ঠরোধ - কুন্তল মুখোপাধ্যায়




ক্রোড়পত্র



              কোথাও স্বীকৃতি নেই , শুধু এক সামন্তের উল্লাস রয়েছে


এক নম্বর
প্রায়ান্ধকার এক মফসসল থেকে আমরা কয়েকজন বোকা ঠিক করেছিলাম কবিতার একটা কাগজ করব। ঠিক হল অগ্রজদের আর তরুণদের লেখা ছাপা হবে , যেমনটা হয় সব ছোটো কাগজেই । দুয়েকটা সংখ্যা পরে একজন অগ্রজকে ফোন করে লেখা চাইতেই তিনি প্রায় বিরক্তির সুরে বললেন , কেন পত্রিকা করছ তোমরা ? প্রতিষ্ঠিত আর খ্যাতনামা কবিদের বৃত্তে ঢুকে পড়ার জন্য ? আমি হাঁ হাঁ করে উঠতেই তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন , আসলে ছোটো পত্রিকা করার উদ্দেশ্য এটাই হয় । প্রথম কাগজ করা , তারপর প্রতিষ্ঠিত বৃত্তের মধ্যে নিজেদের পরিচিত করে নেওয়া । তারপর কাগজ বন্ধ । কেননা সম্পাদকের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে ।   

দুই নম্বর
বিখ্যাত এক কবিকে মফসসলের আমাদের এক অগ্রজ একটি বই উৎসর্গ করেছিলেন । তখন বইমেলা হতো ময়দানে । তো সেই বিখ্যাত কবিকে হঠাৎ দেখতে পেলেন আমাদের  দাদা ।তিনি বিশাল এক ভক্তদের দলে রয়েছেন তখন । আমাদের দাদা তাঁর দিকে সাগ্রহে এগিয়ে গেলেন । গিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা বললেন আর সঙ্গে বললেন যে তাঁর লেখা খুব ভালো লাগে , সেই বিস্ময়ের কথাও । কবি তখন হেবি ব্যস্ত । ভক্ত ও নিজের ক্যারিশমা সামলাতে সামলাতে নাজেহাল । এবং একটু গরমও লাগছে সেই দুপুরে । দাদা দেখালেন যে তাঁর প্রথম বইটি ওই কবিকেই উৎসর্গ করা । কবি দেখে তাকালেন একবার । দাদা দাঁড়িয়ে । তারপর বইটি নিয়ে হাওয়া করতে শুরু করলেন । যা গরম !

তিন নম্বর
তিনি সত্তরের কবি । তিনি যতই মাইনর পোয়েট হোন না , অহংকার তো থাকবেই তাঁর । যাকে তাকে তো আর বাড়ির ভিতরে আসতে বলা যায় না । তাই সিঁড়ির উপর থেকে দাঁড়িয়ে কথা বলেন । সিঁড়ির নীচে দাঁড়িয়ে থাকেন ম্লান এক সম্পাদক । দিনের পর দিন । একটি অনুষ্ঠান বাতিল হয়ে গেছে সেই খবর দিতে গেছিলেন সেই সম্পাদক । তো সত্তরের সেই বিপ্লবী কবি  উপর থেকে প্রায় থুতু ছুঁড়ে বেড়িয়ে যেতে বলেন আর কী । সঙ্গে এও জানিয়ে দেন যে , ছোটোখাটো মফফসলি কারবার তিনি করেন না । কলকাতায় তাঁর অনেক বন্ধু । কলকাতা থাকলেই হবে তাঁর ।তিনি সত্তরের মাইনর পোয়েট ।

