খুঁজুন। ক্লিক করুন। টাইপ করুন।

8.7.18

ধারাবাহিক- চন্দন ঘোষ




চিকিৎ-"শকিং" ডায়রিঃ রাজনীতির ক্রান্তিকালে বন্ধুত্বঃপর্ব-২

(নার্সারিতে একটি সিক রিপোর্টের বদলে ডেথ রিপোর্ট বেরিয়ে গেছে। ভুলটা করেছে তিমির। আজকাল পত্রিকায় ফলাও করে রিপোর্ট হয়েছে। সেটা ৮৩র জুনিয়ার ডাক্তার আন্দোলনের সময়। তিমির এস এফ আই করে। সরকারপক্ষ। সৌম্য ডি এস এ। আন্দোলনকারী। দুইজন অন্তরঙ্গ বন্ধু। যে কেউ ফেঁসে যেতে পারে এই কেসে...)

প্রফেসর বাগচীর সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে দুই বন্ধু। সৌম্য আর তিমির। বাগচী সাহেব ওদের ভগবান। বলছেন, ভয় পাচ্ছ কেন তোমরা। বাচ্চাটা তো আর মরেনি। তোমরাই লড়াই করে ওকে বাঁচিয়েছ। আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ টু। কাজ করতে গেলে ভুল হয় একটু আধটু। পেশেন্ট পার্টি হুজুগের বশে খবরের কাগজকে  জানিয়ে ফেলেছে। একবার তো তোমাদের এক সিনিয়ার দিদি বুঝতে না পেরে ডেথ সার্টিফিকেট ইস্যু করে ফেলেছিল, তারপর শ্মশানে যাবার পথে বাচ্চা বেঁচে ওঠে। এ কেস অফ সাস্পেন্ডেড অ্যানিমেশন। নিউবর্নের হয় অনেক সময়। সে ঝামেলাও তো সামলেছি। এখন চল, সীমার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। কী ভাবে মেটানো যায় ব্যাপারটা। ডাঃ সীমা রায় হলেন হ্যসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট। ডাঃ বাগচীর এক ব্যাচ জুনিয়র। বাগচী সাহেবকে খুব রেসপেক্ট করেন।

ইতিমধ্যে ব্যাপারটা হাসপাতালে চাউর হয়ে গেছে। তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। দুই  রাজনৈতিক দলেরই নেতারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। দুই দলই ব্যাপারটা ক্যাশ করতে চায়। বাগচী সাহেবের সঙ্গে ডাঃ রায়ের চেম্বারে যেতেই হল ওদের। খানিকটা এনকোয়ারি কমিটির মতো ব্যাপার। সীমা ম্যাডাম সব শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন। বললেন, ডঃ বাগচী, রাইটার্স থেকে চাপ আসছে। খবরের কাগজ ব্যাপারটা নিয়ে জলঘোলা করতে ছাড়বে না। একটা রিপোর্ট তো পাঠাতেই হবে। তারপর তিমিরের দিকে ঘুরে বললেন, তোমাকে তো বাবা একটা লিখিত রিপোর্ট দিতেই হবে, সইটা যখন তোমার। তারপর সৌম্যর দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমাকেও একটা রিপোর্ট লিখতে হবে। কারণ তুমিও ছিলে ওখানে। ওরা দুজনেই ঘাড় গুঁজে 'হ্যাঁ' বলে বেরিয়ে এল। 

মন ভালো নেই দুজনেরই। ওরা সোজা নার্সারিতে চলে এল। নার্সারিতে ঢোকার মুখে দেখে একজন বুড়োমানুষ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। ওদের দেখে মানুষটা হাউমাউ করে উঠল। চোখে তার জল। বলে, ডাক্তারবাবু আমাদের ক্ষমা করে দ্যান। আমার ছেলেটা অন্যায় করে ফেলেছে। আপনারা এত লড়াই করে আমার নাতিটারে বাঁচালেন আর আমরা কী যে অন্যায় করেছি আপনাদের সঙ্গে। ভুল তো মানুষেরই হয়। সেদিন রাত্তিরে আমার গোঁয়ার ছেলেটা আমাদের বাড়ির পাশেই আজকাল পত্রিকার অফিসে চলে গিয়ে হইচই ফেলে দিয়েছিল। আমি পই পই করে বারণ করেছিলাম। আমাদের নাতি তো ভালোই আছে। কী হবে খামোখা ডাক্তারদের বদনাম করে? তা কিছুতেই সে শুনল না। মাথায় ভূত ভর করেছিল ওর সেই সময়। এখন দেখুন পস্তাচ্ছে। এই যে আমার ছেলেকে নিয়ে এসেছি। আপনারা শুধু দেখবেন আমার নাতিটার কিছু যেন না হয়ে যায়। ও তো আপনাদের হাতেই আছে। পিছন থেকে বাচ্চার বাবা সামনে আসে। হাত জোড় করে ক্ষমা চায়। বলে, আমি বুঝতে পারিনি ডাক্তারবাবু, যে ব্যাপারটা এতদূর গড়াবে। বাচ্চাটাকে দেখবেন,ডাক্তারবাবু। শুধু এইটুকু প্রার্থনা।ওর যেন কোনো ক্ষতি না হয়। এতদূর শুনে সৌম্যরা তো হতবাক। কী বলবে বুঝে পায় না।