চার নম্বর
কবিতা পাক্ষিক পত্রিকায় ছাপা হয়েছে একটি তরুণ কবির লেখা । ডাকে পাঠানোর চল ছিল তখন ।  দুই বন্ধুর তাই নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত আলোড়ন । তারা দুজনেই কবিতা চর্চা করে । বন্ধুর কবিতা আগেই ছাপা হয়েছে ।এবারে তার । শহরের এক গল্পকার এই দুই বন্ধুকে স্নেহ করেন , ভালবাসেন । তিনি সময় দিলে দুই বন্ধু যায় তাঁর বৈঠকখানায়, সাহিত্যচর্চায় সময় কাটে চমৎকার । কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা তার কবিতা ছেপেছে এই কথা জানাতেই সেই গল্পকার সাগ্রহে নেন কাগজটি । পড়েন । কিন্তু একি ! এ তো মারাত্মক ভুল ! ব-য়ে শূন্য র যেখানে হবে সেখানে ড-এ শূন্য ড় ! সম্পাদকীয় দপ্তরের কোনও যোগ্যতাই নেই , বলেন তিনি ।এও বলেন যে কবিতাটা নিয়ে তাঁর কোনও অসুবিধা নেই , কিন্তু একি !এই সম্পাদকীয় দপ্তর ! এদের তো যোগ্যতাই নেই কোনও ! তাহলে কি লেখাটার সম্মন্ধেও একই কথা ? কিন্তু কলকাতার পত্রিকায় এ যে তার প্রথম লেখা ! 

পাঁচ নম্বর
শহরের কলেজের প্রিন্সিপল । থাকেন কলেজ ক্যাম্পাসের আবাসনেই । যুবকটি ভর্তি হবে কলকাতার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে । বিশ্ববিদ্যালয়ের ভরতির ফর্ম ফিলাপ করতে গিয়ে সে দেখে সেখানে তার পড়া শেষ প্রতিষ্ঠানের প্রধান-কে সই করতে হবে । সেদিন সে আর তার এক বন্ধু কলকাতা থেকে ফিরে আসবে ঠিক করে । সই করিয়ে আবার পরের দিন ভোরবেলায় ট্রেন ধরে চলে যাবে ভর্তি হতে । পরদিনই ভর্তি হবার শেষ তারিখ । তার বন্ধুর সঙ্গে প্রিন্সিপ্যালের পরিচয় আছে , সেদিন সই করানো কোনও চাপের ব্যাপার নয় তার কাছে ।যুবকটির তো তেমন পরিচয় নেই তাঁর সাথে । তাই রাত্রিবেলা ট্রেন থেকে নেমে সোজা এসে যায় প্রিন্সিপ্যালের বাড়ি । ওঁর খুব নাম শহরে । খুব নিয়মনিষ্ঠ মানুষ । রাত্রি দশটায় কী একটা কাজে বাইরে গেছেন । তাঁর বাড়িতে ছেলেটি অনুরোধ করেছে , বলেছে এটা খুবই জরুরী । প্রিন্সিপ্যালের বাড়ির লোক তাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন । সেও অপেক্ষা করছে , বড়িতে নয় । তাকে বলা হয়েছে একটু দূরে অপেক্ষা করতে । অন্ধকারে ।সাড়ে দশটায় তিনি এলেন । বারান্দায় বসে যখন জুতো খুলছেন , সেই সময়  প্রিন্সিপ্যালের গৃহিণী বিষয়টা আদ্যপান্ত বললেন । প্রিন্সিপ্যাল তখন জিজ্ঞেস করলেন , ভালো বাড়ির ছেলে ?



ছয় নম্বর    
রাজ্য যুব উৎসব । আমাকেও গান গাইতে হবে সেখানে । সময় দেওয়া হয়েছে পাঁচ মিনিট । সেখানে প্রথিতযশা শিল্পীরা গাইবেন । আমার  গান , যতদূর মনে পড়ে প্রথমেই ছিল । পরে অনেকেই গাইবেন । আমার গান পুরাতনী গান । প্রথমটা শুরু করার পর দর্শকেরা উৎসাহ দিলেন , তখন তবলায় যিনি ছিলেন তিনি বললেন আর একটা গাও । বললাম , কিন্তু পাঁচ মিনিট তো হয়ে গেছে । ওঠার উপক্রম করতেই দর্শকেরা চেপে ধরল । আর একটা গান শুনতে চান ওঁরা । মাইকে তাই বললাম , এটাই শেষ গান । শুরু করতে যাবো , ঠিক তখনই সুন্দরী এনাউন্সার এর প্রবেশ । তিনি প্রায় আমাকে উপেক্ষা করেই ঘোষণা করলেন , শিল্পীর অনুষ্ঠান শেষ । আমাদের আরও অনুষ্ঠান বাকি আছে । পরের শিল্পী ...। ব্যাকস্টেজে এসে , এনাউন্সার বললেন আসলে জানিস তো আমার কিছু করার ছিল না । আজ যিনি এই অনুষ্ঠান পরিচালনার দ্বায়িত্বে আছেন  তিনি তোকে নামিয়ে দিতে বললেন তাই ...... কী করবো বল । সেই মাতব্বরটি আমার দিকে পিঠ ঘুরিয়ে বসে আছেন । আজও , খুব চেনা বৃত্তে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় আমার । তিনি জিজ্ঞেস করেন , ভালো আছিস ?   

সাত নম্বর
কবিতা পত্রিকা করেন । পুরোদস্তুর সম্পাদক । তাঁর পত্রিকা ভালো কাজ করছে । তাই আমাদের এক অগ্রজ তাঁর কাগজে পাঠিয়ে দিলেন লেখা । সঙ্গে একটা রিপ্লাই পোস্টকার্ড । এতে সম্পাদকের জানিয়ে দেওয়া সুবিধা হয় লেখাটা নির্বাচিত হল কীনা । দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার পর মফসসলের সেই অগ্রজ পেলেন তাঁর রিপ্লাই লেটার । সেখানে সম্পাদকমশাই তাঁকে লিখেছেন যে কবিতা লিখতে জানতে হয় । শিখতে হয় । আর কী করে লিখতে হয় তার একটা রূপরেখাও দিয়েছেন তিনি !    

আট নম্বর
একদিন একটা বলিউডি গ্রুপ ডান্স দেখতে দেখতে শ্যামল-দা বলল , ওই যে দেখছিস নায়কের পিছনে নাচছে অসংখ্য নর্তক । ওরাই আসলে আমরা । মাইনর পোয়েটস । নাচ জানতাম না তা নয় ।কিন্তু একটু ভালো করে লক্ষ্য করে দেখবি  এঁরা কিন্তু অনেক নায়কের চেয়ে দক্ষ । কিন্তু ওদের ওইভাবেই নাচতে হবে দিনের পর দিন । একই রকম পোশাকে । কারণ পরিচালকেরা ওইভাবেই ওদের দেখেন । সংবাদপত্রেরা ওভাবেই দেখতে চায় । আসলে নায়ক হতে গেলে তো অভিনয় জানতে হয় । কেউ কেউ সেটা পারেন ! 

নয় নম্বর
গ্রামের একটা ইস্কুল । সেখানে হেঁটে যেতে হয় তিন কিলোমিটার । আমাদের গ্রামের নাম পাতাডাঙ্গা । সেই গ্রাম থেকে গ্রীষ্মে যখন সকালের ইস্কুল হয়  , আমরা সবাই হেঁটে যাই । নদী পেড়িয়ে মাঠ পেড়িয়ে লতাপাতা দীঘি জঙ্গল পেড়িয়ে । ফিরে আসার সময় টমেটো খাই । মাঠের । আখের খেত দেখি । আখগাছ মানুষের মতো লাগে । দুই পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে আছে । ঠায় । আখ ভাঙায় পারঙ্গম ছিল দাদারা । আর তাড়াও ছিল , ছিল মার । আগুলদারের ।তো , ইস্কুলে , একবার সকালবেলার ক্লাসের বিরতি । তখন আমার দাদার এক বন্ধু আমার কাছে এলো । এসে বললো , ননসেন্স । তুই ননসেন্স । আমি  বিহ্বল । খারাপ লাগলো । সেদিন থেকে ওর এই খেলাটা শুরু হল । প্রায় প্রতিদিনই আমাকে টিফিনের সময় বাড়ি যাওয়ার আগে আর  স্কুল শুরু হবার সময় এসে বলে যেত - ননসেন্স । দাদার বন্ধু ছিল পড়াশোনায় খুব ব্রাইট । কিছু বলতে পারতাম না । শুধু শুনে যেতাম । আর অরুন-দা র মুখ দেখলেই খুব ভয় লাগতো আমার । আর ঠিক প্রতিদিন সেই মুহূর্ত । সেই ক্ষণ । ননসেন্স । বহুদিন চলছিল , এমন সময়ে আমাদের বাড়িতে এল আমাদের মামা । বাচ্চাদের খুব একটা পাত্তাটাত্তা দিতেন না । আমাকে একটু মনমরা দেখে মামা বললো , কী রে কি ব্যাপার ? আমি তখন খুলে বললাম সব ব্যাপারটা । মামা বলল , শোন এবারে যখন বলবে , তুই ওকে বলবি বাস্টার্ড । ব্লাডি বাস্টার্ড । পরের দিন স্কুল গেলাম । অরুন দা এগিয়ে গিয়ে যেই বলল ননসেন্স , আমিও বললাম মামার শিখিয়ে দেওয়া কথাটা । সেই শেষ । আর কখনও অরুনদা বলতো না কথাটা ।কিন্তু আমিও প্রবেশ করলাম এক অন্য জগতে । যেখানে এক অস্বীকৃতি অন্য এক অস্বীকৃতি দিয়ে ফিরিয়ে দিতে হয় । 