নার্সারিতে ফিরে এসে তিমির বলে, সৌম্য তুই কাইন্ডলি কোনো রিপোর্ট লিখিস না এটা আমার আর্নেস্ট রিকোয়েস্ট। তোর আর আমার বয়ান কিছুতেই মিলবে না। আমি মাঝখান থেকে ফেঁসে যাব। এটা আমার একমাত্র চাওয়া তোর কাছ থেকে। আশা করি, পলিটিক্স এর মধ্যে এসে দাঁড়াবে না। সৌম্য বুঝতে পারল এই কথাগুলো একা ওর নয়। ইডেন রুফ হস্টেলের দাদাদের পরামর্শ। ইডেন রুফে এস এফ আই এর ছেলেরাই বেশি থাকে। সৌম্যর কেমন একটা জেদ চেপে গেল। সে বলল, তোকে আমি কথা দিচ্ছি আমার থেকে তোর কোনো ক্ষতি হবে না। আর আমি রিপোর্টও জমা দিচ্ছি না। এই রিস্কটুকু আমি নিচ্ছি।

সৌম্যর মনে পড়ে গেল, সেদিনের রেজিস্টারের জেরক্স কপি এখনও তার হাতেই আছে। ওটাই তার জিয়নকাঠি। কেউ ওকে ফাঁসাতে পারবে না। খুব প্রয়োজন না হলে ওটা অবশ্য সে ব্যবহার করবে না।

একটু বেলার দিকে সৌম্য কলেজ ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মাঝ রাস্তায় কিশোরের সঙ্গে দেখা। কিশোর ওর দলেরই। অর্থাৎ ডি এস এ। বল্ল, গুরু, হেভি ব্যাপার হয়েছে। একটা ছাপাই( এস এফ আই) জালে পড়েছে। ওর পানিশমেন্ট হতেই হবে। যা, শিগগির যা। সমরদারা তোকে খুঁজছে। তোর স্টেটমেন্ট খুব জরুরী তিমিরকে ফাঁসানোর জন্য। সৌম্যর চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে। তাকে এতটা নীচে নামাতে চায় আজকে তারই দল। এরা সব সৎ বিপ্লবী। সে কোনো কথা বলে না।

ক্যান্টিনের কাছেই সুসীমের সঙ্গে দেখা। সুসীম ওর ক্লাশমেট। আন্দোলনের একজন নেতা। নেতাদের বলয়ের কাছের লোক। সে বলে, এই তো গুরু। চল, ক্যান্টিনে তোকে সবাই খুঁজছে। সমরদারা সব রয়েছে। আজকালের রিপোর্টার রয়েছে। তোকে টুক করে একটা কাজ করে ফেলতে হবে। সৌম্য বলে, কাজ? কী কাজ? সুসীম বলে, চুপচাপ তিমিরের নামটা বলে দিতে হবে রিপোর্টারকে। বললেই কেল্লা ফতে। ওকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। সৌম্য দৃঢ় গলায় বলে, না, আমি বলব না। তিমিরকে আমি কথা দিয়েছি, আমার থেকে ওর কোনো ক্ষতি হবে না। সুসীম বিকৃত গলায় বলে, ও রে হরিশ্চন্দ্র আমার। শালা, ওর নাম না বললে কিন্তু তোর নাম ছাপা হবে। তোর নামটা কিন্তু সবাই জানে। সৌম্য প্রবল ঘৃণায় এক দলা থুতু ফেলে মাটিতে। বলে, গাণ্ডু তুই আমাকে ফাঁসাবি? যা শালা, তোর কোন বাবা আমার কী করতে পারে দেখি। নিজেকে বাঁচাবার অস্ত্র আমার কাছে আছে। আর তোদের মতো বিপ্লবীদের মুখে মুতি আমি। যা ফোট শালা। যা তোর রিপোর্টারকে গিয়ে আমার নামে যা খুশি বল। আমার ছেঁড়া যাবে তাতে। 

সুসীম সৌম্যর এই মূর্তির জন্য তৈরি ছিল না। সে হকচকিয়ে যায়। বলে, ভাই এত রাগ করিস না। তুই তো আমাদেরই লোক। তোকে কি আমরা ফাঁসাতে পারি। এমনি বলছিলাম। ঠিক আছে তোকে ওর নাম বলতে হবে না। সৌম্য বলে, ফোট তো। তোদের আসল চেহারা আমার দেখা হয়ে গেছে। আমি জবান দিয়েছি। ওর নড়চড় হবে না।

ইউনিয়ন রুমের সামনের পলাশ গাছটার নিচে দাঁড়ায় সৌম্য। একটা সিগারেট ধরায়। মাথাটা এখন অনেক হালকা লাগছে। মনে মনে নিজের অক্কলকে ধন্যবাদ দেয় সে। ভাগ্যিস নার্সারির রেজিস্টার খাতাটা সেদিন সূর্য সেন স্ট্রীট থেকে জেরক্স করে নিয়েছিল সে।

(ক্রমশ)

No comments:

Post a Comment

একঝলকে

সম্পাদকীয়-র পরিবর্তে

"আমি বিদ্রোহী নহি, বীর নহি, বোধ করি নির্বোধও নহি। উদ্যত রাজদণ্ডপাতের দ্বারা দলিত হইয়া অকস্মাৎ অপঘাতমৃত্যুর ইচ্ছাও আমার নাই। ক...