দশ নম্বর
এটাই শেষ । আমার এক বন্ধু । ভারি উপকার করেছিল আমার । পোস্ট গ্র্যাজুয়েশনে ভর্তি হয়েছিলাম প্রায় তারই তৎপরতায় । তারপর চাকরি । সেও অনেক দূরে আমিও । কিন্তু দেখা হলেই সে কখনও মনে করিয়ে দিতে ভুলত না । মনে আছে তো ? কী করেছিলাম আমি ! মনে আছে তো ? কিন্তু আমি যা বলিনি সেটা হল যেকোনো জায়গায় যেখানে আমি আর ও যেতাম , সেখানে আমাকে অপমান করাই ওর যেন এক অদ্ভুত অধিকার হয়ে দাঁড়ায় ! যেভাবে হোক । খারাপ কথা বলে নয় । কিন্তু ছাত্রজীবনের কিছু দিক যা আমার কাছে লজ্জার , আতঙ্কের , কষ্টের তাকে মুচমুচে করে সবার কাছে পরিবেশন করা । এমন অসাধারন বন্ধুর অস্বীকৃতি যে পেয়েছে সে জানে আতঙ্ক কাকে বলে । কারণ এমন মানুষদের সামনে তার আর ডিফেন্স মেকানিজম বলে কিছুই থাকে না । আড়ালে যে বলে দেয় , মনে আছে তো বন্ধু ? সে আমাকে শুধু কবিতা লেখার জন্য ঘরভরতি ছেলেমেয়ের কাছে হাস্যাস্পদ করে তুলবে , বন্ধুদের আড্ডায় সে আমার অপমানের ঘটনা বলে লোক হাসাবে , আমাকে নিয়ে সে তৈরি করবে ব্যাঙ্গ কবিতা , পরবর্তীকালে সে গেট-টুগেদার-এ ,কলেজে আংশিক সত্য পরিবেশন করবে । সবাই হাসবে । আর এতসব করে সে বলবে , মনে আছে তো , বন্ধু ? ঠিক মনে আছে তো ! সে আমার জলজ্যান্ত অপমান । সে আমার বহুদিনের অস্বীকৃতি । সে যার বন্ধু তার আর চিন্তা কী ?


দশ নম্বর জার্সি পড়ে সে আমার রক্ষণ  বারবার চূর্ণ করে যায় । কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য লিখেছিলেন পরাজিত মানুষ খুব সুন্দর হয় । পরাজিত মানুষ । তার অস্বীকৃতি , তার অন্ধকার । তার অসততা সব সুন্দর ।   


6 comments:

  1. অসাধারণ দাদা! লেখাটা থেকে যাবে।

    ReplyDelete
  2. বিচিত্র রকম অভিজ্ঞতা হল আপনার লেখা পড়ে। ধন্যবাদ এমন অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করার জন্য।

    ReplyDelete
  3. ভালোবাসা। দাদা,ভালোবাসা। আর কিছু লেখার যোগ্যতা নেই।

    ReplyDelete
  4. কী যে বলো ভাই সোমনাথ । ভালো থেকো ।

    ReplyDelete

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...